ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইউরোপে মুসলিম ব্রাদারহুড

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ইউরোপে মুসলিম ব্রাদারহুড

(শেষাংশ) একদল রাজনৈতিক নির্বাসিত ব্যক্তি ও ব্রাদারহুড ছাত্রনেতা ১৯৭৯ সালে ফ্রান্সে মুসলিম স্টুডেন্টস এ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ইসলামিক গ্রুপ ইন ফ্রান্স গঠন করে, যা ১৯৮৩ সালে ‘ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন ইন ফ্রান্স’-এ পরিণত হয়। গান্নুচি সংগঠনটির কাঠামোর রাজনৈতিক কৌশল ও আদর্শ নির্ধারণ করে একে ফ্রান্সে ব্রাদারহুডের একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভ পরিণত করেন যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত। ১৯৯০-এর দশকের প্রথমদিকে ফ্রান্স, জার্মানি ও আরও কিছু ইউরোপীয় দেশে সালাফি- ব্রাদারহুড কুশীলবদের নিয়ে আলজিরিয়ান ইমলামিক স্যালতেশন ফ্রন্টের পরিষদ গঠন করা হয়। আন্তর্জাতিক ব্রাদারহুডের মতো একই আদর্শ অবলম্বন করে ফ্রান্সে আলজিরিয়ান মুসলিম ব্রাদারহুড এ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই সময় ব্রাদারহুড আরববহির্ভূত ইসলামী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা গভীরতর করে তোলে। বিশেষ করে সেটা করা হয় মিল্লি গোরাস নামে একটি তুর্র্কী সংগঠনের সঙ্গে। ১৯৭০-এর দশকে টার্কিস ওয়েলফেয়ার পার্র্টি ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই মিল্লি গোরাস জার্মানিকে তার তৎপরতার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয়। ব্রাদারহুড পাকিস্তানী ইসলামপন্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী যুক্তরাজ্যভিত্তিক পাকিস্তানী ইসলামিক গ্রুপের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করে তোলে। গ্রুপটি ১৯৫০-এর দশক থেকে সেখানে তৎপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসলামী তাত্ত্বিক সাইদ কুতুব ও আবুল আলা আল মওদুদী এ গ্রুপটির সঙ্গে ব্রাদারহুডের আদর্শিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে মুসলিম ব্রাদারহুড ইউরোপের কিছু রাজধানীতে তার প্রাতিষ্ঠানিক রিজার্ভের ওপর ভিত্তি করে নিজের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক ইসলামী আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়; যার উদ্দেশ্য ছিল আরব শাসকদের বিরোধিতা করা। তা করতে গিয়ে ইউরোপে ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক ভূগোল তার রাজনৈতিক ও প্রচারমূলক তৎপরতার চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রুপের হার্ডকোর অংশের ওপর, বিশেষ করে তিন প্রধান ইউরোপীয় দেশ ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে সক্রিয় ফেডারেশন এবং সমিতিগুলোর ওপর নির্ভর করেছিল। যুক্তরাজ্যে ব্রাদারহুডের ওই ফেডারেশন ও সমিতিগুলো একের পর এক মিসরীয় সরকারের বিরোধিতায় সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ব্রাদারহুড মিউনিখ মসজিদ থেকে জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এ ক্ষেত্রে তার তিন প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ারের ওপর নির্ভর করেছিল। সেগুলো হলো এক. জার্মানির সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব মুসলিমস। দুই. জার্মান মুসলমানদের কণ্ঠস্বর আইজিডি যা সারাদেশে প্রায় ৬০টি ইসলামী কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর নেতৃত্বে রয়েছে মিসরীয় ব্রাদারহুডের নেতা ইব্রাহিম আল-জায়াত যিনি মিল্লি গোরাসের নেতা সাবরি ইরবাকানের জামাতা। তিন. খোদ মিল্লি গোরাস যা জার্মানির তুর্কী সম্প্রদায়ের এক বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মিল্লি গোরাসের ইসলামী মতাদর্শ হচ্ছে রাজনৈতিক ইসলামের তুর্কী প্রভাবিত সংস্করণ এবং তুর্কী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। সম্প্রতি এক নতুন সমিতিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব মুসলিমস্ ইন জার্মানি (জেডএমডি) নামে ওই সংগঠনটি মিল্লি গোরাস এবং ব্রাদারহুডের অঙ্গসংস্থা আইজিডির মধ্যকার ঐক্যের প্রতিনিধিত্বকারী। ফ্রান্সে ‘ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন্স ইন ফ্রান্স’ উত্তর আফ্রিকার ব্রাদারহুড ক্যাডারদের বিশেষত তিউনিসীয়দের কাজে লাগিয়ে আড়াই শ’রও বেশি মসজিদ ও ইসলামী সমিতিকে নিজ ছত্রছায়ায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে সংস্থাটি ফ্রান্সের অনেক নগরী ও আশপাশের শহরতলিতে ফরাসী মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য অংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়েছে। পরিণতিতে একের পর এক নির্বাচনে ফরাসী মুসলমানদের প্রতিনিধি পরিষদে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। সালাফি ভাবাদর্শের বিরোধিতা করার জন্য ফেডারেশন সদস্যদের ফরাসী সদস্যদের সঙ্গে অতি চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। এর ফলে অগণিত ফরাসী নগরীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম ভোটারদের ওপর নিজ প্রভাবের কারণে সংস্থাটি স্থানীয় ও আইন পরিষদের নির্বাচনী প্রচার কাজে ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৈচিত্র্যকরণ করার চেষ্টায় ‘ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন্স ইন ফ্রান্স’ সে দেশে ইসলামী এলিট শ্রেণী গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত স্কুল কিমদি, বাজি ও ইবনে রুশদ্্। ২০১২ সালের উপাত্ত অনুযায়ী ফ্রান্সের দশটি ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটিই হলো ফেডারেশনের। ফ্রান্সের ব্রাদারহুড তার সঙ্গে মতাদর্শগতভাবে যুক্ত আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড স্টাডিজ অব ইসলাম, দি ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান সায়েন্সেস (ইউরোপের ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র), ইনস্টিটিউট ফর ইসলামিক ‘ওয়ার্ল্ড স্টাডিজ, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউট ফর ইসলামিক থট-এর ফরাসী শাখা, আল-শাতবি সেন্টার এবং উত্তর ফ্রান্সের খিলে নগরীতে ইমাম প্রশিক্ষণের জন্য ২০০৬ সালে কাতারের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত ইবনে সিনা ইনস্টিটিউট। তা ছাড়া ‘ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন্স ইন ফ্রান্স’-এর নেতৃবৃন্দের মালিকানাধীন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের হালাল মাংসের বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং বেশকিছু আরব উপসাগরীয় দেশে মাংস রফতানির ওপর একাধিপত্য কার্যকর করে আছে। জার্মানি ও ফ্রান্সে যা হয়েছিল যুক্তরাজ্যের বেলায় তা হয়নি। সেখানে মুসলিম ব্রাদার হুড প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রদূত ছিল না। তাদের আগে এই ভূমিকায় ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক ইসলামের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন পাকিস্তানী ইসলামিক গ্রুপ। সংগঠনটি সেই ১৯৫০-এর দশক থেকে ব্রিটেনে সক্রিয়। অবশ্য আরব মুসলিম ব্রাদারহুডের অঙ্গ সংগঠনগুলো ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাজ্য তাদের কর্মকা-ের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে কামাল আল-হেলবারির নেতৃত্বে সে দেশে মুসলিম এ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটেন গঠন করে। উদ্দেশ্য, ব্রিটিশ মুসলমানদের আনুষ্ঠানিক মুখপাত্রে পরিণত হওয়া এবং সে সব আরব ও ইসলামী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ব্রাদারহুডের সংঘর্ষ বা সংঘাত হয়েছে ব্রিটিশ নীতিনির্ধারক ও জনমতকে প্রভাবিত করে তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করা। