ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাহরিয়া মুনতাহি

জীবদ্দশায় অমর ॥ জলে ফেলপস, ডাঙ্গায় বোল্ট

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৪ আগস্ট ২০১৬

জীবদ্দশায় অমর ॥ জলে ফেলপস, ডাঙ্গায় বোল্ট

স্বপ্ন আর বাস্তবতার সম্মিলন তখনই ঘটে যখন থাকে তীব্র ইচ্ছাশক্তি, ভালবাসা, প্রচেষ্টা এবং অবিচলতা। ‘স্বপ্ন সেটা নয় যা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটাই যা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না’- মহান এ উক্তি করেছিলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও পরমাণু বিজ্ঞান এপিজে আব্দুল কালাম। না, সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেননি মাইকেল ফেলপস বা উসাইন বোল্ট। কিন্তু ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা আর পরিশ্রমে ছিলেন অবিচল ও দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ। সে কারণেই বাস্তবে যা করেছেন তা শুধু অপেক্ষার সুফলই বয়ে আনেনি বরং প্রাপ্তিটাকেই করেছে বিশ্বের তাবৎ ক্রীড়াবিদের কাছে স্বপ্নের মতো! পরিস্থিতিটাকে উভয়-সঙ্কটই বলা যায়! একজন জলের রাজা, আরেকজন ডাঙ্গার সম্রাট। অপ্রতিরোধ্য, দুর্দমনীয় ও অলঙ্ঘ্য এ দুটি বাঁধা পেরোনো একেবারেই অসম্ভব! দু’জনই ক্যারিয়ার চলার সময়েই হয়ে গেছেন কিংবদন্তি। সাঁতারের জগতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাইকেল ফেলপস আর স্প্রিন্টের জগতে জ্যামাইকার উসাইন বোল্ট। দু’জনই যেন বন্দুক থেকে ছোঁড়া গুলি কিংবা ধনুক থেকে ছেড়ে দেয়া তীর। কোন উপমাই যথেষ্ট হবে কি এ দুই গতিদানবের জন্য? যখন সুইমস্যুট পড়ে জলে নামেন ফেলপস হয়ে যান ‘টর্পেডো’- যেন জলের ভেতরেই উড়ে চলেন। তাই তিনি উপাধি পেয়েছেন ‘ফ্লাইং ফিশ!’। আর বোল্ট ট্র্যাকে নামার পর হয়ে যান ‘মিসাইল’- যেন প্রতিপক্ষকে শকওয়েভের ধাক্কায় পেছনে ফেলতে হবে। এ কারণে ‘লাইটনিং বোল্ট’ বা ‘বিদ্যুৎ বোল্ট’ নাম হয়েছে তার। এই দুই মহাতারকা অলিম্পিকে যে কীর্তি গড়েছেন তা আজ পর্যন্ত কেউ করতে পারেননি। উভয়-সঙ্কট দুই ভুবনের বাকিসব এ্যাথলেটদের জন্য। কারণ, ফেলপস বা বোল্টকে ছোঁয়া একেবারেই আকাশ-কুসুম কল্পনা। ফেলপস সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান হয়ে গেছেন কোন এ্যাথলেট হিসেবে অলিম্পিকে সর্বাধিক ২৩ স্বর্ণসহ মোট ২৮টি পদক! আর বিস্ময়কর বোল্ট ২০০৮, ২০১২ ও এবার রিও অলিম্পিকে জিতেছেন ১০০, ২০০ ও ৪ী১০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণপদক। বিস্ময়কর নিদর্শণ ট্রিপল-ট্রিপল (ট্রিপল জয়ের হ্যাটট্রিক) গড়েছেন প্রথম কোন ক্রীড়াবিদ হিসেবে। কীর্তিটা গড়েই ৩০ বছরে পা দিয়েছেন ৯.