ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ণিল আয়োজনে মুস্তাফা মনোয়ারের জন্মদিন উদ্যাপন

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বর্ণিল আয়োজনে মুস্তাফা মনোয়ারের জন্মদিন উদ্যাপন

গৌতম পাণ্ডে ॥ ‘আমার জন্মদিনে এত সুন্দর আয়োজনে আমি মুগ্ধ, অবিভূত। যারা আজ আমার সম্পর্কে আলোচনা করলেন, এরা সবাই আমার সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। নানা দিকের শিল্পকলার সঙ্গে আমার যুক্ত হতে হয়েছে। কোন এক সময়ে আমাদের দেশে যখন উর্দু ভাষাকে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছিল, তখন আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। পাকিস্তানীরা বলত আমরা যে শিল্পকলা চর্চা করি এটা বিধর্মী কাজ। তাদের সঙ্গে আমাদের দেশের কেউ কেউ যোগ দিয়েছিল। আমি মনে করি এই ধরণের কর্মকান্ড দিয়ে আমার সমস্ত জীবনের শুরু, এখান থেকেই শেষ। শিল্পীর শিল্পকর্ম দিয়ে সমাজ চির জাগ্রত করে রাখে। মনোমুগ্ধকর যে সংস্কৃতি আছে এগুলো শিল্পীদের আবেগ থেকে ধারণ করতে না পারলে এ সমাজ এগুবে না’- নিজের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সব্যসাচী শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার এ কথা বলেন। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের ৮১তম জন্মোৎসবের আয়োজন করে টেলিভিশন নাট্য নির্মাতাদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড। এদিন বিকাল থেকেই জাতীয় নাট্যশালা আঙ্গিনা ছিল উৎসুক মানুষের ভিড়ে পরিপূর্ণ। সবাই প্রিয় মানুষটির জন্মদিনকে উপভোগ করার জন্য আগে থেকেই হাজির হয়েছিল। আঙ্গিনাজুড়ে প্রদীপের আলো আর ফুল দিয়ে চমৎকার এক আবহ তৈরি করা হয়। এক দিকে মাইকে মৃদু আওয়াজে ভেসে আসে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর, অন্যদিকে একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় সেরে বসেন নিজ নিজ আসনে। অধির আগ্রহ নিয়ে মিলনায়তনভর্তি দর্শক তাকিয়ে ছিলেন পর্দা আচ্ছাদিত মঞ্চের দিকে। ঘড়ির কাঁটা যখন রাত ৮টায় ছুঁই ছুঁই, মুহুর্মুহু করতালিতে মিলনায়তন যেন অন্য রকম এক রূপ নেয়। সবাই পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন যার জন্য এ আয়োজন তিনি আসছেন। প্রদীপের অভায় ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হচ্ছে একাশি বছর বয়সী এই জ্যোতির্ময় মানুষটিকে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক আলী ইমাম এক সময় বলেই ফেললেন, একাশিকে যদি উল্টিয়ে দেয়া হতো তা হলে মুস্তাফা ভাইয়ের বয়স আঠারোতে। শিল্পী আসার সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় দেখানো হয় তাঁর বর্ণময় জীবনের কিছু অংশ। এরপর নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা ও শিবলী মোহাম্মদের পরিচালনায় নৃত্যাঞ্চলের পরিবেশনায় ছিল দলীয় নৃত্য। ‘গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু গুরু দেব মহেশ্বর’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে শিল্পীকে গুরুজ্ঞানে বন্দনা করে নেয়া হয়। মঞ্চে আসেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’ ও ‘তোমার আনন্দ এই এলো দ্বারে’ গানের সঙ্গে নৃত্য ও শিল্পীর ওপর পুষ্প বৃষ্টি নিক্ষেপণ চমৎকার আবহের সৃষ্টি করে। শুভেচ্ছা বক্তব্যের ডালি নিয়ে হাজির হন জন্মোৎসবের আহ্বায়ক সাইদুল আনাম টুটুল। ডিরেক্টরস গিল্ডের পক্ষ থেকে প্রথমে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয় শিল্পীকে। এছাড়া ফুলের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, দৃষ্টিপাত নাট্য সংসদ, অভিনয় শিল্পী সংসদ, চারুনীড়ম থিয়েটার, আর টিভি, চিল্ড্রেন ফিল্ম সোসাইটি, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ থিয়েটারসহ বেশকিছু সংগঠন। বক্তব্য রাখেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ, চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন, টিভি প্রযোজক নওয়াজেশ আলী খান, চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী, চিত্র পরিচালক মোর্শেদুল ইসলাম, নির্মাতা আনিমেষ আইচ, নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা, নাট্য নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী, মেজবাহ উদ্দিন সুমন, মেরী মনোয়ার, আহসান হাবিব প্রমুখ। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী লাইসা আহমেদ লিসা এবং আবৃত্তি করেন শিল্পী হাসান আরিফ। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের শিল্পীদের পরিবেশনায় ছিল সম্মেলক গান ‘কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা’ ও ‘আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা’। প্রসঙ্গত, শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার ১৯৩৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর যশোর জেলার মাগুরা (বর্তমান জেলা) মহকুমার শ্রীপুর থানার অন্তর্গত নাকোল গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কবি গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ। মাতা জামিলা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। পৈত্রিক নিবাস ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামে। চিত্রশিল্পে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত পদচারণা, বাংলাদেশে নতুন শিল্প আঙ্গিক পাপেটের বিকাশ, টেলিভিশন নাটক প্রযোজনায় অতুলনীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন, শিল্পকলার উদার ও মহৎ শিক্ষক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরা, দ্বিতীয় সাফ গেমসের মিশুক নির্মাণ এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনের লাল রঙের সূর্যের প্রতিরূপ স্থাপনাসহ শিল্পের নানা পরিকল্পনায় তিনি বরাবর তাঁর সৃজনী ও উদ্ভাবনী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
×