ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

উইন-উইন মানসিকতা

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

উইন-উইন মানসিকতা

কয়েক বছর আগে বুয়েটে আমার খুব প্রিয় একজন শিক্ষক ফোন করে বললেন, স্বপন আমি তো খুব বিপদে আছি! আমি হাসতে হাসতে বললাম, কেন স্যার, কী হয়েছে? তিনি ইতস্তত করে বললেন, আপনি তো জানেন সম্প্রতি আমাকে একটা পুরস্কার দেয়া হয়েছে। -জি স্যার। এটা তো খুব ভাল একটা বিষয়। তাতে সমস্যাটা কোথায়? -সমস্যা হলো, পুরস্কার পাওয়ার পর তো আমার শত্রুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। অনেকেই তো কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। -এর অর্থ কী? -আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক মন খারাপ করেছেন। -কেন? -আমার ধারণা, তারা মনে করছেন পুরস্কারটি তারাও পেতে পারতেন। -তাতে আপনার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করতে হবে কেন? -আমি তো বুঝতে পারছি না। পুরস্কার তো দেয়া হয় অন্যদের উৎসাহিত করার জন্য। কিন্তু এখন দেখছি হিতে বিপরীত হলো। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচারও চালাচ্ছেন কেউ কেউ। বলেন তো কী করি? -কারণটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। এটা না বুঝে কিভাবে কী বলি? -শোনেন, কারণটা খুব পরিষ্কার। আমাকে পুরস্কার দেয়াতে অন্যরা অপমানিত হয়েছেন। তারা ভাবছেন, তাদের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। -কিন্তু পুরস্কার দেয়ার প্রথা তো এসেছে অন্যরা যেন আপনার মতো ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ হয় সে জন্য? তাই নয় কি? -ব্যাপারটা তো তাই। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, বিষয়টা কাজ করছে না। আমার এই পুরস্কারের দরকার নেই। আমি পুরস্কারটা ফেরত দিয়ে দেই, কি বলেন? -স্যার, একটু অপেক্ষা করেন। বিষয়টা আরেকটু বুঝে নেই। -এখানে বোঝাবুঝির তেমন কিছু নেই। এই দেশে আপনি একজনকে পুরস্কৃত করবেন, তাতে অন্যরা অপমানিত হবে। এই যখন মানসিকতা তখন সেই দেশে মানুষ কাজ করবে কিভাবে? এই ঘটনাটি ঘটার পর দীর্ঘ সময় ধরে আমি ভেবেছি- মানুষের মাথায় কী এমন খেলে যা অন্যকে পুরস্কৃত করলে আরেকজন অপমানিত অনুভব করে। এটা কি এক ধরনের ঈর্ষাপরায়ণতা? আমরা ভাল কাজের দিকে উৎসাহিত না হয়ে, কেন পুরস্কৃত মানুষটিকে টেনে নামানোর চেষ্টা করি? সমস্যাটা কোথায়? দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। এটা কি এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা যা মানুষকে ভিন্নভাবে ভাবতে শেখায়? পুরস্কার প্রাপ্তির আগে সবাই মিলেমিশে কাজ করত। যেই মুহূর্তে একজনকে পুরস্কার দেয়া হলো, তারপর থেকেই অন্যদের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হলো। সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা বৈরীতে পরিণত হলো। