ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিক্রেতারা ক্রেতা টানতে পারছেন না

রাজধানীতে গরু বেশি আসায় দাম কমতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

রাজধানীতে গরু বেশি আসায় দাম  কমতে পারে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ একদিন বাকি মাত্র। দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। এ উৎসবের মূল অনুসঙ্গ পশু কোরবানি। আর তাই গরু-ছাগল, মহিষ ও উটসহ কোরবানির সব পশুর আগমনে জমে উঠতে শুরু করেছে রাজধানীর সব স্থায়ী ও অস্থায়ী হাট। কানায় কানায় পূর্ণ হাটগুলোতে পা ফেলার যেন জায়গা নেই। কোথাও কোথাও কাদায় ও গরুর বর্জ্যে মাখামাখি। শনিবার দিনের শুরুতে খুব বেশি ক্রেতার দেখা না মিললেও বিকেলে চোখে পড়েছে সেই চিরচেনা দৃশ্য। সন্ধ্যার পর নগরীর অধিকাংশ হাটেই ক্রেতার ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে বিক্রি নিয়ে খুব বেশি সন্তুষ্টির কথা শোনাতে পারলেন না বিক্রেতারা। বিক্রি বাড়াতে দেয়া হচ্ছে একটি বড় গরুর সঙ্গে ছোট গরু একদম ফ্রি। কোনটাতে দেয়া হচ্ছে ছাগল ফ্রি। তারপরও ক্রেতা টানতে পারছেন না বিক্রেতা। দাম বেশি বলেই ক্রেতা এখনও দরকষাকষিতে ঘুরপাক খাচ্ছেন। তারপরও ভাল বিক্রির আশা দেখছেন বেপারিরা। তবে এবার হাটে গরু বেশি আসায় দাম শেষ পর্যন্ত কমতির দিকে থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। দেশী গরুর সঙ্গে রাজধানীতে ভারতীয় গরু আসার খবর আসছে। তাই শেষ পর্যন্ত কোরবানির পশুর দাম কমবে না বাড়বে এটাই দেখার অপেক্ষায় নগরবাসী। জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্নস্থানে এবার ছোট-বড় মিলিয়ে ২৪টি পশুর হাট বসেছে। এ বছর কোরবানির হাটে ভারতীয় গরুর আধিপত্য কাটিয়ে দেশী গরুর জয়জয়কার। ছোট, মাঝারি, বড়সহ সব ধরনের দেশী গরু বাজারজুড়ে ছড়িয়ে আছে। ভারতীয় গরু আসবে না, সেজন্য গরুর দাম বেশি হবে এমন আশায় নিজ উদ্যোগে রাজধানীতে গরু নিয়ে এসেছেন অনেক খামারি। দেশের প্রতিটি মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিনই গরু আসছে। ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানের গরুও দেশে ঢুকছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজধানীর হাটগুলোতে যে পরিমাণ গরু আসছে, তাতে সঙ্কট তো হবেই না বরং প্রত্যাশার তুলনায় গরু বেশি। শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন পশুহাট ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ হাটেই গরু রাখার নির্দিষ্ট জায়গা পূরণ হয়ে গেছে। ফলে আশপাশের সড়ক ও খালি জায়গা দখল করছেন বেপারিরা। কোরবানির পশুতে ভরে গেছে সব হাট। তারপরও ট্রাকভর্তি গরু আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এছাড়া নদীপথে ট্রলারেও গরু-ছাগল ও মহিষ ঢুকছে রাজধানীতে। এদিকে এবার কোরবানির পশু বেশি ওঠায় ইজারাদাররা খুশি থাকলেও বেপারিরা স্বস্তিতে নেই। বরং আমদানি বেশি হওয়ায় তারা