ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

এশিয়ার কণ্ঠস্বর

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ১৯ আগস্ট ২০১৬

এশিয়ার কণ্ঠস্বর

কোন কোন মানুষ বেঁচে থাকা জীবনকে পাড়ি দিয়ে মৃত্যুর পরও অন্য এক জীবন লাভ করে, তার সাধন কর্মের মধ্য দিয়ে। যে সাধনায় ব্রতচারী হয়ে আজও বেঁচে আছেন শিল্পী এসএম সুলতান। বাংলার চিত্রশিল্পের সকল ধারাকে উপেক্ষা করে এক নতুন ঘরানার জনক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর জীবনের পুরো সময়টাই শিল্প সাধনায় ব্যয় করেছিলেন। তাঁর ছবি আঁকার ধরন, ছবি আঁকার বিষয়, কর্ম কৌশল সব কিছুই তাঁর জীবন থেকে নেয়া। তাঁর আলোচনায় বা চিন্তায় বিমূর্ততার ছাপ নেই। তাঁর প্রত্যেকটি ছবিই প্রকৃতিবাদিতার কথা বলে, কথা বলে বাস্তববাদিতারও। তরুণ বয়সেই সুলতান চিত্রকলায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। উপমহাদেশের বিভিন্ন মহানগরীতে সুধী সমাজে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও শিল্পকৌশলের জন্য সুপরিচিতি ও সমাদৃত হয়েছিলেন। চিত্রকলায় তাঁর একাডেমিক শিক্ষা ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কলকাতা আর্ট কলেজে তিনি দু, তিন বছর শিক্ষানবিশী করেন। কলেজের গ-িতে থাকার মতো মানসিকতা তাঁর ছিল না। বরং বাঁধনহারা, কিছুটা ছন্নছাড়া জীবনেই ছিল তাঁর মোহ। তাঁর দৃষ্টি আর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থেকে। শিল্পীর সাধনায় সব সময়ই একটা শিল্পতত্ত্ব প্রকাশ পায়। যে তত্ত্বে¡ থাকবে জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র এবং ধর্ম। জীবন সংগ্রামের কাঠ-খড় পুড়িয়ে প্রকৃতির মায়া নদীর কাছ থেকে নিয়ে বাংলাদেশের ভূ-খ-কে ভালবেসে সুলতান ধর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এদেশের মানুষের কর্মপন্থাকে। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কখনই ভোগ-বিলাসিতায় মগ্ন থাকেননি বরং ত্যাগ এবং সাধনার নির্মাণ শিখায় প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করেছেন তাঁর ক্যানভাস। যে ক্যানভাসগুলো বিশ্বশিল্পের বাতিঘর হয়ে আজও আলোকময় জীবনীশক্তিকে উদ্ভাসিত করছে দেশজ মায়ায়। সুলতান গ্রামবাংলার দৈনন্দিন জীবন প্রবাহের এক সার্থক শিল্পী। সুলতানের মুখ্য বিষয় মানুষ ও প্রকৃতি। মানুষই আবার এ দুই এর মধ্যে প্রধানতর। সুলতানের হাতে বাঙালী পুরুষের চেহারা শক্তিশালী ও পৌরুষদীপ্ত, মহিলারা সুগঠিত অথচ কমনীয়। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, শ্রমজীবী মানুষের বলিষ্ঠ পেশিবহুল, সংগ্রামী ও বক্তব্যবহুল একদম ভিন্ন স্বাদের ভিন্ন মাত্রার ছবি এঁকে প্রমাণ করেছেন যে তিনি খেটে খাওয়া মানুষের ছবি আঁকেন। খেটে খাওয়া মানুষকে নিয়ে ভাবেন। মানুষ ছাড়াও প্রকৃতি সুলতানের এক প্রিয় বিষয়বস্তু। মানুষ তাঁর কাছে যেমন সংগ্রামশীল, প্রকৃতি তেমনি সৌন্দর্যম-িত, বর্ণাঢ্য ও শান্তির আশ্রয়মূল। তাঁর ছবিতে মাটির গন্ধ পাওয়া যায় এবং প্রায়ই মৌলিক রঙের ব্যবহারে এ গ্রাম বাংলার নিগূঢ় প্রকৃতিকে তিনি ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন। বাংলার পথ-ঘাট, নদী-নালা, পশু-পাখি, জমিন-আসমান সব কিছুর ভেতরেই সুলতান নিজেকে অন্বেষায়িত করেছিলেন আর অনুসন্ধানের বীজ অঙ্কুরোদগমিত হয়েছিল তাঁর শিল্পকর্মে। মানবমূর্তির রেখায়নে কঠিন নির্বাচন ও ট্র্যাজেডির আভাস তাঁর বিকাশমান দক্ষ হাতের স্বাগতিক স্বাক্ষর বহন করে। তাইতো পিকাসো, সালভাদর দালি, মাতিস, ব্রাক ও ক্লীর মতো বিশ্বনন্দিত আধুনিক সেরা শিল্পীদের চিত্রকর্মের সঙ্গে প্রদর্শিত হয় শেখ মুহম্মদ সুলতানের চিত্রকর্ম। সুলতান তাঁর ছবিতে স্বপ্নকল্পনা ও বাস্তবতা, পুরনো দিনের স্মৃতি ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব। তাঁর চাষীরা, চাষী রমণীরা, জেলেরা, আঁশবটিতে মাছকাটা জেলেনীরা বিপুলদেহী, তাদের মাংসপেশি স্ফীত, শরীর গিটপড়া। এক পলকের দৃষ্টিতেই মনে হয় কী সাহসী, প্রত্যয়ী, পরিশ্রমী, সকল প্রতিকূলতার মোকাবেলায় কী দৃঢ়সংকল্প। হয়তো বাস্তব এ্যানাটমির নিরিখে ভুল আছে এসব মানবদেহের চিত্রায়নে, কিন্তু সুলতান সচেতন ভাবেই সে সবের প্রতি নজর দেননি। তাঁর আঁকা ‘ধানকাটা’ চিত্রটিতে দেখা যায় অসংখ্য মানুষ ধান কাটার কাজে ব্যস্ত। বিস্তীর্ণ ধানি জমিতে কেউ কাস্তে হাতে ধান কাটছে। কেউ সেই কাটা ধান আঁটি বাঁধছে। কেউ আবার সেই বাঁধা আঁটিগুলো মাথায় নিয়ে গরুর গাড়িতে বোঝাই করেছে। কেউ বা একটু বিশ্রামের ফাঁকে হুকায় ধূমপান করে ক্লান্তি দূর করে নিচ্ছে। ছবিটিতে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ সোনালি ফসলে ছেয়ে গেছে, শিল্পীর কৃষককুল এই ফসল ফলিয়েছে তার সকল পেশীয় বলে। শ্রমের এই ফসল তারা কাটছে পরম আনন্দে। বাংলার কৃষকদের শ্রম সংগ্রামের একটা প্রতিচ্ছবি শিল্পী তাঁর বলিষ্ঠ তুলির টানে অতি স্বচ্ছন্দে মূর্ত করে তুলেছেন। সুলতান তিন অর্থে আদিম। তাঁর কাজ লোকজ এবং আধুনিক ঐতিহ্যের প্রান্তে, তাঁর বিষয়াবলী প্রায়শই কৃষক জীবনের উপাখ্যান ও কর্মতৎপরতা থেকে উন্নীত এবং সবশেষে তাঁর কাজে শ্রমজীবী মানুষের ফিগার। তাঁর কাজে ফিগারগুলো মূলত মনুমেন্টাল। মনুমেন্টালিটির কারণে ফিগার এবং চতুর পার্শ্বের মধ্যে কোন সঙ্গতি নেই। সেজন্য তাদের মনে হয় নাটকীয়। সলুতানের কজে ফিগারসমূহ অর্জন করেছে একটা মিথনির্ভর বাস্তবতা, আদিম এক ধরনের শক্তি এবং ইচ্ছার জোড়। তারা প্রস্তুত এবং ক্ষিপ্র ক্ষমতা কেড়ে নিতে। তিনি ছিলেন ভিন্ন শিল্পভুবনের এক শিল্পী, অভিজ্ঞতা এবং মনোভঙ্গির দিক থেকে বুুর্জোয়াদের বিরোধী এবং বিপরীত। বর্তমানে দাঁড়িয়ে তিনি দেশকে স্বপ্নময় দেখতে চান, যেখানে মানুষজন সুখী, স্বাস্থ্যশীল ও পরিপূর্ণ। ‘কৃষক’ চিত্রটিতে