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। পুরস্কার দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল অন্যদের উৎসাহিত করা। তাহলে কি সেটা কাজ করছে না? গত সপ্তাহে লিখেছিলাম ইমোশনাল ব্যাংক এ্যাকাউন্ট নিয়ে। ড. স্টিফেন কোভের লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিট অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটির পরের অভ্যাসগুলো হলো পাবলিক ভিক্টোরি নিয়ে। মূলত কিভাবে আপনি আপনার চারপাশের মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করবেন এবং নিজের একটি ইমেজ তৈরি করবেন, কিভাবে সামাজিকভাবে আপনি সফল হবেন- সেই অভ্যাসগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে তিনটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। আজকে লিখছি তার থেকে প্রথম অভ্যাসটি নিয়ে। মানুষের সঙ্গে ইন্টার‌্যাকশনের ছয়টি দৃষ্টান্ত আপনি একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হোন, কিংবা সাধারণ কর্মী, কিংবা একজন সাদামাটা মা-বাবা, আপনি যখনই অন্য কারও সঙ্গে ইন্টার‌্যাক্ট করতে যাবেন, সেই মুহূর্তে আসলে আপনি অন্যের ওপর নিজের ছাপ রেখে যাচ্ছেন। সেটা মা-বাবা হিসেবে যেমনটা করছেন আপনার সন্তানের ওপর, একজন বিক্রেতা হিসেবে করছেন ক্রেতার ওপর, একজন কর্মী হিসেবে করছেন অন্যান্য কর্মীর ওপর। আপনি যদি সেই ইন্টার‌্যাকশনকে পাত্তা না দেন, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব ফেলতে চান, তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে এই আদান-প্রদানের ফরমেটটা কেমন হয়। মানুষ মূলত ছয়টি উপায়ে অন্য মানুষের সঙ্গে আদান-প্রদান করে থাকে। সেগুলো হলো- ১. উইন/উইন ২. উইন/লুস ৩. লুস/উইন ৪. লুস/লুস ৫. উইন ৬. উইন/উইন, নয়তো নো-ডিল আমি ইচ্ছে করেই এই টার্মগুলোকে বাংলা করলাম না। এগুলো বহুল প্রচলিত শব্দ। বাংলা করতে গেলে মূল ভাবটি নষ্ট হতে পারে। উইন/লুস এগুলো আমরা সবাই কম-বেশি বুঝি। তাই এটা নিয়েই এগুনো যাক এবং এই ছয়টি বিষয় নিয়ে কিছুটা আলোচনা করি, যেন আপনি বুঝতে পারেন আপনার ব্রেনটি কিভাবে প্রোগ্রাম করা। তার ওপর নির্ভর করবে, আপনি আসলে কতটা ইফেক্টিভ হতে পারবেন। ১. উইন/উইন উইন/উইন হলো মানুষের মনের একটি ফ্রেমওয়ার্ক যা প্রতিনিয়ত উভয় পক্ষের ভালটা খুঁজতে থাকে। এটা আসলে কোন টেকনিক কিংবা উপায় নয় যে, আপনি ক্ষেত্র বিশেষ প্রয়োগ করে লাভবান হয়ে যাবেন। এটা হলো এক ধরনের দর্শন যা আপনার ভেতর থাকবে, নয়ত থাকবে না। যদি থাকে, তাহলে সব সময়ই থাকবে। আর যদি না থাকে, তাহলে আপনি এটাকে একটা টেকনিক হিসেবে প্রয়োগ করতে পারবেন না। আপনাকে মূলত এই গুণটি অর্জন করতে হবে। এই গুণের মানুষগুলো সবকিছুতেই উভয় পক্ষের স্বার্থটি খেয়াল রাখে। তারা বিশ্বাস করে, যে কোন ইন্টার‌্যাকশনেই উভয়কেই জিততে হবে, উভয়কেই ভাল অনুভব করতে হবে এবং উভয়কেই পরিতৃপ্ত হতে হবে। উইন/উইন চিন্তার মানুষগুলো একটু ভিন্ন ধরনের হয়। তারা উভয়ই সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে ভাল অনুভব করে, এবং সেটাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য অনেক বেশি দৃঢ়সংকল্প থাকে। এরা পৃথিবীকে