ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী দমনে জাতীয় ঐক্য কোথায় কিভাবে হবে

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ২৪ জুলাই ২০১৬

জঙ্গী দমনে জাতীয় ঐক্য  কোথায় কিভাবে হবে

আমরা এখন একটা যুদ্ধে লিপ্ত আছি। যুদ্ধটা মূলত রাজনৈতিক, যেখানে এক পক্ষ রাজনৈতিক ফ্রন্টে সুবিধা করতে না পেরে গোপনে তৈরি সশস্ত্র জঙ্গীদের মাঠে নামিয়েছে দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে। সশস্ত্র জঙ্গীদের শেকড় অর্থাৎ তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রণেতা ও গুরু এবং আশ্রয়, অর্থ, অস্ত্র ও মন্ত্রদাতাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ না করে আমরা শুধু জঙ্গীদের পেছনে ছুটছি। তাতে পরোক্ষভাবে হলেও শত্রুপক্ষের মূল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অটুট থাকছে। ফলে উৎপত্তিস্থল বহাল থাকায় যত জঙ্গী ধরা হচ্ছে তার সমসংখ্যক বা বেশি নতুনভাবে অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামছে। এটাকে ইংরেজীতে বলা হয়Ñ ঊহফষবংং চৎড়পবংং, অর্থাৎ এর কোন শেষ নেই। ২০১৩ সালের পর সংঘটিত জঙ্গী তৎপরতার বিশ্লেষণে মনে হয় নিজেদের মেন্টর ও গডফাদারদের রাজনীতিকে বাংলাদেশে টিকিয়ে রাখাই এখন তাদের আপাত বা ইমেডিয়েট লক্ষ্য। এ প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক মিত্র পক্ষ ও বুদ্ধিজীবীদের তারা মাঠে নামাতে সক্ষম হয়েছেন। লেখার এই পর্যায়ে প্রসঙ্গের খাতিরে চলমান যুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের পরিচয়টা আরেকবার তুলে ধরা দরকার বলে মনে করছি। জঙ্গীদের সঠিক পরিচয় তুলে ধরার জন্য লম্বা তত্ত্বীয় কথা বলতে গেলে কলামের স্পেসে কুলাবে না। তাই শুধু সশস্ত্র তৎপরতার সূত্র ধরে তাদের সঠিক পরিচয়টা তুলে ধরার চেষ্টা করব। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে আক্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গীদের সশস্ত্র তৎপরতা শুরু। এরপর থেকে তারা এ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে এবং ২০০৪-২০০৫ সালে এসে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং আদালতসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ চালায়। তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশের একটি অংশে অর্থাৎ রাজশাহীর বাগমারায় জঙ্গীরা নিজস্ব শাসনও চালু করে। ওই স্থানীয় জঙ্গী শাসনের প্রতি সরাসরি সহায়তার হাত বাড়ায় রাজশাহীর পুলিশ প্রশাসন। তৎকালীন সরকার সব দেখেও না দেখার ভান করে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। জঙ্গী দমনে প্রকৃত অর্থে জিরো টলারেন্স নীতির সঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সশস্ত্র বিদ্রোহীদের তল্পিতল্পাসহ বাংলাদেশ থেকে উৎখাত করার ফলে কোল্যাটারাল ইফেক্টের কারণে ২০০৯ সাল থেকে গুলশান আক্রমণের আগ পর্যন্ত জঙ্গীরা ২০০৪-২০০৫ সময়ের মতো বড় আকারের সশস্ত্র তৎপরতা চালাতে পারেনি। ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর ধরে তারা টার্গেট করেছে। আক্রমণের শিকার কারা হয়েছেন, হত্যাকা-ে কাদের প্রাণ গেছে? এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তরের প্রতি নজর দিলে জঙ্গীদের মেন্টর, গডফাদার অর্থাৎ মূল শত্রুকে চিনতে আর অসুবিধা হয় না। আক্রান্ত হয়েছেন তারাই, যারা মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শনে বিশ্বাসী অর্থাৎ রাষ্ট্রকে প্রকৃতপক্ষে পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থায় দেখতে চান এবং রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি হিসেবে বাঙালী সংস্কৃতিকে প্রধান অবলম্বন মনে করেন, এরাই এ যাবত জঙ্গীদের টার্গেট হয়েছেন, এর বাইরে অন্য কারও গায়ে একটা টোকাও লাগেনি। তারপর ২০০৪-২০০৫ সালে জঙ্গীরা আদালত প্রাঙ্গণ ও বিচারকদের ওপর আক্রমণ চালায়, সেøাগান দেয়Ñ তাগুতি অর্থাৎ মানবসৃষ্ট আইন নয়, তাদের মতানুসারে তারা যেটাকে আল্লাহর