তিনজন কৃষককে ধান ক্ষেতের পাশে বসে থাকতে দেখা যায়। তাদের একজনের হাতে হুকা, ধূমপান করছে আরেকজন কাস্তের ধার পরীক্ষা করছে এবং অন্যজন পাকা ধান দেখতে ব্যস্ত। দূরে ছবির ডানে তাদের খাবার ও পানি রাখা আছে। ছবির পটভূমিতে বিস্তীর্ণ পাকা ধানের ক্ষেত তার একেবারে পেছনে একটি কাঁচা ঘরবাড়ি দেখা যায়, যার সামনে দিয়ে একজন দুটি গরু নিয়ে কাজে যাচ্ছে। ছবিটি দেখে বোঝা যায় খুব ভোরে তিনজন কৃষক ধান কাটার পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছে। যখন সূর্যও ওঠেনি। এই ধান কেটে তারা ঘরে তুলবে, শেষ হবে তাদের শ্রম সংগ্রামের একটি পর্ব। চিত্রটিতে সোনালি বরণের ধানক্ষেত দূরে গ্রামের গাছপালায় সবুজের সমারোহ, মাঝখানে তিনজন স্বাস্থ্যবান কৃষক যাদের শরীর শ্রম সংগ্রামে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। এটা বাংলার কৃষকের সাধারণ জীবন যাত্রার দৈনন্দিন প্রতিচ্ছবি। সুলতানের শক্তির ভিত্তি তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা। তাঁর কৃষক উৎস এবং তাঁর বোহেমিয়ান জীবনস্টাইল পরস্পর প্রবিষ্ট এবং তাঁর চেতনাকে আকার দিয়েছে। তাঁর কাজের দিকে তাকালে মানতে বাধ্য হই এ সকল কাজ উৎসারিত হয়েছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এবং প্রায়শই উদ্দীপিত এবং উচ্চকিত হয়েছে অভিজ্ঞার ওই প্রগাঢ়তা থেকে। মাধ্যম হিসেবে কাঠ, কয়লা, পেন্সিল, কালি কলম, ছাপই ছবি ও তেল রঙ ব্যবহার করেছেন। রঙগুলো ছিল দেশজ প্রাকৃতিক বা ভেষজ রঙ। সাধারণভাবে প্রচলিত কালি, ভূষা রঙ, গাবের আঠা বা বনজ ফলের কষ প্রভৃতি ব্যবহার করেছেন। সাপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করেছেন পাতলা, মোটা কাগজ, চট, বোর্ড অথবা ক্যানভাস। সুলতানের ফিগারসকল কার্ভ। একটি ফ্ল্যাট সারফেসে কার্ভ ফিগারসকল ভল্যুমের বোধ তৈরি করে এবং ফিগারসকলের মধ্যে আরও তৈরি করে তীব্রতা, তাঁর ফিগারসকলের স্থান ইমেজের ক্ষেত্রে কার্ভের তীব্রতা আরও তৈরি করে দীপ্ততা। এভাবে তিনি তৈরি করেন ফিগারের মধ্যে জাদু। এ যেন সরলতার সঙ্গে জটিলতার এক দ্বান্দ্বিকতা। বিষয়ের সরলতা ফিগার নির্মাণের জটিলতার মধ্যে স্পন্দিত হতে থাকে। আমাদের চোখে দুই-ই পরপর কিংবা একসঙ্গে উদ্ভাসিত হতে থাকে। সরল বাস্তবের মধ্যে প্রোথিত থাকে জটিল বাস্তব, চেনা বাস্তবের মধ্যে প্রোথিত থাকে অধিকতর বাস্তব। সেজন্য অধিকতর বাস্তব বিদ্যমান বাস্তবের এক ধরনের সমালোচনা এবং অধিকতর বাস্তব আবহমান বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে বর্তমান তার সীমাবদ্ধতা করে স্পষ্ট। সুলতানের ফিগারদের চোখে দৃষ্টি নেই। প্রায় পুরুষ ফিগার পেশল কিন্তু চোখে তাদের দৃষ্টি নেই এবং নারী ফিগারদের চোখ সম্মুখে নিবদ্ধ নয়। সেজন্য হয়তো তাদের মধ্যে একটা অন্ধ ঝোঁক আছে। তারা চাষে উন্মাতাল, লড়াইতে উন্মাতাল, দৈনন্দিন কাজে উন্মাতাল। কাজের