ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুদ্রাক্ষ রহমান

একটা ভাল কাজ

প্রকাশিত: ০৭:১০, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

একটা ভাল কাজ

ভাদ্র মাসের বিকেল বেলা। সারাদিন ঘাম ঝরানো গরম ছিল সকাল থেকে। বিকেল হতেই দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস জোরে বইতে শুরু করল। হঠাৎ কালো হয়ে গেল পুরো আকাশ। এলোমেলো বাতাসের সঙ্গে শুরু হলো দাপুটে বৃষ্টি। স্কুলের বড় মাঠের পশ্চিম কোণায় যে পাকুর গাছটা, তার নিচে বসে জমাটি আড্ডা করছিল রতন আর সবুজ। বাতাসটা ভালই ছিল। বৃষ্টিটাই প- করে দিল সেই বিকেলের আড্ডাটা। তবে জমে যাওয়া আড্ডাতো আর মুলতবি রাখা যায় না; তাই মাঠ থেকে দৌড়ে গিয়ে স্কুলের বারান্দায় আশ্রয় নিল ওরা। দুই বন্ধু। দুজনেই নবম শ্রেণী। দুজনেই ভাল পড়াশোনায়। আর ভাল আঁকায়। আর ভাল গানে। আর ভাল বিতর্কে। গ্রামের একটা স্কুল, তারপরও পড়াশোনার সঙ্গে নিয়ম করে এসব হয়। স্কুলের নাম মালিকান্দা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। পদ্মা নদীর তীরের এই স্কুলের হেড মাস্টারের নাম জগদীশ বিশ^াস। তিনি বিশ^াস করেন পড়াশোনার সঙ্গে সংস্কৃতির চর্চা না থাকলে একজন ছাত্র প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। সেই শিক্ষকের ছাত্র রতন আর সবুজ, ভাদ্র মাসের বৃষ্টিনামা বিকেলবেলায় স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছিল, আসছে ঈদের ছুটিতে কী কী করা যায়, তা নিয়ে। রতনদের বাড়ি স্কুলের পাশেই। সবুজদের বাড়ি, তাও কাছে, খালের ওপারে। প্রতিদিন বিকেলে অন্যদের সঙ্গে মাঠে ফুটবল অথবা দারিয়াবান্দা খেলে ওরা। আর খেলা না হলে দুজনে মিলে গল্প করে। সন্ধ্যা নামার আগেই যে যার বাড়ির দিকে পা বাড়ায় তবে সেদিনের বিকেলের পরিণতি ভাবতে পারছিল না ওরা। অনেক, অনেক দিন এমন বৃষ্টি নামেনি ওদের গ্রামে। বৃষ্টি কখন থামবে তাও ছিল অনিশ্চিত। ছুটি হতে বাকি দুদিন। তারপর কথাটা শেষ করে না রতন। সবুজ প্রশ্নবোধক চাহুনি দিয়ে তাকায় রতনের দিকে। তারপর বলতে থাকে এত দিনের ছুটি, কিছু তো একটা করতেই হবে। করতে হবেই, জোর দিয়ে বলে রতন। কিন্তু কী করব সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না। হেড স্যার বলেছেন, ছুটিটা কেবল খেয়ে- দেয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিস না। একটা কিছু করিস তোরা। অন্তত একটা ভাল কাজ; যে কাজটা তোরা বড় হয়ে যখন মনে পড়লে গর্বে, আনন্দে বুক ভরে যাবে। সেই রকম ভাল কাজ কী? সবুজ প্রশ্ন করে। নিশ্চয়ই আছে, নইলে স্যার অমন করে বললেন কেন? ধর, এবার ঈদে আমরা নতুন কোন জামা নিলাম না। সেই টাকাটা মা-বাবকে বলে একটা ভাল কাজে লাগালাম। কথা শেষ করে রতন। কিন্তু সেই ভাল কাজটা কী? সবুজ একটু গলা চড়ায়। আমি কী জানি; চল আমরা ভেবে বের করি। এই বলে রতন তাকায় সবুজের দিকে। আর নিতান্তই যদি না পারি বের করতে, তাহলে কাল হেড স্যারের কাছে একটা উপায় জেনে নেব। দুই বন্ধু যখন একটা ভাল কাজ খুঁজে পাচ্ছিল না, ঠিক তখন বৃষ্টিটা ধরে আসছিল। কিন্তু বাতাসের দাপট তখনি কমেনি। এমন সময় ওদেরই বয়সী একটা ছেলে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে এসে দাঁড়াল স্কুলের বারান্দায়। ছেলেটার অবস্থা দেখে ওদের কেমন একটু মায়া হলো। ছেলেটা যে এই গ্রামের না তা বুঝে নিল দুজনে। সবুজ আগ বারিয়ে ছেলেটার কাছে জানতে চাইল তার বাড়ি কোথায়। ছেলেটা কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিল পদ্মারচরে। তারপর কথায় কথায় বলে দিল সবুজ-রতনের মতো সে স্কুলে যায় না। ওর বাবা নেই। ছনের ঘর। সেই ঘরে বৃষ্টির পানি পড়ে। ঘরে মা আছে, ছোট একটা বোন আছে। ওদের ঘরে খুব অভাব। ছেলেটার কথা শুনে ভীষণ মন খারাপ হলো ওদের। ওরা কিছুতেই ভেবে পেল না ছেলেটার জীবন এমন কেন? রতনের বাবা গ্রামের বড় কৃষক। সবুজের বাবা দেশের বাইরে বড় চাকরি করেন। এই ছেলেটার বাবা কেন এমন হলেন না, তিনি কেন নেই তা ভেবে পায় না ওরা। তবে এইটুকু বুঝতে পারে ছেলেটার জন্য কিছু করতে পারলে ভাল হয়। ॥ দুই ॥ স্কুল ছুটির পর রতন আর সবুজ ঢুকল হেড স্যারের রুমে। ওরা দুদিন ধরে যে একটা ভাল কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে সে কথা বলল স্যারকে। হেড স্যার ওদের কথা শুনছেন আর মাঝে মাঝে চোখ রাখছেন ‘ছিন্ন পত্রাবলী’র পাতায়। এ এক ভীষণ অভ্যাস হেড স্যারের, সব সময় হাতের কাছে রাখবেন বইটি। আর বলবেন, এ এক অমূল্য সম্পদ। তো স্যারকে কথায় কথায় আগের দিন বিকেলের সেই বৃষ্টিভেজা ছেলেটার কথাও বলল ওরা। সব শুনে, স্মিত হেসে হেড স্যার বললেন, ছুিটতে ভাল কাজ খুঁজছিস? সেই অভাবী ছেলেটাকে খুঁজে বের কর। ওদের ঘরে যা। দেখ যদি একটু অভাবও দূর করতে পারিস সেটাই হবে বড় একটা ভাল কাজ।
×