কিছুটা চিন্তিত। নগরীর কমলাপুর স্টেডিয়ামের পাশের মাঠ, খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া বাজার, সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ, মিরপুর সেকশন-৬ ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গা ও মহাখালীর কড়াইল এলাকার টিএ্যান্ডটি মাঠসংলগ্ন অস্থায়ী এবং গাবতলী অস্থীয় পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, কোরবানির পশুতে কানায় কানায় পূর্ণ। কোন কোন হাট নির্দিষ্ট সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অস্থায়ী হাট চলে এসেছে মূল সড়কে। গাবতলীর মূল হাট ছেড়ে ট্রাকস্ট্যান্ডসহ আশপাশের সড়কের পাশে গরু রাখা হয়েছে। গাবতলী হাটের প্রবেশমুখেই গরু বিক্রি করতে দেখা গেছে। রাজধানীর অন্যান্য অস্থায়ী হাটের সঙ্গে মিশে গেছে অবৈধ হাট। রাজধানীতে যেভাবে গরু আসছে তাতে অধিকাংশ হাট আরও সম্প্রসারিত হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। অধিকাংশ হাট পরিচালনা কমিটির সদস্যরা বলছেন, এ বছর বাজারের চরিত্র বোঝা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত গরুর দাম বেশি। কিন্তু যে হারে কোরবানির পশু রাজধানীতে আসছে তাতে শেষ পর্যন্ত দাম কিছুটা কমতির দিকে থাকতে পারে বলে তারা জানান। গাবতলী হাটে গিয়ে দেখা যায়, এ হাটে দেশী জাতের গরুর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তবে ভারতের রাজস্থান, অসম, তামিলনাড়ু ও হরিয়ানা থেকেও কিছু গরু এসেছে। এসেছে ভারতীয় উটও। এ হাটের পরিচালনা কমিটি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আজ রবিবার থেকে পুরোদমে জমে উঠবে বেচাকেনা। চলবে ঈদের আগের রাত অর্থাৎ সোমবার পর্যন্ত। গরুর বেপারিরা বলছেন, এবার ভারত থেকে কোরবানির পশু আমদানি কম হলেও দেশী গরু এসেছে অনেক। হাটে প্রচুর পরিমাণে কোরবানির পশু এসেছে। হাটে ক্রেতার সংখ্যা বেশি হলেও বিক্রি এখনও আশানুুরূপ বাড়েনি। গাবতলী হাটে পাবনা থেকে ১৬টি গরু নিয়ে এসেছেন মনির হোসেন। স্বাস্থ্যবান একটি গরুর দাম চাচ্ছেন দেড় লাখ টাকা। কিন্তু ক্রেতা বলছেন ৮৫ হাজার টাকা। ১ লাখ টাকার নিচে বিক্রি করতে রাজি নন তিনি। মনির এ প্রতিবেদককে বলেন, এলাকা থেকে ৯০ হাজার টাকা দিয়ে গরুটি কিনে এনেছি। ঢাকায় আনতে ট্রাক ভাড়া গরু প্রতি তিন হাজার টাকা। আর বাড়িতে ১৫ দিন ও ঢাকায় কয়েক দিন রেখে আরও দুই হাজার টাকা খরচ। লাভ করতে অন্তত লাখের ওপর বেচতে হবে। কিন্তু ক্রেতা দাম বলছেন অনেক কম। গত তিন বছর লস হয়েছে। এবার সেটা পুষিয়ে নেয়ার আশা করছেন এ বিক্রেতা। তবে বিক্রেতা বলছেন, দাম চাওয়া হচ্ছে অনেক বেশি। কোনভাবেই দাম কমাচ্ছেন না বেপারিরা। তাই অপেক্ষায় আছি শেষ পর্যন্ত গরুর দাম কমে কিনা! এ হাটে গরু বিক্রি করতে আসা কুষ্টিয়ার বেপারি জুয়েল মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, এবার তিনি ৮টি গরু নিয়ে এসেছেন। প্রতিটি গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা। ইতোমধ্যে