ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

সভ্যতায় নারীর অবদান বর্তমানে নারীশ্রমের বৈষম্যকরণ

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১২ আগস্ট ২০১৬

সভ্যতায় নারীর অবদান বর্তমানে নারীশ্রমের বৈষম্যকরণ

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সভ্যতায় নারীর অবদান কতখানি জোরালো ছিল। সভ্যতার সূচনাকাল থেকে মানবজাতি তার স্বাভাবিক প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে, অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে নিজের চারপাশে বৈষয়িক যে পরিবেশ গড়ে তুলত সেটাই ছিল আদি মানবের আদিম অর্থনীতি। বন্য মানুষরা প্রকৃতির দানকেই সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ বলে গ্রহণ করত, যা ইতিহাসে খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতি হিসেবে চিহ্নিত। সে সময় মানুষের জীবনে কোন স্থায়িত্ব ছিল না, যাযাবর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল বন্য মানুষরা। খাদ্যের অন্বেষণে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার ঘুরে বেড়াত। পরিবার বলতেও তেমন কিছুই ছিল না। অবাধ স্বেচ্ছাচার এবং দলগত বিবাহ ছিল মানব ইতিহাসে পরিবারের মূল ভিত্তি। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান আসত বলে সন্তানের পরিচয় নির্ধারণ হতো মায়ের দিক থেকে। বংশপঞ্জি এবং সম্পত্তি বণ্টন সবই ছিল মায়েদের একচ্ছত্র অধিকারে। সঙ্গত কারণেই পরিবারের সর্বময় কর্ত্রী ছিলেন মা। বন্য মানুষ এক সময় বর্বর উপজাতিতে নিজেদের বিবর্তিত করল। ফলমূল সংগ্রহ এবং কাঁচা মাংস বক্ষণের বিপরীতে তৈরি হলো বীজ থেকে নতুন করে ফলমূল উৎপাদনে প্রক্রিয়া এবং আগুনে ঝলসিয়ে মাছ-মাংস আহারের নতুন পদ্ধতি। ফলে সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা সূচীত হলো এবং ইতিহাসের নতুন মাত্রাও যোগ হলো। খাদ্য সংগ্রহ থেকে খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতিতে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে আদিম মানুষকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই সুদীর্ঘকাল আদিম বন্য মানুষের প্রতিদিনের জীবনে নারীর অবস্থান ছিল একেবারই শীর্ষে। আর তাই পরিবার হিসেবে প্রথম পরিবারই চিহ্নিত হলো ‘মাতৃতান্ত্রিক’ পরিবার হিসেবে। যার অপভ্রংশ এখনও আমাদের বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গারো উপজাতির মধ্যে দৃশ্যমান। প্রাচীনকালের ইতিহাসবিদরা মনে করেন মানব সভ্যতায় যে কৃষি অর্থনীতির উদ্ভব তা মূলত নারী জাতিরই এক অনবদ্য অবদান। মেয়েরা ঘরে থাকত বলেই ফলমূলের বীজ তাদের দ্বারাই বপিত হয় বলে সমাজ এবং নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা। কৃষি সভ্যতার সূচনাকাল থেকে মানব জাতির যাযাবর জীবনের পর্ব সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং এক জায়গায় স্থায়িত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। প্রতিদিনের জীবনের স্থিতি এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক প্রয়োজন আদিম মানুষের মনে দানা বাঁধতে শুরু করে। শুরু হয় মানুষের গোষ্ঠীগত জীবনযাত্রা এবং নেতৃত্বের অপরিহার্যতা। সঙ্গে সঙ্গে পিতৃত্বের পরিচয়ও আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে আদিম মানুষের সামনে এসে দাঁড়ায়। উৎপাদন অর্থনীতিতে খাদ্যশস্যের মজুদ ব্যবস্থাও গড়ে ওঠে। বন্যপ্রাণী যেমন পশুপাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে সেটারও সংরক্ষণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। ফলে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের হাতে সম্পত্তির