বাইরে পরপারে চোখ খুলে তাকাবার কোন অর্থ নেই কিংবা সময় নেই। তারা নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ, নিজেদের পরপারে তাদের কোন আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই। তাদের ওপর ভর করেছে তাদের নিয়তি। তারা মগ্ন এবং তাড়িত। তাদের অভিজ্ঞতা গভীর। তাদের দাবি তাদের এভাবেই দেখতে হবে, বিকৃত, অতিরঞ্জিত, সুন্দর না করে। তারা যা তাই, এখানেই তাদের যথার্থতা। অঙ্কন শৈলীতে সুলতান ছিলেন মূলত পাশ্চাত্য ধারার শিল্পী। বিভিন্ন কারণে তাঁর ছবি ভ্যানগগ, পল গগ্যাঁ, পিকাসোর কথা মনে করিয়ে দেয়। তাঁর বেশকিছু ছবিতে যেমন- ধান ক্ষেতে কৃষক, ধান মাড়াই, গোলায় ধান তোলা ইত্যাদি ছবিতে হলুদ রঙের প্রাধান্য এবং তুলির স্ট্রোক এই দুইয়ের কারণে তাঁকে ভ্যানগগের কাছাকাছি মনে হয়। আবার মাছ কোটা, কিংবা ঝড়ের পরে ধরনের ছবিতে রঙের বৈশিষ্ট্যে গাঢ় সবুজ, মিশ্রলাল, খয়েরি, বেগুনি এবং নারী মুখের আদল পলগগ্যাঁর কাজের মতো। মানুষ প্রধান ছবিগুলোতে মাইকেল এঞ্জেলোর ছবির কিছু চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সুলতানের কিছু কিছু ছবিতে তাঁর একবারে নিজস্ব একটি রঙ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। বিশেষ করে জমি দখলে কৃষকদের কলহ শীর্ষক ছবিগুলোতে এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলোর রঙ প্রধানত মেটে সবুজ ও বাদামি, খয়েরি এবং মিশ্র চাপা প্রকৃতির রঙ। সুলতান পুরুষ ফিগার আঁকতে গিয়ে বাদামি-খয়েরি এবং কালো রঙ বেশি ব্যবহার করতেন। আর প্রকৃতি এঁকেছেন নানা রঙের উজ্জ্বলতায়। সুলতানের ছবিতে মানুষের সঙ্গে জন্তুর উপস্থিতি বিশেষত গরুর ছবি পিকাসোসহ অন্য শিল্পীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। জয়নুল কিংবা কামরুলও তাঁদের ছবিতে গরুকে প্রাধান্য দিয়েছেন। মকবুল ফিদা হুসেন তাঁর ছবিতে ঘোড়াকে দিয়েছেন এক আশ্চর্য প্রতীকী স্থান। শাহাবুদ্দিন কুকুর, ঘোড়া ও গরুকে এনেছেন মানুষের পাশাপাশি। সুলতানের কাজে গরু অত্যন্ত প্রাত্যহিক বাস্তব ও সামজিক প্রতীক, অন্যদের ক্ষেত্রে প্রধানত নান্দনিকভাবে প্রতীকী। চিত্রকলার ক্ষেত্রে বিশ্বের মহান সব শিল্পীদের কাজগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, স্বদেশীকতা, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা তথা সমাজচেতন চিত্রকলার একটি মূল উপজীব্য বিষয়। শিল্পী এসএম সুলতানের ছবিগুলোও তাই বলে। তাঁর চিত্রকর্মের মূল বিষয়বস্তু শ্রমজীবী মানুষ তবে এ কথাও অবশ্যই স্বীকার্য যে, তাঁর ল্যান্ডস্কেপগুলোর আবেদনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতন দেশপ্রেমী বাংলাদেশীয় স্বপ্নে লালিত বাংলাদেশ সুলতানের ছবিতে ধরা দিয়েছে। সুলতানের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, নিজ দেশ ও জাতি নিয়ে এক হিমালয় সমগর্ব।
×