প্রতিযোগিতাপূর্ণ কোন খেলার মাঠ হিসেবে দেখে না; এরা মূলত সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা দিয়ে পরিচালিত হয়। এরা সব কিছুতেই সহযোগিতার হাত দেখতে পায়। অনেকেই সব কিছুতেই হার বা জিত দেখতে পায় এবং সেভাবেই পৃথিবীকে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু উইন/উইন মানসিকতার মানুষ সেভাবে পৃথিবীকে দেখে না। তারা মনে করে না যে, এই পৃথিবীতে রিসোর্সের সঙ্কট রয়েছে। তারা মনে করে না যে, অন্যেরটা কেড়ে নিয়ে নিজেরটা বড় করতে হবে। তারা বিশ্বাস করে, এই পৃথিবীতে অনেক আছে, সেটা সবাই ভাগ করে নিলেও নিজের কমতি হবে না। তারা একটা নীতির ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। তারা মনে করে না যে, একজনের সাফল্য আরেকজনের ব্যর্থতার ওপর দাঁড়িয়ে করতে হবে। ২. উইন/লুস বাংলাদেশের যত মানুষের সঙ্গে আমি ওঠাবসা করেছি, সেখানে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক হলো ‘উইন/লুস’ স্ক্রিপ্ট পরিচালিত মানুষ। তাদের ব্রেনে এই স্ক্রিপ্টটা টাট্টু করে ছাপ দেয়া রয়েছে। তারা সব সময় জিততে চায় এবং অন্যকে ঠকিয়ে জিততে চায়। এর বাইরে এরা ভাবতেই পারে না। সব সময় মাথায় থাকে, ‘আমি জিতব, তুমি হারবে।’ একটা কঠিন প্রতিযোগিতার ভেতর নিজেকে গড়ে তুলেছে এই গোত্রের মানুষ। আপনি যখনই কোন লিডারশিপ পজিশনে যাবেন এবং আপনার ভেতর স্ক্রিপ্টটা হলো ‘উইন/লুস’ দিয়ে লেখা, আপনি আপনার ক্ষমতা, অবস্থান, লিঙ্ক সবকিছু ব্যবহার করবেন যেন আপনি সব সময় জিততে পারেন এবং আপনি নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন, অন্যরা যেন পরাজিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের স্ক্রিপ্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের খুব ছোটবেলা থেকেই মাথায় গেঁথে যায়। তারা বেড়ে ওঠে এই ফর্মুলা দিয়ে। তারা পরিবার থেকে এটা পেয়ে থাকে। ছোটবেলায় তার মা-বাবা যখন তার সঙ্গে অন্য ভাইবোনদের তুলনা করা শিখিয়েছে, তখন থেকেই তার ভেতর এটা ঢুকে গেছে। পরিবারের যে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি লেখাপড়ায় ভাল, তাকে যখন বেশি আদর করা হচ্ছে, সবার ব্রেনে এটা ঢুকে যাচ্ছে যে, মা-বাবার ভালবাসা অর্জন করতে হলে তাকে লেখাপড়ায় জিততে হবে। তাকে কোন না কোন কিছুতে জিততে হবে, তখনই তার ভেতর অন্যকে হারিয়ে নিজে জেতার একক মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়। আমরা মা-বাবারা প্রতিনিয়ত একেকটি বাচ্চার সঙ্গে অন্য বাচ্চার তুলনা করি, কখনও নিজের পরিবারের ভেতর, কখনও খালাত-চাচাত ভাই-বোনদের ভেতর। এই তুলনামূলক আচরণ শিশুটির ভেতর যে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা তৈরি করছে, সেটা আমরা খেয়াল করি না। আমরা তাদের ভেতর সহযোগিতার মনোভাব জাগিয়ে তুলি না। আমরা তাদের একটি কঠিন প্রতিযোগিতার ভেতর ফেলে দেই এবং এই বয়সে প্রতিটি শিশু খুব ভালনারেবল থাকে। সে বুঝতে শেখে, ‘আমি যদি আমার ভাইয়ের চেয়ে ভাল করি, তাহলে আমার মা-বাবা আমাকে বেশি আদর করবে।’ সে ভাবতে শেখে, ‘আমাকে আমার মা-বাবা আমার বোনের মতো ভালবাসে না। আমার মূল্য কম।’ এই ধরনের স্ক্রিপ্ট তৈরিতে আরেকটি স্থান হলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও সহযোগিতার মনোভাব নেই। আমরা ক্লাসে একটি চরম প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করি। প্রতিদিন ক্লাসে শেখাই, ও ফার্স্ট হয়েছে (তাকে বেশি আদর কর), এই মেয়েটি সবচেয়ে ভাল (তার মা-বাবাকে জানিয়ে খুশি কর), ওই ছেলটি ফুল মার্ক পায়নি (তাকে আদর করা যাবে না) ইত্যাদি স্ক্রিপ্ট আমাদের কাছে লেখা আছে। ছাত্রছাত্রীরাও এটা জানে। তাই আমাদের দেশে ফার্স্ট বয় আর সেকেন্ড বয় (কিংবা গার্ল)-এর ভেতর বন্ধুত্ব তৈরি হয় না। একটু বন্ধুত্ব হলেও সহযোগিতার হাত খোলা থাকে না। তাদের ভেতর এক ধরনের চরম বৈরী প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকে। তারা টিম প্লেয়ার হয় না। আমাদের জীবনে প্রতিযোগিতার জায়গা রয়েছে। খেলায় হার বা জিত থাকবে। কিন্তু একটি দলের খেলোয়াড়দের নিজেদের ভেতর প্রতিযোগিতা থাকলে সেখানে ভাল কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে বিশ্বাস থাকে না, পারস্পরিক আস্থা থাকে না। ফুটবল খেলায় সবাই যখন গোল দেয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন আসলে পুরো দলকেই গোল খেতে হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিন নিজের ভাইবোনের মধ্যে প্রতিযোগিতা, সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, আমাদের সন্তানদের ভেতর প্রতিযোগিতা, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা, বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। একটি বিয়েতে যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘এই বিয়েতে কে জিতল?’- কেমন শোনায় প্রশ্নটি? এখানে উভয়ই যদি না জিতে, তাহলে কেউই আসলে জিতল না; উভয়ই হারল। ৩. লুস/উইন আমাদের আশপাশে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়, যারা সারাক্ষণ নিজেকে ‘হেরে’ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে রাখে। তাদের ব্রেনে স্ক্রিপ্টটা এভাবে লেখা- -আমি হারলাম, তুমি জিত। -আমার বলার কিছু ছিল না, না গো ... -যাও, তোমার যেভাবে সুবিধা হয় কর... -আমাকে মারিয়ে যাও, সবাই তো তাই করছে। -আমি একজন হেরে যাওয়া মানুষ; আমি লুসার। -আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমি শান্তির জন্য সব করতে পারি। যাদের ব্রেনে সব সময় ‘লুস/উইন’ করার মানসিকতা চলতে থাকে, তারা আসলে ‘উইন/লুস’ করার মানসিকতার থেকেও খারাপ। অনেকেই ভাবতে পারেন, না আমি অন্যকে জিততে সাহায্য করি, তাতে খারাপের কি আছে? আমি মানুষের উপকার করি এবং নিজে হেরে গিয়ে অন্যকে জেতানোর মতো আনন্দে আপ্লুত হই। কিন্তু বিষয়টি অন্য জায়গায়। এই ধরনের মানুষের কোন মানদ- থাকে না। তাদের কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই। তাদের চাহিদা নেই, প্রত্যাশা নেই, ভিশন নেই। তারা অন্যকে খুশি করার জন্য যে কোন পর্যায়ে নামতে পারে। তারা সস্তা জনপ্রিয়তা