ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

সাবরীর কাওয়ালী আর শোনা যাবে না

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ২১ জুলাই ২০১৬

সাবরীর কাওয়ালী আর শোনা যাবে না

পাকিস্তানের জনপ্রিয় কাওয়ালী সঙ্গীতশিল্পী আমজাদ সাবরী গত ২২ জুন তালেবানী হামলায় নিহত হয়েছেন। সকালে করাচীর এক কাওয়ালী আসরে যাওয়ার পথে মোটরসাইকেল আরোহী দুই আততায়ী তার গাড়িটি বুলেটে ঝাঁজরা করে দেয়। গুলিবিদ্ধ আমজাদ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমজাদ সাবরী শুধু পাকিস্তানের নয়, দক্ষিণ এশিয়ারও সবচেয়ে খ্যাতনামা কাওয়ালী গায়ক। তার বাবা গোলাম ফরিদ সাবরী ও চাচা মকবুল আহমেদ সাবরীও কাওয়ালী শিল্পী ছিলেন। সেই তানসেনের সময় থেকে তাদের পূর্ব পুরুষরা কাওয়ালী গেয়ে এসেছেন। এই সেই তানসেন যিনি মুঘল সম্রাট আকবরের রাজদরবারের সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন এবং প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করে এক লাখ স্বর্ণ মুদ্রা লাভ করেছিলেন। করাচীর সাবরী ভবনটি হারমোনিয়াম, তবলা ও নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রে পরিপূর্ণ। কাওয়ালী দক্ষিণ এশিয়ার অতিন্দ্রীয় সুফী ইসলামের লাখ লাখ অনুসারীর প্রিয় সঙ্গীত। কাজেই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে কাওয়ালী সঙ্গীত পরিবারের সন্তান আমজাদ সাবরীও এই সঙ্গীতের দিকে ঝুঁকবেন। সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি কাওয়ালীর আসরে গিয়ে কণ্ঠ মেলাতেন। সেই ভোর চারটা থেকে শুরু হতো এই সঙ্গীতের চর্চা। বাবা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। প্রাতক্রিয়াদি সেরে ওজু করে নামাজ আদায়ের পর নিজের বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে এসে গাইতেন প্রভাতের প্রথম রাগ। এ যেন সূর্যোদয়ের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রস্তুতি। আমজাদ জানতেন কাওয়ালী সাধারণ কোন গান নয়। এ হচ্ছে মহানবী মোহাম্মদ (দ), তাঁর ঘনিষ্ঠতম সাহাবী ও জামাতা আলী, সুফি সাধকবৃন্দ এবং সর্বোপরি সরাসরি আল্লাহর প্রতি ভালবাসার সঙ্গীত। এই সঙ্গীতই আল্লাহর সমীপে উপনীত হওয়ার একমাত্র নিশ্চিত উপায়। এই সঙ্গীতের সুর ও কথাগুলো যেন হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনের সঙ্গে, প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে যেত। বাবা শুধু কাওয়ালী গাইতেন না, গানও রচনা করতেন। তাঁর একটি বিখ্যাত গান ‘তাজদার-ই-হারাম’। আমজাদ, তার বাবা ও চাচারা যখন কাওয়ালী গাইতেন তাদের সুরের মূর্ছনায় শ্রোতারা আন্দোলিত হতো। তাদের শরীর দুলত। গাইতে গাইতে তারা তালি মারত, নাচত এবং ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে যেন আল্লাহর নৈকট্যলাভের পরমানন্দ লাভ করত। গানের মাঝখানে কখনও কখনও আল্লাহ! আল্লাহ! বলে