ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদ রহমান

এখনও উজ্জ্বল মিমু

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৩ জুলাই ২০১৬

এখনও উজ্জ্বল মিমু

তাঁর আমলের অনেকেই ক্রীড়াঙ্গন থেকে হারিয়ে গেলেও মাঠে ময়দানে এখনও ভীষণ উজ্জ্বল শামীমা সাত্তার মিমু। ক্রীড়ামহলে এবং পরিচিত জনের কাছে ‘মিমু’ নামেই যিনি বড় বেশি পরিচিত। একসময়ের সাড়াজাগানো এ্যাথলেট তিনি। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারও পেয়েছেন। বর্তমানে বিকেএসপির উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) হিসেবে কর্মরত আছেন। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে মিমুর প্রাণবন্ত সপ্রতিভ উপস্থিতি সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। জীবনের অনেক প্রয়োজনকে দূরে রেখে এখনও দিনি নিবিষ্ট দেশের প্রমীলা এ্যাথলেটদের উন্নয়ন নিয়ে। ওদেরকে নিয়ে নিত্য ছুটে চলেন দেশ ও দেশের বাইরে। ‘মেয়েরা যদি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট থেকে একটি দুটি পদক আনতে পারে’-এই কথাগুলো মিমুর বুকের মধ্যেই বসবাস। আর তাই সবকিছু পিছে ফেলে নিত্য ছুটে চলেন। সর্বশেষ ভারতের গোহাটি-শিলং-এ অনুষ্ঠিত ১২তম এসএ গেমসে তিনি বাংলাদেশ দলের মহিলা টিম ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই গেমস থেকে বাংলাদেশের মেয়েদের যে অনন্য অর্জন সেখানে শামীমা সাত্তার মিমুর অবদান কোনো অংশেই কম নয়। রাতদিন পরিশ্রম করে তিনি নারী এ্যাথলেটদের উজ্জীবিত ও উৎসাহিত করেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে সাহস ও পরামর্শ দেন। যার ফলাফলও তিনি দেশবাসীকে উপহার দিতে সক্ষম হন। এসএস গেমস থেকে শীলা, মাবিয়ারা দেশের জন্যে যে দারুণ সাফল্য বয়ে আনে সেই সাফল্যের নেপথ্যের তিনি অন্যতম একজন। ক্রীড়াঙ্গনে মিমুর এখন অনেক পরিচয়। একজন দক্ষ ক্রীড়াসংগঠক, বিচারক, ম্যাচ রেফারি হিসেবে এখন শুধু আর নিজ দেশ নয়, দেশের বাইরেও তিনি সমানভাবে সমাদৃত। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত শামীমা সাত্তার মিমু সত্তর ও আশির দশকে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের দাপুটে এক ম্যাথলেট ছিলেন। খেলেছেন দীর্ঘদিন ধরে। সে সময় স্প্রিন্ট, হার্ডলস, হাইজাম্প, লংজাম্প-ইভেন্টে তার ছিল সক্রিয় ও সরব উপস্থিতি। তবে বড় বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন মেয়েদের হাইজাম্প ইভেন্টে। জাতীয় পর্যায়ের লড়াই-এ প্রমীলাদের এই ইভেন্টে টানা ষোলোবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনন্য এক রেকর্ড এখনও তার করায়ত্তে। এই রেকর্ড এখনও অক্ষত রয়ে আছে। এখন পর্যন্ত কেউ এ রেকর্ড ভাঙতে পারেনি। মিমু এবং হাইজাম্প নামটি তাই একসময় প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল। মিমু যতদিন ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে ছিলেন ততদিন হাইজ্যাম্পে তার ধারের কাছেও আর কেউ আসতে পারেননি। বলা যায়, এখনও তার মতো কেউ আলো ছড়াতে পারেনি এই ইভেন্টে। আবার আন্তর্জাতিক আঙিনায় মহিলা ইভেন্টের জাম্প রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন কেবল