ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাটপণ্য কৃষিপণ্যের তালিকাভুক্ত হচ্ছে, ভর্তুকি পাবেন চাষী

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পাটপণ্য কৃষিপণ্যের তালিকাভুক্ত হচ্ছে, ভর্তুকি পাবেন চাষী

এম শাহজাহান ॥ অবশেষে সব ধরনের পাটজাতপণ্যকে কৃষিপণ্যের তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে পাটজাতপণ্য রফতানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা পাবেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। কৃষিপণ্য হিসেবে কৃষকরা উৎপাদনে সরকারী ভর্তুকি পাবেন। পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্পোরেট করের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেয়া হবে। ইতোমধ্যে পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ এবং পণ্য মোড়কে পাটজাত ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থাৎ কৃষিজাত পণ্যের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের হারানো সুদিন ফিরে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাটপণ্য কৃষিজাতপণ্যের বাইরে থাকায় কৃষিপণ্য হয়েও ছিল অবহেলিত। উৎপাদন ও রফতানিতে সরকারী সহযোগিতা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছিল পাটের ঐতিহ্য। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘সোনালী আঁশ’ নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন নীতিনির্ধারকরা। এরই মধ্যে বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম পাটের ‘জিন’ আবিষ্কার করতে সক্ষম হোন। পরবর্তীতে এ শিল্পের হৃত ঐতিহ্য ফেরাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিজাতপণ্যের তালিকাভুক্ত করে পাট উৎপাদন বাড়ানোর ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণা অনুযায়ী এবার পাটজাতপণ্যকে কৃষিপণ্যের তালিকাভুক্তকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। একই সঙ্গে পাটজাতপণ্যকে কৃষিপণ্যের তালিকাভুক্ত করে কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের মতো সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি হবে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে শীঘ্রই এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে। জানা গেছে, পাটপণ্যকে সরাসরি কৃষি প্রক্রিয়াজাতপণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রফতানি সুবিধা দেয়ার পক্ষে ছিল না অর্থ মন্ত্রণালয়। এ কারণে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে একাধিক চিঠি দেয়ার পরও এ প্রসঙ্গে কোন মতামত দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি তারা। তবে সরকারী সিদ্ধান্তে পাটপণ্যকে কৃষি ও কৃষিপ্রক্রিয়াজাতপণ্য হিসেবে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে দ্বিমত নেই জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ইতোপূর্বে বলা হয়েছে- পণ্যটি রফতানির ক্ষেত্রে অন্যান্য কৃষিপণ্য রফতানির মতো সুবিধা দেয়া হবে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের মতামত পাওয়ার পর পাট ও পাটজাত পণ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে ইতোপূর্বে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নীতি-নির্ধারকরাও। ওই সময় বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমও অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই আচরণ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে পাটপণ্যকে কৃষিজাত পণ্যের তালিকাভুক্ত করে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবরই আন্তরিক ছিলেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ এক অনুষ্ঠান শেষে জনকণ্ঠকে বলেন, পাটশিল্প রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী বরাবরই আন্তরিক। অর্থকরী ফসল হিসেবে পাটের হৃত গৌরবও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তিনি বলেন, পাটের জিন আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে উৎপাদন এবং এ শিল্পের সম্প্রসারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে শীঘ্রই একটি বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই বৈঠকে পাটশিল্পের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এদিকে, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে কৃষিজাত পণ্য রফতানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা পেয়ে এলেও কৃষিভিত্তিক ফসল পাট এই সুবিধা থেকে বরাবরই বঞ্চিত। শুধু তাই নয়, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাটজাত পণ্য রফতানিতে ১০ শতাংশ ও পাট সুতার ক্ষেত্রে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেয়া হলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই সুবিধা কমিয়ে পাটজাত পণ্যের ক্ষেত্রে সাড়ে ৭ শতাংশ এবং সুতার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ ভারতে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য হিসেবে পাটপণ্য পুরোপুরি সরকারী সহায়তা পাচ্ছে। ফলে পার্শ্ববর্তী দেশটির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশের পাট খাত। পাটপণ্যকে কৃষি প্রক্রিয়াজাতপণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি দীর্ঘদিনের। বিষয়টি নিয়ে আগের সরকারগুলোও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। তবে দাতা সংস্থাগুলোর আপত্তির মুখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি বিগত সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী ইশতেহারেই পাট খাতের উন্নয়নের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের ব্যবহার কয়েকটি খাতে বাধ্যতামূলক করা ছাড়াও পাটকলগুলোর সংস্কার ও পাট চাষীদের সুরক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। এদিকে, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলেন, পাটশিল্প দেশের একমাত্র শিল্প যা শতভাগ দেশী কাঁচামাল ব্যবহার করে এবং শতভাগের বেশি মূল্য সংযোজন করে থাকে। এ শিল্পের সঙ্গে দেশের প্রায় ৪ কোটি লোক কোন না কোনভাবে জড়িত। পাটকে আলাদা কোন কৃষিপণ্য হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। পাট অন্যান্য পণ্যের মতোই এদেশের কৃষিপণ্য। পরিবেশবান্ধব হওয়ায় এখন বিশ্বব্যাপী পাটপণ্যের চাহিদাও বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তা ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, পাটপণ্যকে কৃষিপণ্য ঘোষণা করে রফতানিতে নগদ সহায়তা প্রদান করতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রান্তিক চাষীদের উৎসাহিত করতে উৎপাদনে ভর্তুকি বাড়ানো প্রয়োজন। পণ্য মোড়কে পাটপণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করাসহ দেশের পাটকলগুলো চালুর সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। পাটশিল্প সম্প্রসারণে বাঁচবে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। এছাড়া পাটকলগুলো চালু করা গেলে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হবে ॥ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে হলে পাটপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। দেশ স্বাধীনের পরও ৮৭ পাটকল ছিল দেশে। কিন্তু আশির দশক থেকেই দাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শে তৎকালীন সরকারগুলোর নেয়া বৈরী সিদ্ধান্তে একের পর এক বন্ধ হতে থাকে পাটকল, তখন নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয়া হয় বৃহৎ পাটকলগুলো। এর ফলে বাংলাদেশ হারায় তার বিশ্ব পাটের বাজার। দেশেও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার উঠে যায়। সেই জায়গা দখল করে নেয় আমদানি করা কৃত্রিম তন্তু। পলিথিন প্যাকেট ও ব্যাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। এই সর্বগ্রাসী পলিথিন ব্যাগ এখন দেশের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে আশার কথা, পলিথিন ব্যাগের অবাধ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। পাটজাত পণ্য উৎপাদনে কর্পোরেট কর হার কমানো হয়েছে ॥ পাটপণ্য উৎপাদনে শিল্পপ্রতিষ্ঠান কর্পোরেট করের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে। তালিকাবহির্ভূত অন্য প্রতিষ্ঠান ৩৫-৪৫ শতাংশ আয়কর দিতে হলেও পাটজাত শিল্পে এ হার ১৫ শতাংশ। তবে পাট শিল্পের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এ কর হার আরও কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে এনবিআর। আগামী চার বছর শিল্পের অর্জিত আয়ে কোম্পানির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্য করদাতারাও এ সুবিধা পাবেন।
×