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সংগঠনটি ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বে ইরাক হামলার বিরুদ্ধে এমপি জর্জ গ্যালোওয়েকে ব্রিটিশ কণ্ঠ হিসেবে ব্যবহার করে। ২০০২ সালে লন্ডনে ফিলিস্তিনী সংগ্রামের প্রতি সমর্থনে আয়োজিত বিপুল লোকের এক বিক্ষোভে তাকে ফিলিস্তিনীদের অধিকারের একজন প্রবক্তা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। সংগঠনটি ব্রিটেনের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য ও মৈত্রীও গড়ে তোলে। যেমন লন্ডনের সাবেক মেয়র কেন লিভিংস্টোনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যুক্তরাজ্যে ব্রাদারহুড বিভিন্ন জাতির পটভূমি থেকে আসা ক্যাডারদের পরিচালিত কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে তাদের তৎপরতা চালাত। তবে এই ক্যাডাররা সবাই ছিল মিসর, ইরাক, জর্দান ও ফিলিস্তিনের মতো দেশগুলো থেকে আগত যারা আগে ছিল ব্রিটিশ প্রভাবের অধীন। মুসলিম এ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটেন ছাড়াও এসব সংগঠনের মধ্যে ছিল মুসলিম ওয়েলফেয়ার, ইন্টারপোল (মার্কিন অর্থ দফতরের অভিযোগ এই সংগঠনটি সন্ত্রাসবাদের কাজে অর্থায়ন করে), প্যালেস্টাইনিয়ান রিটার্ন সেন্টার, দি মাশরিক সেন্টার ফর মিডিয়া সার্ভিসেস এবং দি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল স্টাডিজ ইন লন্ডন। যুক্তরাজ্য মিসরীয় ব্রাদারহুড সদস্যদের একটা প্লাটফর্মও বটে। সেখান থেকে একের পর এক ক্ষমতায় আসা মিসরীয় সরকারের বিরুদ্ধে শাণিত সমালোচনা চালানো হয়েছে। যেমন- ইশাম আল-হাদ্দাদ লন্ডনে ইসলামিক রিলিফ নামে একটি কেন্দ্র স্থাপন করেন যার শাখা সারা বিশ্বেই আছে। অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির উপদেষ্টা খালেদ আল কাজ্জাকের ভগ্নি মাহা আল-কাজ্জাক ছিলেন ব্রিটেনে ব্রাদারহুডের সাবেক মুখপাত্র। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ইশামের পুত্র আবদুল্লাহ আল-হাদ্দাদ যিনি ১৯৯৩ সালে ব্রাদারহুড সদস্য মোহাম্মদ গানেমের প্রতিষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড মিডিয়া সেন্টারে কাজ করেন এবং ইখওয়ান ওয়েব নামে এক ওয়েবসাইট চালান। যুক্তরাজ্যে মিসরীয় ব্রাদারহুড নেতাদের ‘ইজিপশিয়ান ফর ডেমোক্রেসি’ নামক সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সংগঠনটি চালান এরদোগানপন্থী ‘ইজিপশিয়ান রেভ্যুলিউশনারি কাউন্সিলের প্রধান মাহা আজ্জাম। ওই সংগঠনে ব্রাদারহুডের বাইরের ক্যাডাররাও আছেন। অবশ্য সংগঠনটি দুর্বল এবং এরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যেসব ক্রিয়াকলাপের আয়োজন করে তাতে তেমন একটা লোকসমাগম হয় না। এ ছাড়াও আছে লর্ড কেন ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে পরিচালিত ল’ ফার্ম যা ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এবং কয়েকটি ইউরোপীয় রাজধানীতে মিসর সরকারের বিরুদ্ধে লবিং করে থাকে। যুক্তরাজ্যে ব্রাদারহুড নেতারা শুধু লন্ডনেই ১৩টি সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এগুলো তিন মিসরীয় নেতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় যথা : ইশাম আল-হাদ্দাদ, ইব্রাহিম মুনীর ও ইব্রাহিম আল-জামাত যিনি আগে ছিলেন আইজিডির প্রধান। এই সংগঠনগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এবং বিশেষ করে বস্ত্র কারখানায় বিনিয়োগের জন্যে যুক্তরাজ্যের বাইরে থেকে তহবিল স্থানান্তর করে। মিসরীয় ব্রাদারহুড নেতাদের ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যা-ে অসংখ্য কোম্পানি আছে যেগুলো এই সংগঠনের ক্রিয়াকলাপের পেছনে অর্থ যোগায়। আনুভূমিক প্রসার ইসলামী তাত্ত্বিক ইউসেফ আল-কারাদাবির ১৯৯০ সালের গ্রন্থ ‘দি প্রায়োরিটিস ফর দ্য ইসলামিক মুভমেন্টস্ ইন দ্য কামিং ফেজ’ ১৯৯০ দশকের গোড়ার দিক থেকে পাশ্চাত্যে ব্রাদারহুড আন্দোলনগুলোর কাছে এক ধরনের সংবিধান হিসেবে কাজ করেছে। আল-কারাদাবি উগ্রবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে একটা মাঝামাঝি পথ গড়ে তোলার জন্য সহিংসতা পরিত্যাগ এবং প্রচার, সংলাপ ও অন্যান্য শান্তিপূর্ণ মাধ্যম কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো পাশ্চাত্যের মুসলমানদের অবস্থা পশ্চিমী দেশগুলোতে অধিকহারে অভিবাসনের কারণে পাশ্চাত্য মুসলিম জনসংখ্যার প্রত্যাশিত বৃদ্ধি এবং এসব পশ্চিমী সমাজে মুসলমান সংখ্যালঘুদের আত্তীকরণের বিপদ নিয়ে তার আলোচনা। এরই আলোকে আল-কারাদাবি পাশ্চাত্য মুসলমানদের এক পৃথক জনগোষ্ঠীর ধারণাটি তুলে ধরেন এবং সেই জনগোষ্ঠীকে পাশ্চাত্যের ‘বঞ্চিত মুসলিম সংখ্যালঘু’ নামে আখ্যায়িত করেন। পাশ্চাত্যে আল-কারাদাবির ব্রাদারহুড সংবিধান একটা রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে কাজ করেছে যার লক্ষ্য হচ্ছে ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপের প্রধান দেশগুলোতে সংগঠনটি তার বিভিন্ন ফেডারেশন ও জাতীয় পর্যায়ের সংস্থার মাধ্যমে রিজার্ভ গড়ে তোলা। ১৯৮৯ সালে ব্রাদারহুড ইউরোপে ‘ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন্স’ প্রতিষ্ঠা করে ইউরোপ মহাদেশে তার উল্লম্ব সম্প্রসারণের নিউক্লিয়াস স্থাপন করে। এর অস্থায়ী সদর দফতর হয় যুক্তরাজ্য। এই ফেডারেশন হলো ইউরোপজুড়ে ব্রাদারহুড এবং ব্রাদারহুড দরদী সকল সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও সমিতির সামনের চেহারা বা কাঠামো। ব্রাদারহুডের কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে ফেডারেশন একটা রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা চালায়। যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রাধান্য লাভ করে। ফেডারেশন জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর অনুরূপ কয়েকটি সাবসিডিয়ারি সংস্থা গড়ে তুলেছে। যেমন, ইউরোপিয়ান ট্রাস্ট যা ব্রাদারহুড সমিতিগুলোর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। তা ছাড়া আছে ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান সায়েন্সেস। এটি ফ্রান্সভিত্তিক তবে শাখা আছে যুক্তরাজ্যে। এটি প্রতিবছর প্রায় দু’ শ’ ইমাম ও ধর্মপ্রচারককে ট্রেনিং দেয়। ট্রেনিং পেয়ে এরা ইউরোপের ব্রাদারহুড সম্পর্কিত মসজিদগুলোতে ইমামতি করতে যায়। ১৯৯৬ সালে ফেডারেশন ইউরোপের মুসলমান যুব সমাজের বক্তব্য তুলে ধরার লক্ষ্যে উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থায়নে ইউরোপিয়ান ইয়ুথ ফোরাম ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। ফোরামে রয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে অঙ্গ সংগঠনরূপে স্বীকৃত ৩৭টি সমিতি। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় কমিশন ফোরামের প্রতিনিধি আছে। ইউরোপীয় কমিশন এমন বেশ কিছু সমিতির কর্মকা-ে অর্থায়ন করে। ২০০৬ সালে ফেডারেশন ব্রাসেলসে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, গ্রীস ও বসনিয়ার ১৪টি সংগঠন সমন্বয়ে ইউরোপিয়ান ফোরাম ফর মুসলিম উইমেন প্রতিষ্ঠা করে। ইউরোপে ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন্সের ছত্রছায়ায় সংগঠনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ফেডারেশন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছাকাছি থাকার জন্য ১৯৯৭ সালে তার সদর দফতর ব্রাসেলসে সরিয়ে নেয়। তার ফলে ফেডারেশনের পক্ষে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফিলিস্তিন, ইরাক ও কাশ্মীরের মতো ইসলামী ইস্যুগুলোতে লবিং করা এবং আরব সরকারগুলোর বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর লক্ষ্যে সমিতিগুলোর কর্মকা-ের জন্য ইউরোপের অর্থায়ন খুঁজে পাওয়া সহজতর হয়েছে। ব্রাসেলসে এর সদর দফতর থাকলেও শাখা রয়েছে নরওয়ে, সুইডেন, বেলজিয়াম ও যুক্তরাজ্যে। ফেডারেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো ইউরোপে ফতোয়া বা ধর্মীয় রুলিংয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের চেষ্টা। ইউরোপে ব্রাদারহুড সম্প্রসারণের প্রধান কাজ হিসেবে ফেডারেশন ১৯৯৬ সালে ডাবলিনে ইউসুফ আল-কারাদাবিকে প্রধান করে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ এ্যান্ড ফতোয়াস প্রতিষ্ঠা করেছে। কাউন্সিল যদিও মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে তার যোগসূত্র থাকার কথা অস্বীকার করেছে তবু বাস্তব সত্য হলোÑ এটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক ব্রাদারহুড ও এর প্রতি সহানুভূতিশীল আন্দোলনগুলোর অভ্যন্তরে মতাদর্শগত ভাবধারা প্রবাহের ক্ষেত্রে সুন্নি ইসলামের অভিব্যক্তির আনুষ্ঠানিক কাঠামো। অনেকটা ফোরামের মতো এই কাউন্সিল ইসলামী বিশ্বের ফতোয়া প-িতদের একত্রিত করে থাকে এবং ব্রাদারহুড ও তার মিত্র সংগঠনগুলোতে ইউরোপের মুসলমানদের ওপর আধ্যাত্মিক নিয়ন্ত্রণ কঠোরতর করার সুযোগ করে দিয়েছে। লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক বিশেষজ্ঞ সূত্র : আল-আহরাম উইকলি
×