ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ মাহাতো

অদম্য ক’জন নারী ও অন্যান্য

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২৬ আগস্ট ২০১৬

অদম্য ক’জন নারী ও অন্যান্য

পুরুষশাসিত সমাজে কোথাও নারীর নিরাপত্তা ও শান্তি নেই। সম্ভবত কোন দিনই ছিল না। তারপরও নারীরা থেকে নেই। বাংলাদেশের নারীর চারপাশে সংকট আর সংকট। রাজনৈতিক সহিংসতা শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেই এগিয়ে যাচ্ছে তারা। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে নারী জয় করেছে এভারেস্টও। শিক্ষা-দীক্ষায় ক্রীড়ায়, নৈপুণ্যে পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। নারীরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় নারীরা বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা তাদের আয়ের অর্থ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এমনকি জনপরিবহন পর্যন্ত মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত আসনে জায়গা পেতে ঝগড়া করতে হয়। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতেও অনেক ছাত্রীর যৌন নিপীড়নের খবর আমরা খবরের কাগজে পড়ে থাকি। এসব দেখেই বোঝা যায় আমাদের দেশের নারীরা নানাভাবে অবহেলিত বঞ্চিত ও নির্যাতিত। আমাদের পাঠ্যসূচিতেও তাদের অবস্থান অতি সামান্য। পঞ্চাশের দশকের কৃষক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী রানী মা ইলা মিত্রের জীবনী ইতিহাস আজকের ছাত্রছাত্রী কতজন জানে? শ্রেণী বিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থায় দরিদ্র খেটে খাওয়া ঠকে যাওয়া, দলিত, অনাহারী আর মাঠে মাঠে সোনার ফসল ফলানো প্রান্তিক চাষাভুসা হাজং মারাং সাঁওতাল মানুষের পক্ষে লড়েছিলেন ইলা মিত্র। তিনি ভালবেসেছিলেন মানুষকে। নিজে জমিদার ঘরের বউ হয়েও লড়েছিলেন জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। সর্বহারার লড়াইয়ের ময়দানে ইলা মিত্র এক জাগ্রত নাম। নেতা নেতৃত্ব, শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার একজন সুসংগঠক, অন্যায়ের প্রতিবাদ আর প্রয়োজনে লড়াইয়ের শিক্ষা কি ছাত্রছাত্রীরা গ্রহণ করতে পারত না ইলা মিত্রের জীবনী পড়ে। বাংলাদেশের নারীদের ভাগ্য উন্নয়নের নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন বেগম সুফিয়া কামাল। বেগম রোকেয়ার রয়েছে অসামান্য অবদান। তাছাড়া শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলার ঘরে ঘরে। কিন্তু তারও স্থান হয়নি পাঠ্যসূচীতে। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা কি করে জানবে পাকিস্তানী সৈন্য আর দেশীয় রাজাকারদের কুকর্মের কাহিনী? তারা কি করে জানবে তাদেরই বয়সী ছাত্রী বন্ধুদের মা বোনদের কি পরিমাণ নিগ্রহ, পাশবিক নির্যাতন আর ধর্ষণের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে এই স্বাধীনতার জন্য? একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষিত হতে হয়েছে বাংলার নারীদের। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগামী হিসেবে বীরপ্রতীক সেতারা বেগম এবং বীরপ্রতীক তারামন বিবির জীবনী আমাদের সিলেবাসে নেই। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করা অগ্নিকন্যা বীর প্রীতিলতার জীবনী অনেকেরই অজানা। অন্তরজুড়ে কি অসীম দেশপ্রেম থাকলে জীবনবাজি রেখে দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারে এমন একজন তরুণ প্রাণ। দেশপ্রেম আর জন্মভূমিকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে ছিন্ন করে স্বাধীন করার শিক্ষা কি আমরা পাই না বীর কন্যা প্রীতিলতার কাছ থেকে। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী, স্পীকারসহ বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় তাদের দখল। উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতে বেশকিছু নারী রয়েছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমঅবস্থানে কোন কোন ক্ষেত্রে এগিয়েও রয়েছেন। আমাদের পোশাকশিল্প তো সামগ্রিক অর্থেই নারীর ওপর নির্ভরশীল। কৃষিতে তাদের বিচরণ অগ্রগণ্য। অর্থাৎ আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান রীতিমতো উল্লেখযোগ্য। উচ্চশিক্ষিত, আত্মনির্ভরশীল নারীরাও কম নির্যাতনের শিকার নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মনজুরকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দৃষ্টি হারাতে হয়েছে। এরকম বহু উদাহরণ দেয়া যাবে এ সমাজ থেকে। ১৪ এপ্রিল ডেইলি স্টার পত্রিকার খবর পড়লাম (ছবিসহ) লালমনিরহাটের বেবি বেগম তার অসুস্থ স্বামী আব্দুস সাত্তারকে রিক্সায় বসিয়ে নিজে রিক্সা চালিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। তার স্বামী কাজ করতে পারে না। দুটি সন্তান স্কুলে যায়। কোন উপায় না পেয়ে কারও কাছে হাত না পেতে নিজে হাতে তুলে নিয়েছেন রিক্সায় হ্যান্ডেল। এতে তার প্রতিদিন আয় হয় ১০০ থেকে ১৩০ টাকা। দুটি ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে তারপর তিনি রিক্সা নিয়ে বের হন। দুপুরে বাসায় এসে খাবার খেয়ে আবার বের হন, ফেরেন রাত ৮টায়। কতটা মনের জোর থাকলে এমন কাজে হাত দেয়া যায়। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বেবি বেগম। জয় হোক বেবি বেগমের। কল্পনা রানী, রাজশাহী জেলার তানোর থানার নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় ১৮ বছর আগে তার স্বামীর গাছ থেকে পড়ে মাজা ভেঙে যায়। সে ছিল দিনমজুর। ৪টি ছেলে সন্তান দুটি পৃথক। বাকি দুটি সন্তান বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে তারাও দিনমজুর। কল্পনা রানীও রাস্তায় মাটি কাটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে জীবিকার তাগিদে। তারপর এত বছর ধরে স্বামীসেবা। তার স্বামী দাঁড়ানো তো দূরের কথা বসতেও পারে না। শুয়ে শুয়ে সবকিছু। কতটা ধৈর্য ও স্বামীভক্তি থাকলে একটা নারী এত বছর ধরে পঙ্গু স্বামীর সেবা করে যেতে পারে। কল্পনা নারী তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারপরও সে তার স্বামীর প্রতি সামান্যতম বিরক্ত নন। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন তার স্বামী যেন অনেক দিন বেঁচে থাকে। তাকে যেন কেউ বিধবা না বলে। সিথির সিঁদুর যেন মুছে না যায়। রতœা আপা আমার তিন বছরের সিনিয়র আজ থেকে ১২ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৪ সালে আমি তাদের বাড়িতে যাই। বাসায় বসার মতো একটি চেয়ার পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু অবাক হলাম যখন শুনলাম তার তিনটি মেয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। (চলবে)
×