একটি গরু ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। বাকিগুলো কম দামে বিক্রি করতে রাজি নন তিনি। এ বছর গরুর দাম বেশি হওয়ায় একটি মাঝারি সাইজের গরু কিনতে ক্রেতাকে গুণতে হচ্ছে প্রায় ৭০-৮০ হাজার টাকা। তবে মোটাতাজা একটি গরুর দাম প্রকারভেদে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা হাঁকাচ্ছেন বেপারিরা। এরমধ্যে সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান গরুর দাম ৫ থেকে ১২ লাখ টাকা চাইছেন বিক্রেতা। আমিন উদ্দিন নামের এক ক্রেতা জনকণ্ঠকে জানান, কোন গরুর দাম ৭০ হাজার টাকা হলেও দ্বিগুণ টাকা চাইছেন বেপরিরা। শ্যামলী এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন বড় আকারের দুটি গরু কেনেন ৬ লাখ টাকা দিয়ে। গাবতলী হাটে ছাগলের বিক্রিও হচ্ছে যথেষ্ট। ৮ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা দামের ছাগল পাওয়া যাচ্ছে এ হাটে। গাবতলী পশুর হাট ঘুরে দেখা মেলে নানান অফার। বিক্রেতা তরিকুল জানান, দরদামে পোষালে গরুর সঙ্গে এই খাসি ফ্রি দেয়া হবে। গরুর দাম হাঁকানো হচ্ছে ৫ লাখ টাকা। তরিকুলের টার্গেট সাড়ে ৩ লাখ হলেই গরু ছেড়ে দেবেন। সঙ্গে ২৫ হাজার টাকার ওই খাসি। নয় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাজধানীর অন্যতম বড় কোরবানির গরুর হাট বাড্ডার আফতাবনগর। এ হাটে সবচেয়ে বড় গরুটির দাম হাঁকা হয়েছে ১৬ লাখ টাকা। ১৬ লাখ টাকার দাম হাঁকা গরুটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান এ বি এ্যাগ্রোফার্ম। প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, ভাষানটেক এলাকায় তাদের গরুর খামার। গরুটি সেখানে লালনপালন করা হয়েছে। আমরা গরুটির দাম চেয়েছি ১৬ লাখ টাকা। আশা করি, এ দামেই গরুটি বিক্রি হবে। এটি ছাড়াও এই ফার্মের আরও ২২টি গরু তোলা হয়েছে। জহিরুল বলছেন, তাদের ফার্মের কোন গরুর দাম পাঁচ লাখ টাকার নিচে নয়। ১৬ লাখ টাকা দাম চাওয়া গরুটি ছাড়াও হাটে বড় বড় অনেক গরু আনা হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন এ্যাগ্রোফার্ম প্রতিষ্ঠান এসব গরু হাটে তুলেছে। এ ছাড়া টাঙ্গাইল, পাবনা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ থেকে বেপারিরা বেশ বড়সড় গরু বাজারে এনেছেন। রাজধানীর অন্যান্য গরুর হাট থেকে আফতাবনগর হাট একেবারই আলাদা। রাস্তার দুই ধারে আছে কাশবন। মাঝখানে গাছের সারি। রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে গরু রাখা হয়েছে। আফতাবনগর গরু হাটের সার্বিক সহযোগিতায় থাকা এস এম তোফাজ্জল হোসেন দাবি করেন, রাজধানীর সবচেয়ে বড় হাট এটি। এই হাটে প্রতিবছর ৫০ হাজার গরু আসে। এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার গরু এসেছে। গরু কম হওয়ার কারণে বেপারিরা এখন পর্যন্ত বেশি দাম হাঁকাচ্ছেন। এমনকি বাজারে ভারতীয় গরু আসেনি তেমন। শেষ পর্যন্ত গরু যদি হাটে না আসে, তাহলে এবার গরুর বাজার চড়া হবে।
×