ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ নূরুল হুদা

অশেষ তাঁর সৃষ্টিসত্তা

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অশেষ তাঁর সৃষ্টিসত্তা

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ও একুশ শতকের প্রথম আড়াই দশকজুড়ে যারা বাংলা সাহিত্যকে প্রবল প্রতাপে দাবড়ে বেড়িয়েছেন, তাদেরই সর্বাগ্রগণ্যদের অন্যতম সৈয়দ শামসুল হক। আসলে সমকালীন বাংলা কবিতা ও বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতার এক শ্রেষ্ঠ কারুকৃৎ তিনি। আবার তিনিই আমাদের সকলের প্রিয় হক ভাই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সেই তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। এখন থেকে তিনি চিরজীবিতদের দলে। কেননা তাঁর সৃষ্টি অবিনাশী। অবিনাশী তাঁর আলোকদৃষ্টি, তাঁর মন ও মনন। বাঙালীর চিত্তকে তিনি পরিশুদ্ধ করেছেন তাঁর কবিতা, কথাসাহিত্য, নাটক, গান, বাগ্মিতা, কথকতা ও আরও কত বিচিত্র প্রকরণে ও অভিব্যক্তিতে। তিনি তাঁর বহুমাত্রিক সৃষ্টিশক্তি ও নন্দনকুশলতার কারণে ছয় দশকেরও অধিক কাল ধরে বাংলার সৃষ্টিলোকে সব্যসাচী অভিধায় অভিহিত। কে কখন কোথায় এ অভিধা তাঁকে দিয়েছিল, তা আমাদের জানা নেই; কিন্তু এ অভিধার প্রতি নীরব সমর্থন জানিয়ে রেখেছেন তাঁর সময়ের বাংলা ভাষাভাষী তাবত লেখক ও পাঠক সমাজ। ভবিষ্যতে এ অভিধা যে আরও পোক্ত হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা এই সুপরিচিত অভিধা নিয়ে কথা বলছি এজন্য যে, এর ভেতরেই নিহিত আছে সৃষ্টিশীল শিল্পী হিসেবে তাঁর শক্তিমত্তা ও ব্যাপ্তি। সাধারণত যারা বহুমাত্রিক ও অতিপ্রজ লেখক তাদের সকলেরই একটি মুখ্য পরিচিতি থাকে বিশেষ কোন আঙ্গিকে, যাকে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রধান ও পছন্দসই মনে করেন। আবার এ-ও সত্য, সব ধারার মধ্যে একটি ধারাতেই তাঁর মূল পরিচয়, অন্যগুলো সম্পূরক মাত্র। আসলে এমনটিই হয়ে থাকে প্রায় সবার ক্ষেত্রে। কিন্তু অবাক করার বিষয় এই যে, এটি সৈয়দ শামসুল হকের জন্য প্রযোজ্য বলে মনে হয় না। যারা তাঁর নিবিষ্ট পাঠক, তারা খুব ভাল করেই জানেন, গদ্য-পদ্যে তো বটেই, গল্প-কবিতা-নাটক-উপন্যাস-প্রবন্ধ-কাব্যনাট্য-অনুবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকরণেও তিনি প্রায় সমান দক্ষতার পরিচয় অব্যাহত রেখে লিখে চলেছিলেন ষাট বছরেরও অধিক কাল ধরে, যা কোন সাহিত্যেই সহজ লক্ষ্য নয়। সেই ১৯৫৪ সালে ‘তাস’ শীর্ষক গল্পগ্রন্থ দিয়ে তাঁর প্রকাশনা শুরু হয়েছিল, এরপর আর পেছন ফেরা নেই। আমি নিজেও তাঁর গল্প ‘রক্তগোলাপ’ পাঠ করেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হই সেই বিশ শতকের ষাটের দশকে; তারপর আমাকে প্রবলভাবে আক্রান্ত করে তাঁর একটি দীর্ঘ কবিতা : ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, যার অসংখ্য পঙ্ক্তি আমার স্মৃতিতে দীর্ঘদিন জাগ্রত ছিল। মানবজীবন, মনোবিবর্তন, তৎসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবয়ান ও সামষ্টিক স্বীকারোক্তির কারণেই এ কাব্যটি এখনও আমার কাছে অনন্য। সম্ভবত এটিই বাংলাদেশের কবিতায় কনফেশনাল পয়েট্রির এক আদি সফল নমুনা। দেশ, ইতিহাস, ব্যক্তি মানুষ ও জাতি মানুষের এক বিশেষ সমন্বয়ের এমন সাহসী ও শৈল্পিক দলিল সহজে দেখা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, এ বয়ানের অক্ষরবৃত্তীয় গতি ও বিবর্তিত চিত্রকল্প, যা এ কবিতাকে সহজবোধ্য ও রহস্যসঞ্চারী এই দুই বিপরীত বৈশিষ্ট্যে ঋদ্ধ করে রেখেছে। ‘রক্তগোলাপ’ ও ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’ পাঠ করার পর বিশ শতকের সেই মধ্য-ষাটেই আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম, আমি এক বিশ্বমানের লেখকের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি; যদিও তিনি তখনও পূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ। ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’য় সম্ভবত তিনিই সর্বপ্রথম বাঙালী কবিদের মধ্যে কনফেশনাল পয়েট্রি বা আত্মজৈবনিক কবিতার সূত্রপাত করেছিলেন। আজ তাঁর বিপুল সাহিত্য-সম্ভারের তুঙ্গীয় কর্মের দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি : না, আমার বা আমাদের সময়ের অনেকের অনুমান মিথ্যে হয়নি। আজ তিনি শুধু বাংলাদেশেরই শীর্ষতম বহুমাত্রিকদের একজন নন, বরং সমগ্র বাংলা ভাষায়, এমনকি সমসাময়িক বিশ্বের সাহিত্য স্রষ্টাদের মধ্যেও তাঁর অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণভাবে সুনির্ণীত। কেননা এ যাবত রচিত তাঁর শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে বিভিন্ন আঙ্গিকে এমন কিছু রচনা আছে, যা শৈল্পিক সংহতি, ব্যাপ্তি, বাণী ও ইশারাময়তার জন্য মাস্টারপিস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আর এসব রচনায় তিনি অর্জন করেছেন এমন এক মুদ্রা, যা একান্তভাবেই তাঁর। এটাকে আমরা বলতে পারি হক-মুদ্রা। এমন হক-মুদ্রার সতর্ক ব্যবহার তাঁর যে কোন গদ্যে-পদ্যে সুলভ; তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই তাঁর বহুল পরিচিত ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ ইত্যাদির মধ্যে, যেখানে তিনি স্ব-ভাষা, ব্যক্তিপুরাণ, স্ব-কাল, ইতিহাস ও মানবসভ্যতার নানাকৌণিক সংশ্লেষ সম্পন্ন করেছেন। আমি জানি, এ মন্তব্য বৈধকরণের জন্য যে বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন তার সুযোগ এখানে নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, আজীবন অনন্য ব্যক্তিমুদ্রার সাধক সৈয়দ হক তাঁর শব্দে, বাক্যে, পুরাণের নবায়নে, ব্যক্তির বিবর্তন পরিচিতি নির্মাণে, ঐতিহাসিক সত্যের স্বতন্ত্র ব্যাখ্যায়, বাঙালী জাতির প্রকৃতিসম্মত ও ইতিহাসবাহিত বিবর্তনের সচেতন নিরীক্ষক ও রূপকার। তাই তাঁর রচনায় বাঙালীর আদি পরিচয় থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা বাঙালী ও একাত্তরোত্তর বিজয়ী বাঙালীর পরিচয় সুবিধৃত। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বসভ্যতা ও বিশ্বমানুষ। তাঁর যে কোন স্বাতন্ত্র্যবাহী কবিতায় এর প্রতিফলন শনাক্তযোগ্য। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বোধকরি তাঁর ‘আমার পরিচয়’ শীর্ষক কবিতাটি, যেখানে তাঁর ইতিহাস চেতনা ও আত্মশনাক্তির এষণা অনবদ্য অভিব্যক্তিতে মূর্ততা পেয়েছে : ‘আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি।/আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।/চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।/তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?’ তারপর কবির উত্তর দেয়ার পালা। নির্ভুল কাব্যিক সত্যে এরপর তিনি বয়ান করেছেন তাঁর উৎস-বিবরণ। তার মধ্যে আছে পুরাণ, কিংবদন্তি, ইতিহাস, বাস্তবতা, আর মুক্তিযুদ্ধের সত্যকথন। আছে চর্যাপদ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত বাঙালীর হাজার বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। এ সহজ-সরল সত্যাশ্রিত কবিতাটিই বাঙালী কবি সৈয়দ শামসুল হকের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সৃষ্টি। শুধু এই একটি কবিতার জন্যই বাঙালী তাঁকে স্মরণ করবে অনন্তকাল। তাই তাঁকে নিয়ে তাঁর প্রয়াণের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে লিখেছিলাম : ‘বাংলার কবিপুত্র তুমি, তুমি পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বহমানতা,/তুমি কর্ণফুলীর মাঝির বুকে দুলে-ওঠা সাম্পানের বৈঠা,/তুমি সুন্দরবনের রাজব্যাঘ্রের ডোরাকাটা চোখের দৃষ্টি,/তুমি শালতমালের বনে বনে জয়দেবের মুষর-বৃষ্টি;/না, শেষ হয় না কোনো কাহ্নু-পার সৃষ্টি।’ বাঙালী সৈয়দ হক, মানুষ সৈয়দ হক ও সৃষ্টিশীল সত্তা সৈয়দ হকের কীর্তিও তাই অশেষ ও বিবর্তমান। তিনি নতুন কবির বুকে কবিতার নতুন শপথ। তিনি প্রমিত বাঙালীর নবায়নযোগ্য উৎস-প্রেরণা। তাঁর প্রতি উত্তর-প্রজন্মের প্রণতি।
×