কিংবা অন্য মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে পরিচালিত হয়। তাদের নিজের কোন ব্যক্তিত্ব থাকে না। নিজেকে প্রকাশ করার মতো সাহস এদের থাকে না। সমস্যা আরও আছে। যদিও এরা নিজে হেরে গিয়ে অন্যকে জিততে সাহায্য করে বলে দাবি করে থাকে, কিন্তু অবচেতন মনে তাদের সেই চাহিদা থেকেই যায়। অবচেতন মনের সেই চাওয়ার কখনই মৃত্যু হয় না। তারা বেঁচে থাকে; আর যখন সেগুলো ফিরে আসে তখন তা খুবই নোংরা একটা রূপ নেয়। এটা তখন একটি রোগে পরিণত হয়। আপনারা কেউ কি কখনও এমন কোন নারীকে দেখেছেন যিনি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সব কিছু মেনে নিয়ে অবহেলায় জীবনযাপন করেছেন? তারপর সামান্য কোন প্ররোচনায় সেই রাগের আগুন কিভাবে বাইরে বেরিয়ে এসেছে? সেই আগুনের তাপ কি দেখেছেন কেউ? উইন/লুস এবং লুস/উইন উভয়ের ভেতরই এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা থাকে। সাময়িকভাবে উইন/লুস মানুষের ফলাফল ভাল দেখা যায়, কারণ তারা দ্রুত ফলাফলে বিশ্বাস করে। চট করেই কিছু জিতে ফেলা, কিংবা অন্যকে ঠকিয়ে কোন কাজ হাসিল করে ফেলতে এদের জুড়ি নেই। তাই সাময়িকভাবে এদের অনেক উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। অপর পক্ষে লুস/উইন দলের মানুষরা দুর্বল এবং বিশৃঙ্খল হয়। অনেক এক্সিকিউটিভ, ম্যানেজার এমনকি মা-বাবারা প্রতিনিয়ত উইন/লুস আর লুস/উইনের দোলাচলে দুলতে থাকেন, অনেকটা ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো। তারা একবার উইন/লুসের দিকে যান, আরেকবার ধাক্কা খেয়ে লুস/উইনের দিকে চলে আসেন। পরে আবার অভিমানে, রাগে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আবার উইন/লুসের দিকে যেতে থাকেন। এভাবেই কেটে যায় তাদের সারাটা জীবন। ৪. লুস/লুস অনেকেই হয়ত ভাবছেন, এমন মানুষও কি এই পৃথিবীতে আছে যারা উভয়ের ক্ষতি চায়? কেউ কি এমনভাবে ভাবতে পারে যে, দুজনেরই এক সঙ্গে ক্ষতি হবে, আমি ডুবব, তোকে নিয়েও ডুবব? জি, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আমার নিজের দেখা একজন মানুষের কথা বলি। সম্প্রতি তাদের বিয়েবিচ্ছেদ হয়েছে। আমেরিকার কোর্ট ছেলেটিকে নির্দেশ দিয়েছে যে, তাদের সম্পত্তির অর্ধেক মেয়েটিকে দিতে হবে, আগামী পাঁচ বছর মেয়েটির ভরণ-পোষণের জন্য ছেলেটির মাসিক বেতনের অর্ধেক টাকা মেয়েটিকে দিতে হবে। ছেলেটি বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার, আমেরিকার খুব ভাল একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। তার বেতনও ছিল বেশ ভাল। কিন্তু সে একদিন সেই চাকরি ছেড়ে দিল। সে নিকটবর্তী শহরে গিয়ে একটি ভবনের দারোয়ানের চাকরি নিল, যেখানে তার থাকা-খাওয়া ফ্রি, আর বেতন খুবই সামান্য। মেয়েটিকে যেন কোন টাকা দিতে না হয়, সে জন্য সে ব্যাংকের মাধ্যমে বেতন নেয়া বন্ধ করে দিল। বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ক্যাশে বেতন নিত। তার স্ত্রীকে অর্ধেক দিতে হবে বলে নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, যে জীবন