ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিয়াজুল হক

পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৭ জুলাই ২০১৬

পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি

সারা বিশ্বে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে সৃষ্টি হয় পানি সঙ্কট। পৃথিবীতে প্রাপ্ত মিষ্টি পানির প্রায় শতকরা ৭০ ভাগই খাদ্য উৎপাদনে কৃষকরা ব্যবহার করেন। শিল্প-কারখানায় ব্যবহার করা হয় প্রায় ২০ ভাগ এবং শতকরা ১০ ভাগ মিষ্টি পানি ব্যবহার করা হয় ঘরের কাজে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে, অন্যদিকে অপরিশোধিত ও পয়ঃবর্জ্য ফেলে ভয়াবহ পানিদূষণ করা হচ্ছে অহরহ। গত দশকে পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হলেও বিশ্বে এখনও ৭৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায় না। সঠিকভাবে পানি সম্পদের ব্যবহার না হওয়ার কারণে মূলত এই সমস্যা। বাংলাদেশ কাগজে কলমে এখনও নদীমার্তৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও পানি একাধারে আমাদের জন্য আশীর্বাদ ও অভিশাপ। কারণ এদেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি পানির ওপর নির্ভরশীল। অপরদিকে প্রতিবছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি কারণে দেশের সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন-বন্যা, খরা ইত্যাদির প্রধান কারণ অতিরিক্ত পানি কিংবা পানির স্বল্পতা। এই সমস্যাকে চিহ্নিত করা এবং যথাযথভাবে পানিকে শুধু উপযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে প্রয়োজন সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে পানি ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক। খাদ্য উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে খাদ্য সরবরাহে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন প্রয়োজন, যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রজন্মের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। পানি সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন এবং সমবণ্টন করতে পারলে সেচ ব্যবস্থায় আরও পরিবর্তন আসবে, যা নিশ্চিতভাবেই খাদ্য সরবরাহে বড় অবদান রাখতে পারে। ২০২৫ সালে ১৮ কোটির অধিক লোকের খাদ্য সরবরাহের জন্য দেশে কমপক্ষে ৪৩ মিলিয়ন টন চাল উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মৎস্য সম্পদ রক্ষার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ এক সময় মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। প্রাকৃতিক মৎস্যগুলো দিনে দিনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ মৎস্য সম্পদের সংরক্ষণ ও রক্ষাকল্পে প্রয়োজন পরিকল্পিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুত কেন্দ্রটি অবস্থিত চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে। ১৯৬২ সালে কর্ণফুলী নদীর তীরে ৪৬ মেগাওয়াট করে দুটি ইফনিট নিয়ে কেন্দ্রটির যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এই কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নতুন জলবিদ্যৎ প্রকল্প আমাদের বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে সাহায্য করবে, যার দ্বারা নতুন শিল্প কারখানায় বিদ্যুত সরবরাহ করা সহজ হবে এবং বৃদ্ধি পাবে উৎপাদন ক্ষমতা। পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী ম্যান্ডেটগুলো হলো, এগ্রো ইকোলজিক্যাল জোনভিত্তিক বিরূপ আবহাওয়াতে লাগসই ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উদ্ভাবন। সেচনির্ভর এলাকায় পানি ব্যবহারের দক্ষতা বাড়ানোর কলাকৌশল উদ্ভাবন। শস্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের কৌশল উদ্ভাবন। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কলাকৌশল উদ্ভাবন। পানির গুণাগুণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভূগর্ভস্থ’ পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই সেচ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা। ভূপরিস্থ ও ভূগভস্থ পানির সম্বনিত ব্যবহারের জন্য মডেল তৈরির মাধ্যমে পানি সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা। লবণাক্ত এলাকায় পানি সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো নিশ্চিত করা। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ পাম্পের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। ড. মশিউর রহমান এক প্রতিবেদনে পানি ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ এবং গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, ‘পানি সংক্রান্ত বহু সমস্যা ও অনিষ্পন্ন বিষয়াদি সমাধানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর মধ্যে সবচেয়ে সঙ্কটপূর্ণ হচ্ছে পর্যায়ক্রমিক বর্ষাকালে বন্যা ও শুকনো মৌসুমে পানির দুষ্প্রাপ্যতা, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও জনসংখ্যার কারণে পানির ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা, নদ নদীতে ব্যাপক পলিমাটি পড়ে ভরাট হওয়া এবং নদীভাঙন। লবণাক্ততা, ভূপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির মানের ক্রমাবনতি ও পানি দূষণসহ পানির সামগ্রিক গুণগত মানের ব্যবস্থাপনা এবং ভৌত ও জৈব পরিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণের প্রয়োজন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সীমিত সম্পদের মধ্যে বহুমুখী পানির চাহিদা মেটানো, দক্ষ ও সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল পানি ব্যবহারের উন্নয়ন, সরকারী ও বেসরকারী খাতের ভূমিকা চিত্রন ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বিকেন্দ্রীকরণের জরুরী তাগিদ অবশ্যই রয়েছে। সীমান্তের বাইরে উৎপত্তি হেতু সংশ্লিষ্ট নদীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অভাব, ব-দ্বীপস্থ সমতলভূমির জটিল ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামো নির্মাণে নিষ্কণ্টক জমির তীব্র অভাব- এ সমস্ত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই আমাদের এ কাজ সম্পাদন করতে হবে। সমাজের সামগ্রিক চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও পরিবেশগত দিক সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কারণে সরকারের ভূমিকা আজ তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে টেকশই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আওতায় পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য টার্গেট পূরণে কার্যক্রম গ্রহণ শুরু করেছে, যা অবশ্যই ইতিবাচক। দেশে পরিমাণ ও গুণগতভাবে পানির সঙ্কট এখনও বিদ্যমান। ইদানীং নলকূপ দিয়ে পাতাল থেকে তোলা হয় যে খাবার পানি তার মধ্যে ভয়ঙ্কর বিষ পাওয়া গেছে, যার নাম আর্সেনিক। বন্যার জন্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে বন্যা অববাহিকা অঞ্চলে যে পানি শাসন প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়, তা বিভিন্নভাবে প্রাকৃতি পানিপ্রবাহের ভারসাম্যের জন্য নেতিবাচক রূপে প্রত্যাবর্তন করছে। বর্ষা মৌসুমে একাধারে বন্যার কারণে যেমন নদী অববাহিকা অঞ্চলগুলো পলিসমৃদ্ধ হচ্ছে, তেমনি অনেক নদী অববাহিকা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের জন্য চাই উন্নত ও সুবিবেচিত পানি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। এজন্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা হতে হবে সমন্বিত, সুসংহত ও বিজ্ঞানসম্মত।
×