কেঁদে উঠতেন তার বাবা। আবেগময় সেই মিনতিপূর্ণ প্রার্থনার আবেদন এতই প্রবল যে কাওয়ালী অনুষ্ঠানে উপস্থিত অমুসলমানও তাঁর অনুকরণে আল্লাহ! আল্লাহ! বলে ডেকে উঠত। বড় হয়ে আমজাদ তাঁর বাবার এই সুরের ধারা, এই স্বরলিপি অক্ষুণœ রাখতে বিশেষ যতœবান ছিলেন। তার মতো করেই তিনি গাইতেন এবং দর্শক-শ্রোতাদের ওপর তা প্রভাব রাখত। তার কাওয়ালী পরিবেশনার মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে শান্ত সমাহিত ভাব, আস্থা ও আনন্দ বিকীয়িত হতো। লম্বা-চওড়া গড়নের বিশালদেহী মানুষ ছিলেন আমজাদ। উজ্জ্বল, লম্বা কালো কেশদাম কাঁধের ওপর বিন্যস্ত থাকত। বাদামি রঙের কালারফুল টুপি শোভিত থাকত মাথায়। একটা ছোট সোনার দুল পড়তেন এক কানে। হাতের আঙ্গুলগুলোয় থাকত রং বেরঙের পাথরে খচিত বেশ কয়েকটি আংটি। গাইবার সময় মুখে ঝিলিক খেয়ে যেত হাসি এবং অপরূপ ভঙ্গিমা। তাঁর বিখ্যাত একটি গান ছিল ‘ভর দো ঝোলি’ অর্থাৎ ঝোলাটি পূর্ণ করে দাও। কথাগুলো ছিল এ রকম ‘আমার ঝোলা পূর্ণ করে দাও হে প্রভু, আমাদের সকলের ঝোলা পূর্ণ করে দাও। শূন্য হাতে ফিরতে চাই না। ঝোলা পূর্ণ করে দাও!’ আমজাদ সুফিদের মাজারগুলোতে গাইতেন। মাদুরে বসে এক পায়ের ওপর আরেক পা আড়াআড়িভাবে রেখে গাইতেন। আবার উজ্জ্বল আলোয় ফ্লেমিঙ্গোর মতো গোলাপী রঙের কোর্তা চড়িয়ে রকস্টারদের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও গাইতেন। টিভিতে সকালের অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত কাওয়ালী পরিবেশন করতেনÑ বিশেষ করে রমজান মাসে। গোটা দক্ষিণ এশিয়াতে কাওয়ালী গেয়েছেন তিনি। ভারত ও বাংলাদেশে তিনি ছিলেন রীতিমতো একজন তারকা। কাওয়ালীকে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকায়ও নিয়ে গিয়েছিলেন। বলিউডের আমন্ত্রণে তিনি সেখানকার ছায়াছবিতেও গান গেয়েছিলেন। বলিউডের নায়িকারা তার সঙ্গে ছবি তুলেছিল। কিন্তু তত দিনে স্বদেশে তার জন্য অনেক বড় বিপদ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানী তালেবানদের টার্গেটের তালিকায় নাম উঠে গেছে তাঁর। পারস্যের মাটি থেকে উদ্ভূত সুফি মতবাদকে তারা ক্ষয়িষ্ণু চিন্তাধারা হিসেবে দেখে। সুফি মতানুসারীরা পীর ফকিরের ভক্ত। তারা শিল্পকলা, সঙ্গীত ও নৃত্যের মধ্য দিয়ে ইসলামের যেভাবে গুণকীর্তন করে তালেবানদের দৃষ্টিতে তা চরম অধর্ম এবং ইসলামের ঘোরতর অবমাননা। এভাবেই মৃত্যু পায়ে পায়ে কখন তার শিউরে এসে দাঁড়াল টের পেলেন না আমজাদ সাবরী। ২২ জুন ঘাতকের গুলিতে নিহত হওয়ার পর তাঁর হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করে তালেবানরা। বাবা গাইতেন কাওয়ালী। চাচা গাইতেন কাওয়ালী। তাদের মতো করে কাওয়ালী গাইতে গিয়ে জীবন দিলেন আমজাদ সাবরী। টিভিতে তার পরিবেশিত শেষ কাওয়ালীর কথাগুলো ছিল ‘কবরের অন্ধকূপে যখন শিহরিত হতে থাকব তখন আমায় দেখো হে প্রিয় নবীজি। সূত্র : দি ইকনোমিস্ট
×