আইন বলছে সেই অনুসারে রাষ্ট্র চালাতে হবে। তারপর ২০১৩ সাল থেকে গুপ্তহত্যা ও টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন ওই একই প্রগতিমনা ও অসাম্প্রদায়িক দর্শনের মানুষ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ, ধর্মযাজক এবং বিদেশী নাগরিক। ২০১৪ সালে ভারতের মুর্শিবাদের খাগড়াগড়ে ধরা পড়া বাংলাদেশী জেএমবি ও সিঙ্গাপুরে আটক হওয়া জঙ্গীদের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনাকে হত্যা ও তার সরকারকে উৎখাত করাই জঙ্গীদের এখন ইমিডিয়েট লক্ষ্য। সুতরাং ওপরে উল্লিখিত জঙ্গীদের আক্রমণের শিকার যারা হয়েছেন, জঙ্গীদের সেøাগান, জঙ্গী তৎপরতার সময় ও স্থান বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয় এই জঙ্গীদের মূল শেকড়ে আছেন তারাই, যারা বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চান এবং যারা মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শনের বিরুদ্ধে, বাঙালী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। প্রশ্ন হলোÑ এই উদ্দেশ্যগুলো অর্জন করার জন্য এখন কারা কাজ করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্টত কি আঙ্গুল জামায়াত-শিবির এবং তাদের দিকে যায় না, যারা এক সময়ে সেøাগান দিয়েছেনÑ আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান। সরকার দলসহ মুক্তিযুদ্ধের দর্শনে বিশ্বাসী সব দল ঐক্যবদ্ধভাবে চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক যুদ্ধ চালাচ্ছে এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জামায়াতের দ্বিতীয় ফ্রন্ট সশস্ত্র জঙ্গীদের দমন করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। গুলশান ট্র্যাজেডির পর সারা বিশ্বের মানুষ ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র এবং সরকারগণ নিঃশর্তভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গীদের মূল শেকড় জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রেখে জনমতের চাপে বিএনপি এখন বলছে, তারা জঙ্গী দমনে জাতীয় ঐক্য চায়। ঐক্যের কথা ভাল। কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। প্রশ্ন হলোÑ বিএনপি একটি বড় দল, তারা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল, তাদের ক্ষমতাকালে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বর্তমানের চাইতেও ভয়াবহ জঙ্গী তৎপরতা হয়েছে, তাদের পক্ষে পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীকুলেরও অভাব নেই, তারা জঙ্গীদের শেকড় বা মূল শত্রুকে কি চিহ্নিত করতে পেরেছেন? যদি চিহ্নিত করতে না পেরে থাকেন, তাহলে তারা বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে এবং সরকার পরিচালনার সময় জঙ্গীদের শেকড় চিহ্নিতকরণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের বুদ্ধিজীবীদের বেলায়ও একই কথা খাটে। তাহলে বলা যায়, এই ইস্যুতে ব্যর্থ রাজনৈতিক দল এবং ১৬-১৭ বছর পর্যবেক্ষণের পরেও তাদের বুদ্ধিজীবীরা মূল শত্রু চিহ্নিতকরণে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের সঙ্গে ঐক্য করে সরকারের কোন ফায়দা হবে না। ১৬-১৭ বছর পর্যবেক্ষণের পরে যারা জঙ্গীদের শেকড় চিনতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা কোন সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন না। আর তারা যদি শত্রু চিনে থাকেন, তাহলে নিজ অবস্থান থেকে প্রকাশ্যে শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় ঐক্য হয়ে যায়। ইতিহাসের পাতা থেকে একটা উদাহরণ দেই। অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার ১৯৪১ সালের জুন মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল পার্লামেন্টে বক্তৃতার সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। এর আগে চার্চিল বরাবরই সোভিয়েত ইউনিয়নের কট্টর বিরোধিতা করেছেন। তাই একজন সংসদ সদস্য চার্চিলের এই ইউটার্ন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন। উত্তরে