ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

টিভি চ্যানেলের সাতকাহন

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ৪ অক্টোবর ২০১৬

টিভি চ্যানেলের সাতকাহন

বিশ্বের প্রথম বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি দেশের একমাত্র টেরিস্ট্রিয়াল চ্যানেল। এর নেটওয়ার্ক দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে। বিটিভির বিরাট সম্ভাবনা ছিল দায়িত্বশীল ও দর্শকপ্রিয় গণমাধ্যম হিসেবে বিকশিত হওয়ার। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত নাটক এবং অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিটিভি তার জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে পেরেছিল। তবে সংবাদের ক্ষেত্রে বরাবরই এটি একটি পিছিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠান। যার কারণে মানুষ বিশ্বস্ত সংবাদ পেতে এক সময় বিবিসি রেডিওর ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন এদেশীয় নিউজ চ্যানেলগুলো দেখে। ২০১৪ সালের ১১ নবেম্বর প্রকাশিত একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন মতে, ‘বাধ্য না হলে এখন কেউ বিটিভি দেখে না। এটা মূলত সরকার ও সরকারী দলের নেতা-সমর্থকদের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে... এক দশক আগেও বিটিভির বছরে লাভ ছিল ৫২ কোটি টাকা, আর এখন লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা।’ কেন বিটিভির এ অবস্থা? দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি এবং সামরিক স্বৈরাচারী সরকারগুলোর অবহেলা ও ভুল নীতি, ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ পদ্ধতি এবং অযৌক্তিক পদোন্নতি এই প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। কিন্তু আজকে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী, স্বাধীনতার পক্ষের দেশীয় সংস্কৃতিবান্ধব সরকার ক্ষমতায় থাকার পরেও বিটিভিতে এখনও অনেকাংশেই ঐ অন্ধকার সময়গুলোর মতোই অবস্থা বিদ্যমান। এই সময়ে এসেও প্রশাসন ক্যাডারের আমলানির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বিটিভি। তবে আশার কথা হলো বিটিভির শীর্ষস্থানীয় এক কর্তা প্রশাসন ক্যাডারের আমলা হলেও একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর একাডেমিক ব্যাগরাউন্ড গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার। সরকারী প্রতিষ্ঠান আমলারাই চালাবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমলাটি প্রশাসন ক্যাডার থেকে কেন আসবেন? সরকার ইচ্ছা করলেই বিসিএসে বর্তমানের ২৮টি ক্যাডারের সঙ্গে টেলিভিশন ক্যাডার নামে আরও একটি ক্যাডার যুক্ত করতে পারেন। নাট্যকলা, সঙ্গীত এবং সাংবাদিকতার ওপর গত কয়েক দশক থেকেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা আছে। ক’বছর হলো টেলিভিশন অনুষ্ঠান এবং চলচ্চিত্রের ওপরও শিক্ষা নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছেলেমেয়েগুলো যারা পাস করে বের হচ্ছেন তাদের একাডেমিক বিষয় অনুযায়ী সংবাদ বিভাগ, নাটক বিভাগ, সঙ্গীত বিভাগ এবং অনুষ্ঠান বিভাগের প্রযোজক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে টেলিভিশন ক্যাডারের আমলা তৈরি করা হোক। আর এসব পদে জেনারেল বিষয় থেকে পাস করা প্রার্থীদের নিয়োগ বন্ধ করা হোক। কারণ এটি একটি বিশেষায়িত কর্মক্ষেত্র। নিয়োগপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তাগণই ভবিষ্যতে পদোন্নতির মাধ্যমে ডিজি, ডিডিজি, জিএম ইত্যাদি পদে যাবেন এবং একটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুষ্ঠুভাবে চলবে। এ মুহূর্তে বিটিভির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে অনুষ্ঠান বিভাগ এবং সংবাদ বিভাগে যারা প্রযোজক হিসাবে কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগই কাজের অভিজ্ঞতায় অপেক্ষাকৃত নতুন। অভিজ্ঞতায় কম হলেও সমস্যা হয় না, যদি তিনি অধিক পরিশ্রমের মাধ্যমে কাজ করে কাজটি শিখে নেন। এই অংশটির মধ্যে কাজ শেখার প্রবণতা নেই বললেই চলে। আর এই কাজ না শিখে সারাজীবন চাকরি করে যাওয়া প্রযোজকরা নিজেদেরও ঠকাচ্ছেন, জাতিকেও