ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পণ্য চলাচল ব্যবস্থা গড়ে উঠলে এশিয়ার দেশগুলো যৌথ বাজারে পরিণত হবে

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পণ্য চলাচল ব্যবস্থা গড়ে উঠলে এশিয়ার দেশগুলো যৌথ বাজারে পরিণত হবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পণ্য চলাচল ব্যবস্থার উপযুক্ত পরিকাঠামোর প্রয়োজন ও সম্ভাবনাগুলো নিয়ে ভারত, চীনসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের একাধিক দেশ এখন আগ্রহী। চীন ইতোমধ্যেই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নীতি ঘোষণা করেছে, যার মাধ্যমে চীন, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। এ জন্য চীন ৪৬০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে রেলপথ, সড়কপথ তৈরি করছে। অন্যদিকে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিভিন্ন দেশে নৌবন্দর তৈরি করছে। এভাবে ওই দেশগুলোর সঙ্গে সুসংহত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ার চেষ্টা করছে চীন। অন্যদিকে, ভারতও ইরানের চাবাহার বন্দর তৈরি করে দেয়ার জন্য সম্প্রতি সে দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে। সেখান থেকে সড়ক ও রেলপথে আফগানিস্্তান ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ হয়ে রাশিয়া পর্যন্ত বাণিজ্যের নতুন পথ তৈরি করার ভাবনা রয়েছে। এর সঙ্গে পূর্ব ভারতের দিক থেকে কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ, চীন, মিয়ানমারের মধ্যে সুসংহত পণ্য চলাচল ব্যবস্থা গড়ে উঠলে এশিয়ার বেশিরভাগ দেশই এক যৌথ বাজারে পরিণত হতে পারে। একই সঙ্গে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একগুচ্ছ আধুনিক বন্দর গড়ে ওঠায় সড়ক ও রেলপথের সঙ্গে নৌবাণিজ্য সহজেই যুক্ত হতে পারবে। আর সেক্ষেত্রেও ভারত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের কেন্দ্র হয়ে থাকবে। যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক লেনদেনের এই বিপুল সম্ভাবনার মানচিত্রে কলকাতার অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতার এই গুরুত্ব শুধু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য নয়, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রেও কলকাতা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হওয়ার দাবিদার। যার ইঙ্গিত মেলে কলকাতা ও চীনের কুংমিং শহরের মধ্যে সরাসরি পণ্য চলাচলের জন্য কয়েক হাজার কিলোমিটার সড়কপথ তৈরির চীনা প্রস্তাব থেকে। ভারত ও চীনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রাথমিক শর্তই হলো সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথে পণ্য চলাচলের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা। আশা করা হচ্ছে, এসব যোগাযোগের পথ যেসব মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে যাবে, সেসব এলাকার মানুষজনও এই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুফল ভোগ করবেন। এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী এবং ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ (সিআরজি)-এর ইনস্টিটিউট প্রফেসর রণবীর সমাদ্দার। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যসম্পর্ক দৃঢ় করতে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি রোজা লুক্সেমবুর্গ শিফটুং-এর সহযোগিতায় সিআরজি একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। এই আলোচনায় প্রধান বক্তা হিসেবে অংশ নিয়ে সিআরজির অধ্যাপক রণবীর সমাদ্দার মনে করিয়ে দেন, এই বিপুল পরিকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারী মহলে এবং বেসরকারী মহলে নানা স্তরে আলোচনা চলছে। কিন্তু যে শ্রমিকবাহিনীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই বিপুল পরিকাঠামো নির্মাণ হয়ে থাকে, সরকারের কোন নীতি সংক্রান্ত নথিতেই সেই শ্রমিকদের সম্পর্কে কোন চিন্তাভাবনার প্রতিফলন নেই। অধ্যাপক সমাদ্দারের মন্তব্য, এভাবে বিশ্বায়নের যুগে নগরায়ন ও পরিকাঠামো নির্মাণে শ্রমিকদের ব্যবহার করা হলেও তাদের সম্পর্কে সরকারী নীতি অস্পষ্টই থেকে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই বিপুল কর্মযজ্ঞে শ্রমিকরা যে এক গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক অংশ, সেই তথ্যটাই সচেতনভাবে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় চতুর্বেদী মনে করেন, গোটা বিষয়টিকে আরও সতর্কভাবে পরীক্ষা করা দরকার। টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস (টিআইএসএস), গুয়াহাটির অধ্যাপক সঞ্জয় বরবরা অসমে তার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে বলেন, শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিকাঠামোর কথা ভাবলেই হবে না। সেই সঙ্গে ওই সব এলাকায় বসবাসকারী বিভিন্ন জনজাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষজন যাতে নিজেদের মধ্যেই সংঘাতে জড়িয়ে না পড়েন, সে কথাও রাষ্ট্র ও বৃহত্তর সমাজকে মাথায় রাখতে হবে। এই তিনজন ছাড়াও আরও কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলোচনাসভায় অংশ নিয়ে গোটা বিষয়টির বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করেন। বিশ্বায়নের যুগে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি করে বাণিজ্যিক লেনদেন হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে পণ্য চলাচলের রাস্তা সহজ করতে মাসুলের বেড়া কিছুটা নমনীয় করার ফলে আন্তর্জাতিক পুঁজি এখন এশিয়ার দেশগুলোতে সহজে যাতায়াত করতে পারবে। চীন ইতোমধ্যেই এশিয়ার দেশগুলোর বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্রুত পণ্য চলাচলের জন্য উন্নত পরিকাঠামো তৈরি করা ও বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মাসুল ইত্যাদির বাধা কমিয়ে যোগাযোগ বাড়ানোর ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গেই পুরনো স্পাইস রুট, কটন রুট ইত্যাদির ইতিহাস খতিয়ে দেখে নতুন ভাবনায় সেগুলো নতুন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সিল্ক রুটের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে এর সবটাই যে খুব মসৃণভাবে হচ্ছে, তা নয়। এ নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে এখনও বেশ কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তা সত্ত্বেও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে আর্থিক ও বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য আরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্ব কোন দেশই অস্বীকার করতে পারছে না।
×