সে কখনই হয়ত কল্পনা করেনি। একেই হয়ত বলে, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা। এমন মানুষের সংখ্যা কি কম পাওয়া যাবে? ৫. শুধুই উইন আমাদের চারপাশে আরেক দল মানুষ আছে যারা শুধু নিজেরটা দেখতে পায় এবং সেটা অবশ্যই ‘উইন’; আর অপর পক্ষ জিতল নাকি হারল তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সে নিজে জিতেছে কি না, সেটাই মুখ্য বিষয়। অন্যরা কি পেল আর পেল না, তা নিয়ে তাদের চিন্তা নেই। সে নিজে যা চেয়েছে তা পেয়েছে কি না, সেটাই মুখ্য। এই ধরনের মানুষরা নিজেরটা বুঝে নিয়ে চুপ করে থাকে। তারা অন্যেরটা অন্যপক্ষ বুঝুক- সেটাই ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে। এরা ভাবে, যারটা সে বুঝে নিক, আমি কেন মাথা ঘামাব! ৬. উইন/উইন, নয়ত নো-ডিল অনেক সময় উইন/উইন মানসিকতা নিয়ে কোথাও গেলে, উল্টো পাশেও যে একই মানসিকতার লোকজন থাকবে তা কিন্তু নয়। আপনি চাইলে উভয়ের ভাল হোক, কিন্তু আপনার উল্টো দিকে বসে আছে একজন কট্টর উইন/লুস মানুষ; অর্থাৎ সে আপনাকে ঠকাবেই। সেক্ষেত্রে আপনাকে কম্প্রোমাইজ করা লাগতে পারে। অনেক সময় আমরা কম্প্রোমাইজ করে জীবন চালিয়ে নেই। কিছু মানুষ আছে যারা সেটা করবে না। তারা চাইবে একটি উইন/উইন অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য। যদি সেটা করা না যায়, সেক্ষেত্রে পুরো ডিলটাই বন্ধ করে দেবে; তারা কোন ডিলে যাবে না। এই দলের মানুষ খুব পরিষ্কার করে বলে দেবে, আমি কেবলমাত্র উইন/উইন অবস্থান ছাড়া সামনে এগুব না। আমি নিজে জিততে চাই এবং আমি চাই আপনিও জিতুন। আমি চাই, দুজনই এই থেকে জিতুন। নইলে কিছুদিন পর এই ডিলটা কাজ করবে না। আপনি নয়ত আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেলব। সেক্ষেত্রে এটা কারও জন্যই মঙ্গল হবে না। এমনকি পারিবারিক ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। ধরুন, এক সন্ধ্যায় আপনি আপনার মামাত-চাচাত ভাই-বোনদের নিয়ে ভিডিও দেখার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু একেকজন একেক কাজ করবে বলে ঠিক করল। কেউ ভিডিওতে এই ছবি দেখতে চায়, অন্যরা অন্য কিছু। আপনি চাইলে কিছু সংখ্যক মানুষকে নিয়ে পছন্দের একটি মুভি দেখতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি পুরো ভিডিও দেখার পরিকল্পনাটাই বাদ দিয়ে দেন, তাহলে সেটা হয়ত আরও ভাল হবে। সবাইকে যদি একটি উইন/উইন অবস্থানে আনা না যায়, সেক্ষেত্রে সেটা বাদ দেয়াটাও মন্দ নয়। কোন অপশনটা ভাল? আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশে আপনি যাদের সঙ্গে কাজ করতে যাবেন সেখানে উইন/লুস মানসিকতার মানুষ অনেক বেশি পাবেন। তারা যে কোন অবস্থাতেই জিততে চাইবে। আপনার দিকটা দেখবে না। আর আপনি নিজেও যদি উইন/লুস ধরনের হন, তাহলে তো বুঝতেই পারছেন অবস্থা। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব কম। তার মূল কারণই হলো, তারা উইন/লুস হিসাবে বিশ্বাস করে। তারা তাদের ক্রেতাদের ঠকাতে পর্যন্ত কুণ্ঠিত হয় না। বাংলাদেশের গ্রাহকরা ঠকবেন, সেটা মাথায় নিয়েই দোকানে যান। তারা কদাচিৎ কোন প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করেন। তাই এখানে বিগত ৪০ বছরে কয়টি প্রতিষ্ঠান আপনি দেখাতে পারবেন, যারা নিষ্ঠা এবং সততার সঙ্গে প্রকৃত উইন/উইন মেনে টিকে আছেন? এরা খুব স্বল্প সময়ে অনেক টাকার মালিক হয়ে তারপর মাঠ থেকে সরে যান। এটাই বাংলাদেশের ব্যবসার ধর্ম। একই প্রভাব পড়ে সামাজিক জীবনে, বন্ধুত্বে, পারিবারিক বন্ধনে। এ আলোচনা থেকে যদি এবারে জিজ্ঞেস করি, কোন পন্থাটি সেরা তাহলে আপনার উত্তর কী হবে? নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছেন, উত্তর সোজা- উইন/উইন। আসলে তা নয়। এটা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। যেমন, আপনি একটি ব্যবসা করছেন এবং বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপনাকে হয়ত উইন/লুস পদ্ধতি অনুসরণ করতে হতে পারে। কিন্তু নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতর কর্মীদের ভেতর যদি উইন/লুস প্রয়োগ করেন, কিংবা আপনার গ্রাহকের সঙ্গে- তাহলে আপনি দীর্ঘ মেয়াদে হেরে যাবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনাকে লুস/উইন অবস্থানে যেতে হতে পারে। যেমন ধরুন একটি সম্পর্কে জড়ালেন। অপর দিকের মানুষটিকে কমফোর্ট দেয়ার জন্য আপনাকে মাঝে মাঝে হারতে হতে পারে। তাতে তেমন কিছু আসে যায় না, যখন আপনি জানেন কেন কাজটি করছেন। তবে এসব বিবেচনা করলে, সাধারণ ক্ষেত্রে আপনি সব সময় উইন/উইন অবস্থানে থাকার চেষ্টা করুন। কিছু কর্নার কেস থাকবে। সেগুলোকে বিবেচনায় না এনে, দীর্ঘ মেয়াদী যদি লাভবান হতে চান, তাহলে উইন/উইন হবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান। তাতে আপনার সঙ্গে কাজ করতে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, আপনার সঙ্গে ব্যবসা করতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো পছন্দ করবে, আপনার ওপর মানুষ আস্থা রাখবে। কেউ এটা মনে করবে না যে, আপনার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তাকে ঠকতে হতে পারে। আমি বাংলাদেশে দেখেছি, কদাচিৎ কেউ উইন/উইন চিন্তা করে। আমার সঙ্গে যারাই উইন/লুস মোডে কাজ করতে এসেছেন, তাদের আমি একটিবার মাত্র সুযোগ দিয়েছি। তারপর তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে এবং এটা যে হবেই, সেটা লিখিত। তাই এখন থেকে আমি ‘উইন/উইন, নয়ত নো-ডিল’ মোডে চলে গেছি। অনেকেই আমাকে অনেক কিছু করতে বলেন। অনেকেই অনেক কিছু অফার করেন। যতক্ষণ না সেটা উভয়ের জন্য উইন/উইন ততক্ষণ আমি সেটাতে জড়াই না। এ জন্য অনেক সময় অনেক কাজ হয় না। তাতে সমস্যা নেই। আপাত দৃষ্টিতে সেটা হলো না, কিন্তু যদি সেটা হতো, সেই মানুষটির সঙ্গে পরবর্তী সময়ে গিয়ে ঝামেলা হতোই। কারণ সে হয়ত আমাকে ঠকিয়েছে, নয়ত আমি তাকে ঠকিয়েছি। এর কোনটাই কারও জন্য ভাল বয়ে আনতে পারে না। এখন থেকে যখনই কোন কাজে হাত দেবেন, মাথায় রাখবেন বিষয়টি সবার জন্য উইন/উইন হচ্ছে কিনা। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ys@pri“o.com
×