৫৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটার শেষ করা বিশ্বরেকর্ডধারী বোল্ট। আর ফেলপসের বয়স ৩১! এ দুই জগতের দুই মহামানব নিজেদের শেষ অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন, আর দেখা যাবেনা তাদের ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে বিবেচিত মর্যাদার অলিম্পিকে। কেউ যদি বিনামেঘে বজ্রপাত কিংবা বিজলি চমক দেখতে চায় সেটা হয়ত সম্ভব হবে না প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থেকে। তবে এমনটা অনেকেই দেখেছেন যারা যারা একবার সর্বকালের সবচেয়ে গতিধর মানব বোল্টকে ট্র্যাকে কোন প্রতিযোগিতায় অবলোকন করেছেন। নামের সঙ্গেই আগুনে গতির পুরোপুরি রেশটা আছে। ইংরেজী শব্দ বোল্ট পানে ছুটে পলায়ন কিংবা বজ্র! দুঃস্বপ্ন কিংবা হতাশা যেন ছুঁতে না পারে সেজন্য বোল্ট পলায়ন করেন। ছোটেন বজ্রের মতো স্বপ্নের পেছনে। ক্যারিয়ারের শুরুতে ২০০৪ অলিম্পিকে প্রথমবার আসার সময় তার লক্ষ্য ছিল অন্তত একটি পদক জয়ের। কিন্তু সেবার পারেননি। কোয়ালিফিকেশন থেকেই বাদ পড়েন। কিন্তু চার বছর পর ২০০৮ সালে বেজিংয়ের বার্ডস নেস্ট যেন ছিল বজ্রপাতের ট্র্যাক। বিদ্যুতগতি নিয়ে ফিরলেন বোল্ট। ৯.৬৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে শেষ করে বিশ্বরেকর্ড ও নতুন অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন মাত্র ১০ সেকেন্ডের ক্লাইম্যাক্সে! ২০০ মিটার ও ৪ ী ১০০ মিটার রিলেতেও স্বর্ণ জিতে প্রথম ট্রিপল সম্পন্ন করেন তিনি। চার বছর পর লন্ডনেও ট্রিপল জিতে নেন এ বিশ্বরেকর্ডধারী। তবে এবার সংশয় ছিল রিও অলিম্পিকে তার অংশগ্রহণ নিয়েই। কারণ জ্যামাইকার অলিম্পিক ট্রায়ালের সেমিফাইনাল থেকেই নাম প্রত্যাহার করেন তিনি হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়ে। শেষ পর্যন্ত শঙ্কা কাটিয়ে অংশ নিলেও এবার শ্রেষ্ঠত্ব ভূলুণ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল পুরোপুরি। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১০০ মিটারে জয় দিয়ে শুরু করলেন স্বপ্ন পূরণের যাত্রা। আর থামানো গেল না বোল্টকে। বাকি দুটিতেও থাকছেন অস্পৃশ্য। রিও অলিম্পিকে অংশ নিতে বিমানবন্দরে নেমেই বোল্ট বলেছিলেন, ‘সবাই চায় বারবার জয় পেতে, আর আমি চাই রেকর্ড গড়তে।’ তবে নিজের বিশ্বরেকর্ডগুলো ভেঙ্গে নতুন করে গড়তে পারেননি। কিন্তু এক যুগের স্বপ্নটা সত্য হয়েছে। ট্রিপল-ট্রিপল জেতার লক্ষ্য নিয়ে অনেক আগেই নিজের স্বপ্নটা জানিয়েছিলেন। এবার সেটা পূর্ণ হয়েছে। তারপরই জানিয়েছেন আর অলিম্পিকে নয়। কারণ, ট্রিপল জয়ের পরদিনই ৩০ বছর বয়স পূর্ণ হয়েছে তার। এখন বিয়ে-থা করে থিতু হবেন সংসার ধর্মে। ট্র্যাকে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা বোল্টের মন জয় করে নিয়েছেন এক ‘স্পেশাল লেডি’। জামাইকার জনপ্রিয় মডেল ক্যাসি বেনেটের সঙ্গে রোমান্সের সেই ঘটনা ফাঁস করে দিয়েছেন বোল্টেরই বড় বোন ক্রিস্টিন বোল্ট হিল্টন। তিনি জানিয়েছেন, দেশে ফিরেই ক্যাসিকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে চলেছেন বোল্ট। গত তিন বছর ধরে ক্যাসি বেনেটের সঙ্গে গোপনে ডেটিং করছেন বোল্ট। তবে অলিম্পিক হারাল অন্যতম সেরা এক এ্যাথলেটকে। বোল্ট শুধু অরিম্পিকে ট্রিপল-ট্রিপল জেতেননি, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপসেও দুরন্ত তিনি। ২০১১ বিশ্ব আসরের ১০০ মিটারে ডিসকোয়ালিফাইড হয়েছিলেন ফলস স্টার্টের জন্য। সে কারণে ওই একটিই স্বর্ণ পদক হাতছাড়া। এছাড়া ২০০৯, ২০১৩ ও ২০১৫ বিশ্ব আসরের তিনটি ইভেন্টেই জিতেছেন তিনি। সে কারণেই জীবন্ত কিংবদন্তি