ঠকাচ্ছেন। এভাবে যদি তারা কাজ করে যান তাহলে তারা শুধু সরকারী চাকরিই করে যাবেন; কিন্তু মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসেবে বহুমুখী প্রতিভাবান অতীতের নামকরা প্রযোজকদের মতো হয়ে উঠতে পারবেন না। এই যদি হয় হাল তাহলে বিটিভির মতো মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে চাকরি না করে অন্য যে কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেই পারতেন। এমনও দেখা যায় যে, একটি অনুষ্ঠান পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু প্রযোজকের চেহারা দেখা যায় না। প্রযোজকদের সঙ্গে কাজ করা শিক্ষাগত যোগ্যতা, কারিগরি এবং নান্দনিক জ্ঞানে অপেক্ষাকৃত কম এক শ্রেণীর অনুষ্ঠান সহযোগী কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে একটি অনুষ্ঠান বানিয়ে ফেলছেন। যার কারণে নিম্নমানের অসংখ্য অনুষ্ঠান বিটিভিতে দিনের পর দিন প্রচার হয়ে আসছে। আর এখনকার এই সমস্ত প্রযোজক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নয়টা-পাঁচটা চাকরি করেন। কিন্তু অতীতে যারা দিকপাল হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন তাঁদের নিকট বিটিভি নয়টা-পাঁচটার চাকরির প্রতিষ্ঠান ছিল না। বাস্তবিক অর্থে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে কাজের ক্ষেত্রে টাইমের কোন হিসাব নেই। বর্তমানে প্রযোজকদের এই চাকরির নামে অকাজ মনিটরিং এবং জবাবদিহি করার কোন ব্যবস্থা নেই। বিটিভির অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে হলে প্রযোজক প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের এই দায়িত্বহীন স্বেচ্ছাচারিতা মনিটরিং করা একান্ত জরুরী। বর্তমান প্রযোজকদের অনেকেই বিএনপি-জামায়াত আদর্শধারী। তাদের বেশিরভাগই ১৯৯১ এবং ২০০১ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। আর এই বিএনপি-জামায়াত আদর্শধারী প্রযোজকগণ কোনভাবেই চান না বিটিভি নিয়ে সরকার সফলতার মুখ দেখুক। ১৯৯৬ আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে বিটিভিতে প্রযোজক নিয়োগ হয়নি বললেই চলে। অতীতের প্রতিটি সরকারই নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য চ্যানেলটি ব্যবহার করেছে। এতে সরকার কতটা লাভবান হয় তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু বিটিভির যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা প্রশ্নাতীত। সময় এসেছে এই ক্ষতি পুষিয়ে বের হয়ে আসার। স্বাধীনতার পক্ষের বর্তমান সংস্কৃতিবান্ধব সরকারের পক্ষেই অতীতের ধ্যান-ধারণা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা সম্ভব সেটিই সমগ্র জাতি প্রত্যাশা করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সরকারের বিভিন্ন বিভাগে ব্যাপক সংস্কার করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের বিজয়ের পরেও সেই ধারা অব্যাহত আছে। কিছু কিছু জায়গায় ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সরকারের আত্মবিশ্বাসও আকাশচুম্বী। যার কারণে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিটিভির কোন পরিবর্তন এখনও দৃশ্যমান নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিটিভি নিয়ে ভাববার সময় কারও নেই। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু মহাজোট সরকারের একজন অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং করিৎকর্মা মানুষ এ কথা বলতেই হয়। তিনি রাজনীতির মাঠে দিনরাত পরিশ্রম করে সরগরম করে রেখেছেন। মহাজোট সরকারের সাড়ে সাত বছর পেরিয়ে গেলেও তার মন্ত্রণালয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যায় হিমশিম খাচ্ছে। এত নিরাশার পর একথা বলা যায়, সামান্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেই বিটিভির ধারেকাছে দাঁড়াবার মতো ক্ষমতা রাখে না কেউ। বেসরকারী চ্যানেলগুলোর সীমাহীন বিজ্ঞাপন অত্যাচার, স্ক্রল এবং বিভিন্ন শেপের বিজ্ঞাপনে স্ক্রিন ভরাট হয়ে যাওয়া সমস্যাগুলো বিটিভির ক্ষেত্রে নেই। এমনকি বিটিভির প্রায় ৬৬% অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বিজ্ঞাপনমুক্ত অর্থাৎ ব্রেকফ্রি। ১৮ ঘণ্টা সম্প্রচারের মধ্যে যে ৬ ঘণ্টা বিজ্ঞাপন চলে সেটিও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। শুধু একটি সঠিক পরিকল্পনা এবং পরিচালনাই পারে বিটিভিকে মান্ধাতার আমলের সেই অব্যবস্থা থেকে বের করে আনতে। ১৯৯৭ সালে আমাদের দেশে এটিএন বাংলার মাধ্যমে বেসরকারী স্যাটেলাইট চ্যানেলের যাত্রা শুরু“হয়। বেসরকারী চ্যানেলও আজ ২০ বছর অতিক্রম করে ফেলেছে। চ্যানেল সংখ্যা বাড়তে বাড়তে সম্প্রচারে আছে এবং আসবে সব মিলিয়ে ৪০-এর কাছাকাছি। প্রশ্ন হলো, এই বেসরকারী চ্যানেলগুলো যে উদ্দেশ্যে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল তার কতটা পূরণ করতে পেরেছে? কেন এদেশের ৭০%-এর ওপরে দর্শক বিদেশী চ্যানেল দেখে? যে ৩০%-এর কম দর্শক আমাদের বেসরকারী চ্যানেল দেখে তা শুধুমাত্র দেশ-বিদেশের খবর আর খেলার জন্য। ঘণ্টায় কত মিনিট বিজ্ঞাপন চলবে এরকম কোন নীতিমালা না থাকায় টিভিসি অনুষ্ঠানের ডিউরেশনের চেয়ে বেশি সময় ধরে। অথচ পাশের দেশ ভারতসহ পৃথিবীর সব দেশেই এ ব্যাপারে নীতিমালা আছে। টিভি পর্দাগুলোতে এক পাশে তাদের লোগো থাকবে তাতে কোন প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন হচ্ছে পর্দার বিভিন্ন অংশজুড়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য ওই পণ্যের লোগো প্রদর্শন করা হয়। এল শেপ আর ইউশেপ তো আছেই। স্ক্রল তিন থেকে চার লাইনে পৌঁছায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সর্বসাকল্যে টিভি পর্দা অর্ধেক দৃশ্যমান থাকে। এতে করে পাড়া-মহল্লায় স্থানীয়ভাবে ক্যাবল চ্যানেলগুলোর যে রূপ সেই অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের বেসরকারী চ্যানেলগুলোর পর্দা। হাতে সুযোগ আছে রিমোট চালিয়ে বিদেশী পরিচ্ছন্ন পর্দার চ্যানেল দেখবার। কেন সেই সুযোগ দর্শক নেবে না? সেই সুযোগটিই ব্যবহার করছে ৭০%-এর ওপরে দর্শক। এই মুহূর্তে যে পরিমাণ টিভি চ্যানেল দেশে বিদ্যমান এবং আসার অপেক্ষায় আছে সেই পরিমাণ দক্ষ জনবল নেই। যার কারণে কোন বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠান পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। আর এই দক্ষতার অভাবে কপি-পেস্ট অর্থাৎ একটি চ্যানেল যা করছে ঠিক তারই কপি-পেস্ট করে আর একটি চ্যানেলে অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। এমনকি ভারতীয় চ্যানেলের সিরিয়ালও কপি করার চেষ্টা হচ্ছে। এতে করে অনেক নিম্নমানের অনুষ্ঠানে ভরে উঠেছে বেসরকারী চ্যানেলগুলো। তবে হাতেগোনা সীমিত কয়েকটি চ্যানেল অনুষ্ঠান নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে ভাল কিছু করার চেষ্টা করছে। ৫-৬টি নিউজ চ্যানেল বাদে প্রায় সবগুলোই সংবাদ, নাটক, অনুষ্ঠান সবকিছু মিলিয়ে মিশ্র চ্যানেল। এই মিশ্রতাকে সামাল দিতে গিয়ে চ্যানেলগুলোর অবস্থা টালমাটাল। খেয়াল করলে দেখা যায় যে, পাশের দেশ ভারতসহ পৃথিবীর সব দেশেই টিভি চ্যানেলগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের মতো এ ধরনের মিশ্র চ্যানেল নয়। যার কারণে তারা বিশেষায়িত বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে নজর দিতে পারে এবং সেই অনুযায়ী মান বজায় রাখতে পারে। আর বেসরকারী চ্যানেলগুলোর জন্মও হয়েছে অনেকটা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। কিন্তু অপরিকল্পিত অবস্থায় দিনের পর দিন চলার কারণে এবং ছোট বিজ্ঞাপন মার্কেটের কারণে হাতেগোনা কয়েকটি চ্যানেল বাদে সবগুলোই বছরের পর বছর লোকসান গুনছে। এ কারণে ঠিকমতো চ্যানেলকর্মীদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। যার কারণে কর্মীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত অসন্তোষ বিরাজ করছে। কর্তৃপক্ষ এভাবে লস দিয়ে হয়ত ২/৪/৬/৮ বছর চালাবেন; কিন্তু তারপর? অবস্থাদৃষ্টে আশঙ্কা হয় যে, এই দেশে এক সময় সিনেমা ব্যবসায় ধস নামার কারণে যেভাবে মহামারীর মতো হলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে ঠিক সেইভাবে টিভি চ্যানেলের ব্যবসা না থাকার কারণে আবার টিভি চ্যানেলগুলোও না বন্ধ হয়ে যায়! লেখক : সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক [email protected]
×