চার্চিল বলেন, দানবীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে তারা মানবসভ্যতা ও গণতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য সবদিকে থাবা বিস্তার করছে, এই দানবকে পরাজিত করে যদি আমরা টিকে থাকতে পারি, তাহলে আদর্শের শত্রুর সঙ্গে পরেও রাজনৈতিক ও কৌশলগত যুদ্ধ চালানো যাবে, তা না হলে সকলেই ধ্বংস হয়ে যাব। চার্চিলের এই কথা আজ জঙ্গী দমন ইস্যুতে বিএনপির জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। এতদিন বিএনপির নেতা ও বুদ্ধিজীবীগণ বলে আসছেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশে গণতন্ত্র না থাকার কারণে নাকি জঙ্গীদের উত্থান ঘটেছে। এ কথা ঠিক হলে তাদের উত্তর দিতে হবে। ২০০৪-২০০৫ সময়ে তাদের শাসনামলে কি করে বড় বড় আক্রমণ চালিয়ে জঙ্গীরা শত শত মানুষকে হত্যা করল? তাদের এ-ও বলতে হবে আমেরিকা ইউরোপ গণতন্ত্রের উদাহরণ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে তাদের দেশের ভেতরে কি করে হাজার হাজার জঙ্গীর জন্ম ও উৎপত্তি হলো? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনে কিভাবে সব দল অংশ নিতে পারে এবং কিভাবে সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগ বাড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেছিলেন। দুই নেত্রীর কথোপকথনের ভিডিও চিত্র পরবর্তী সময়ে দেশ-বিদেশের অনেকেই দেখেছে। সেই কথোপকথনে বেগম খালেদা জিয়ার ভাষা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও টোন কেমন ছিল সেটিও সবাই লক্ষ্য করেছে। এ বিষয়ে কোন মন্তব্য না করে সাম্প্রতিক একটা উদাহরণ দিতে চাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা বেশ কয়েক মাস ধরে তুঙ্গে আছে। মাসখানেক আগে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসন ইস্যু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ইমিগ্রান্ট সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে যে রকম অসংলগ্ন ও কটুবাক্য ব্যবহার করেছেন, সে সম্পর্কে সাংবাদিকরা হিলারি ক্লিনটনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে হিলারি বলেন- ঞযব ঢ়বৎংড়হ যিড় পধহ হড়ঃ ংঢ়বধশ রহ ফরমহরভরবফ ঃযব ষধহমঁধমব, যব রং াবৎু ফধহমবৎড়ঁং ঃড় নবপড়সব ঃযব ংঁঢ়ৎবসব পড়সসবহফবৎ ড়ভ ‘টঝ’. জাতীয় সঙ্কটের সময় আপোস, ঐক্য অপরিহার্য। কিন্তু প্রথমে পূর্ব পকিস্তান ও পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের ঐক্যের ইতিহাস সুখপ্রদ নয়। ঐক্য করতে গিয়ে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়েছে। তবে এ কথাও ঠিক, রাজনৈতিক দল ও নেতারা ঐক্য গঠন এবং তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হলেও পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে জনগণের ঐক্য হয়েছে এবং তার ধারাবাহিকতায় আমরা সংগ্রামে থেকে স্বাধীনতায় পৌঁছেছি। আমার এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং নির্বাচনের আগে ও পরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে। আরও পাওয়া যাবে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা প্রণয়নের আগে ও পরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে। আবার ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে সুদৃঢ় থাকলেও বাঙালী অনেক বড় নেতা নির্বাচন বয়কট করেছিলেন। কিন্তু মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেয়। ভোটের ফলে দেখা যায়, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ম্যান্ডেট পায়। সত্তরের নির্বাচন না হলে এবং তাতে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে স্বাধীনতা অর্জন হতো সুদূরপরাহত। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণ অতীতে ভুল করেনি, এখনও করছে না এবং ভবিষ্যতেও করবে না। জঙ্গী দমনে জনগণের ঐক্যের একটা আলামত এখন সর্বত্রই ফুটে উঠছে। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×