বোল্ট এখন অমরত্ব পেয়ে গেছেন। অমরত্বটা পেয়ে গেছেন আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি ফেলপস। ডাঙ্গায় যেমন অপ্রতিরোধ্য বোল্ট, ফেলপস তেমনি জলে। ২০১২ অলিম্পিক শেষে ইতিহাসের সেরা অলিম্পিয়ান হয়ে গিয়েছিলেন সর্বাধিক ১৮ স্বর্ণপদক জিতে। এরপরই হুট করে অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু জলের মায়া, জলের প্রতি ভালবাসা আর সাঁতরানোর জন্য আঁকুপাঁকু করা মনটাকে সামলাতে পারেননি। ২০১৪ সালে আবার ফেরেন, লক্ষ্য ছিল রিও অলিম্পিকে অংশ নেয়ার। সেটা করতে দিবারাত্রি পরিশ্রম করতে হয়েছে, নিজেকে সেরা অবস্থানে নিয়ে যেতে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়েছেন বিশ্বসেরা এ মার্কিন সাঁতারু। এর সঙ্গে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর অপরাধে ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞার ধকলও পোহাতে হয়েছে। কিন্তু অলিম্পিকের আগে ঠিকই নিজের যে কর্মগুণে বিশ্বব্যাপী ফেলপসকে সবাই ‘বুলেট’ হিসেবে জানে সেই অবস্থানে ফিরেছেন। রিও অলিম্পিকের পুলে নেমে আবার গতির ঝড় তুলে তিনি ৫ স্বর্ণ ও ১ রৌপ্য জিতেছেন। ২০০০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ফেলপস সাঁতারের ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু জিততে পারেননি। পরবর্তী চার অলিম্পিক হয়ে গেছে ফেলপসের জয়জয়কারে মুখর। ক্যারিয়ারের পঞ্চম অলিম্পিকে ফেলপস যে কীর্তি প্রদর্শন করেছেন তা সবার জন্যই দৃশ্যমান। আরও ৫টি স্বর্ণপদক জয় করে ফেলপস অলিম্পিক থেকে সর্বমোট ২৩টি স্বর্ণপদক জয়ের বিরল গৌরব অর্জন করেন। অলিম্পিকে তার সর্বমোট পদক সংখ্যা এখন ২৮টি। এর মাধ্যমে সর্বকালের সেরা এ অলিম্পিয়ান তার অবস্থান আরও সুদৃঢ় করেছেন নিজেকে অনন্য উচ্চতায় তুলে। শেষ অলিম্পিকটা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে সমাপ্তির যে ব্যাকুলতা ছিল সেটা পূরণ হয়েছে। আর অলিম্পিকে দেখা যাবে না ফেলপসকে। চার অলিম্পিক মাতানো বোল্টও থাকছেন না। এ কারণে একটা শূন্যতার তৈরি হবে মর্যাদার অলিম্পিকে, হারাবে হয়ত আকর্ষণটাও। আন্তর্জাতিক এ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সভাপতি সেবাস্তিয়ান কো গতিদানব বোল্টের অবসর প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা ঠিক যে তার অনুপস্থিতিতে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’ ফেলপস ও বোল্টকে অলিম্পিক গেমসের ‘আইকন’ খেতাবে ভূষিত করেছেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সভাপতি টমাস বাখ। রিও আসরে তারা ঔজ্জ্বল্য ছড়ালেও আগামীতে কিভাবে পূর্ণ হবে তাদের ঘাটতি এ নিয়ে চলছে এখন বিস্তর আলোচনা। এই মুহূর্তে এ দু’জনের মতো স্পোর্টিং পাওয়ার বা ক্যারিশমার ধারেকাছেও নেই কোন এ্যাথলেট। সাঁতার ও এ্যাথলেটিক ট্র্যাক থেকে এই দুই ক্রিড়াবিদ মিলে জয় করেছেন ৩২টি স্বর্ণপদক। অভূতপূর্ব, অবিস্মরণীয় এ নৈপুণ্য কি আর কেউ দেখাতে পারবেন? অপেক্ষায় থাকবে বিশ্ব, প্রতীক্ষা আরেকজন করে বোল্ট আর ফেলপসের। জলের কুমির আর ডাঙ্গার বাঘ হয়ত সত্যি একদিন আসবে- সেই স্বপ্নের শুরুটা ২০২০ টোকিও অলিম্পিক থেকেই!
×