ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

ব্রিক্সিট নিয়ে যত কথা

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৬ আগস্ট ২০১৬

ব্রিক্সিট নিয়ে যত কথা

(গতকালের পর) যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংক্রান্ত (লিসবন) চুক্তির ৫০ ধারা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। এই পদক্ষেপ অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার আনুষ্ঠানিক অভিপ্রায় বা প্রস্তাব যুক্তরাজ্যের তরফ থেকে উপস্থাপিত করার পর অন্যান্য ২৭ সদস্য ইউনিয়ন সম্পর্কিত ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পনীতি এবং সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা আলোচনা করে যুক্তরাজ্যের ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করতে পারে। যেহেতু এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোন দেশ সদস্যপদ থেকে বেরিয়ে আসার প্রস্তাব দেননি বা প্রক্রিয়াজাত করেননি সেহেতু যুক্তরাজ্য কর্তৃক উপস্থাপনীয় প্রস্তাবের বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে ন্যূনপক্ষে দু’বছর লাগবে এবং যুক্তরাজ্যের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার পূর্ণ মূল্যায়নের আলোকে যুক্তরাজ্য নরওয়ের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে ইউনিয়নের অর্থনৈতিক অঞ্চলের সদস্য হিসেবে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। গত ২১ জুলাই থেরেসা মে জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মের্কেলের সঙ্গে আলোচনার পর বলেছেন সজ্ঞানভিত্তিক ও শৃঙ্খলার সঙ্গে ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে সময় প্রয়োজন হবে। তিনি এক্ষেত্রে অবশ্য যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট গৃহীত ১৯৭২ সালের ইউরোপীয় সম্প্রদায় আইন রহিতকরণের বাধ্যবাধকতার কথা বলেননি। মের্কেল এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে আসতে বিলম্বের প্রয়োজন স্বীকার করেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হোল্যান্ড ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সঙ্গে ব্রিক্সিটের ভিত্তিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া লক্ষ্যানুগ হবে না বলে মত প্রকাশ করেন। নিকট প্রতিবেশী আইরিশ প্রধানমন্ত্রী কেনি যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া পছন্দ করেননি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর বাইরে ইউনিয়নের অর্থনৈতিক অঞ্চলের সদস্য হিসেবে থাকলে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সব দেশে শুল্কমুক্ত রফতানি এবং ওই সকল দেশ হতে শুল্কবিহীন আমদানি করতে সক্ষম হবে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে এই সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দেয়ার প্রক্রিয়ায় কোন ভোটের অধিকারী যুক্তরাজ্য হবে না এবং এই কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিচালনাক্রমে আরোপিত চাঁদা দিতেও বাধ্য থাকবে না। বলা প্রয়োজন, এই অবস্থানের অনুকূলে যুক্তরাজ্য পদক্ষেপ নিলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করার প্রাথমিক পর্যায়ে ইউনিয়নের কয়লা ও ইস্পাত সম্প্রদায় গঠন করার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য যে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিল তার ঐতিহ্য থেকে নিজকে বিচ্যুত করবে। ব্রিক্সিট কার্যকর হওয়া সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকা প্রয়োজন। এক. ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করে অনেকেই যুক্তিসঙ্গতভাবে আশা পোষণ করেছেন যে, যথাসময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ভিত্তি করে আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্বপারে একই মহাসাগরের পশ্চিমপারে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়ে যাবে এবং তা হলে জাতি, বর্ণ ও অবস্থান নির্বিশেষে পারস্পরিক সংঘাতবিহীন একটি কল্যাণমুখী বিশাল রাষ্ট্র গঠন করে ইউরোপীয় মহাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রগতির প্রক্রিয়াকে ব্যাপকতর ও দ্রুততর করা সম্ভব হবে। ব্রিক্সিটে নিঃসন্দেহে এই আশা রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তর পিছিয়ে যাবে। বিশেষত আটলান্টিক মহাসাগরের দুই তীরে অবস্থিত সকল দেশ নিয়ে বিশাল মুক্তবাণিজ্য এলাকা গঠন করার যে প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমন্বিত হয়েছে তার বাস্তবায়ন পিছিয়ে যাবে। দুই. ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সকল দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা যে উদার সহায়তা এবং ওই সব দেশে শুল্কমুক্ত বা স্বল্প শুল্কভিত্তিক রফতানির সুযোগ পেয়ে এসেছি তা আনুপাতিকভাবে যুক্তরাজ্য থেকে পাওয়ার জন্য পৃথক সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী ও জটিল রূপ নিতে পারে। তিন. ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে এলে ইউনিয়নের নেতৃত্বে ফ্রান্স ও জার্মানি উঠে আসবে এবং এই প্রক্রিয়ায় বার্লিন দেয়াল বিলুপ্ত হওয়ার পর যে সব পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ইউনিয়নভুক্ত হয়েছে তাদের প্রভাব বাড়বে। সে কারণে আগেকার কমেকন (ঈঙগঊঈঙঘ) জোটের আদলে রাশিয়ার নেতৃত্বে বা সমর্থনে প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থনৈতিক ইউনিয়ন এবং সেই লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী পৃথক মুক্তবাণিজ্য এলাকা গড়ে উঠবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক পৃথিবীব্যাপী মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, প্রথম মহাযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ প্রভাব কমে যায় এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্র্রাজ্যের সূর্য অস্তে চলে যায়। ব্রিটিশ সাম্র্রাজ্যের সূর্য অস্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশের স্বাধীনতাকামী ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী জনতা। বলা চলে মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীব্যাপী ঔপনিবেশিকবাদের সমাপ্তি টেনে আনেন। আর এই প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস ঘটনাবলী এবং তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে প্রতিভাত হয় যে, এখন ব্রিটিশ জনগণের সমর্থনেই ইউরোপ তথা বিশ্বের এক সতেজ ও সক্রিয় অংশ থেকে ব্রিটিশ প্রভাব প্রত্যাহৃত হতে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন ও বিবর্তন সম্পর্কে ব্রিক্সিটবাদীরা সচেতন আছেন বলে ব্রিক্সিটকেন্দ্রিক ঘটনাসমূহ ইতিবাচক সাক্ষ্য দেয় না। তদুপরি ব্রিক্সিটকে কেন্দ্র করে যে মতপার্থক্য একদিকে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের সঙ্গে অন্যদিকের স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যে ঘটেছে তা যুক্তরাজ্যকে একটি সংহতিবিহীন দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। (সমাপ্ত) লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী
×