মালিকানা কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। পিতৃত্বের স্বীকৃতির কারণে তৈরি হয় একক পরিবার। এঙ্গেলস তাঁর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ বইতে উল্লেখ করেন যে, ব্যক্তি মালিকানার উপস্থিতি এবং একক পরিবারে ভিত্তিই নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়। নারীরা তাদের পূর্বের সেই অধিকার আর কখনও ফিরে পায়নি। পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা সব সময়ই অসাম্য বৈষম্যের শিকার হয়েছে। আজ অবধি সে ধারাও অব্যাহত রয়েছে। যে কৃষি সভ্যতার বীজ বপন করেছিল নারী সেই কৃষিতে আজও নারী সমাজের অবদান কোন অবস্থাতেই পুরুষের চেয়ে কম নয়। তবু নারীরা আজ বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসলেও সেই অবদানকে নানাভাবে উপেক্ষা করা হয় এবং শ্রমমজুরিতে এত বেশি বৈষম্যের শিকার হতে হয় যে তার কোন হিসাবই নেই। এক পরিসংখ্যানে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশে কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমশক্তি প্রায়ই ২ কোটি ৫৬ লাখ। আর সেখানে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ৫ লাখ। অর্থাৎ অর্ধেকের কিছু কম। এক দশক আগেও নারীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৮ লাখ। সেখানে বেড়েছে প্রায় ৬৭ লাখ। কিন্তু কৃষিতে শ্রম বিনিয়োগে নারীদের সংখ্যা বাড়লেও তাদের সুযোগ-সুবিধা তেমন একটা বাড়েনি কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড ২০১৫তে নির্ধারণ করা হয় ২ কোটি ৫ লাখ ৮২ হাজার ৮২৪টি। এর মধ্যে কৃষাণী হিসেবে নারী শ্রমিকরা কার্ড পায় মাত্র ১২ লাখ ৫৮ হাজার ৬৫৭টি। যেখানে সংখ্যায় প্রায় পুরুষদের কাছাকাছি সে জায়গায় কার্ড বিতরণেও রয়েছে বিরাট ফারাক। বেসরকারী সংগঠন কর্মজীবী নারী দেশের ৬টি জেলায় কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ১৩ হাজার নারী তাঁদের মূল্যবান শ্রম এবং সময় বিনিয়োগ করছে। এই শ্রমমূল্যতেও রয়েছে নানা রকমের বিভাজন। কৃষি মজুরি হিসেবে কোন পুরুষ যদি ১০০ টাকা পান সেখানে একজন নারীর শ্রমমূল্য ধরা হয় ৭৫ টাকা। সাত বছর আগেও নারীরা পেতেন মাত্র ৪৮ টাকা। শ্রমের ধরন এবং সময়ের কোন তারতম্য নেই। পার্থক্য তৈরি করা হয় শুধুমাত্র মজুরি দেয়ার বেলায়। নারীদের শ্রমশক্তির এমনতরো অবমূল্যায়ন সভ্যতার চরম উৎকর্ষের যুগে তা কল্পনাও করা যায় না। মানব সভ্যতা আজ সমৃদ্ধির শীর্ষে। সারা বিশ্ব জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। তথ্যপ্রযুক্তি তার সম্ভাবনার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীজুড়েÑ এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীরাও সমান তাহলে নিজেদের তৈরি করছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও নতুন কিছু উদ্ভাবনে নারীরা সেভাবে পিছিয়েও নেই। কিন্তু কৃষি অর্থনীতিতে নারীর শ্রম বিনিয়োগ থেকে আরম্ভ করে অনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে নারীরা কেন বঞ্চনার শিকার হচ্ছে তা বলা মুশকিল। নারী-পুরুষের এই বিভেদনীতির বিরুদ্ধে নারীদেরই সচেতন হতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিকারের পথও খুঁজে বের করতে হবে। মানুষের মূল্যবান শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করতে নারী-পুরুষের তারতম্য করা অন্যায়, অবিচার এবং কিছুটা নির্যাতনও বটে। সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রেও এ পার্থক্য অনাকাক্সিক্ষত। নারীরা যাতে মানুষ হিসেবে তার সমান- মর্যাদা এবং অধিকারের ন্যায্য পাওনা পেতে পারেন সে ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা আবশ্যক।
×