তিনিই। এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, এ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনসহ বেশ কয়েকটি ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। খেলোয়ার, সংগঠক হিসেবে অনেক দেশে গিয়েছেন। অভিজ্ঞতার ঝুলিও তাই তার অনেক বড়। মিষ্টি চেহারার মিমুর ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে জাতীয় পর্যায়ের লড়াই-এ আগমন ঘটেছিল স্বাধীনতার পরপরই। ৭৩ সালে দিনাজপুর জেলাতে অনুষ্ঠিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, লংজাম্প এবং ট্রিপল জ্যাম্পে অংশ নিয়ে তিনি প্রথম হন। ঐ বছর দিনাপুর জেলা জাতীয় এ্যাথলেটিক্সে অংশগ্রহণ করে। ৭৩ সালে নিজ জন্মস্থান দিনাজপুর জেলা একাদশের পক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ক্ষুদে এক এ্যাথলেট হিসেবে অংশ নেন। বয়স তখন তাঁর ছিল মাত্র ১৩ বছর। প্রথম জাতীয় এ্যাথলেটিক্সের পর মিমুকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। জাতীয় এ্যাথলেটিক্সের প্রতিটি আসরেই তিনি বাজিমাত করার অনন্য কৃতিত্ব দেখান। তবে ৭৯ সালে হাইজ্যাম্পে প্রথম চমক দেখান তিনি। মিমু পরপর চারবার চ্যাম্পিয়ন মেরিনা খানম মেরীকে পেছনে ফেলে নতুন রেকর্ড গড়ে সেবছর চ্যাম্পিয়ন হন। শুধু রেকর্ড গড়াই নয়, প্রিয়দর্শীনি এ্যাথলেট হিসেবেও সবার মন জয় করেন তিনি। ৭৯ সাল থেকে টানা ৮৪ সাল পর্যন্ত মিমু চ্যাম্পিয়ন হয়ে এই ইভেন্টে একজন মডেল এ্যাথলেট হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই ইভেন্টে মিমু এতোটাই খবরদারিত্ব দেখান যে ৯২ সালের ২২ ডিসেম্বর ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডকে গুডবাই জানানোর দিনও মিমু প্রথম হয়েই বিদায় নেন। হাইজাম্প থেকে মিমু বিদায় নেয়ার পর তার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে আসেন সাথী পারভীন। সর্বশেষ বছরে বিটিএমসির হয়ে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াই-এ অংশগ্রহণ করেন। ফিল্ড এন্ড ট্র্যাকের লড়াই থেকে অবসরের পরপরই বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন বিটিএমসি)-এর ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। কিন্তু এ্যাথলেট তৈরির অদম্য বাসনায় পরবর্তীতে এ্যাথলেট কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এখানেও তিনি রেকর্ড গড়েন দেশের প্রথম নারী এ্যাথলেট কোচ হিসেবে। অবশ্য বিটিএমসি ছেড়ে এক বছর পরেই কোচ হিসেবে যোগ দেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তথা এনএসসিতে। এনএসসির কোচ হিসেবে তিনি দারুণ দক্ষতা দেখান। অবশ্য এর আগেই ভারতের পাতিয়ালা থেকে কোচিং-এর ওপর ডিপ্লোমা সাফল্যের সঙ্গে শেষ করে আসেন। উচ্চতরো প্রশিক্ষণ নেন জার্মান থেকেও। তার দক্ষ কোচিং-এর কারণেই ৯৬ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মহিলা ইসলামিক গেমসে এ্যাথলেট যুথি, ফিরোজা, নিলুফাররা কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করতে সক্ষম হন। অতঃপর টানা আট বছরের কোচিং জীবনের অবসান ঘটিয়ে বিকেএসপিতে যোগ দেন। ২০০২ সালের ৬ জুন নিজ জন্মভূমি দিনাজপুর বিকেএসপির উপ-পরিচালক হিসবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মিমুর গল্প এখানেই শেষ নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার অনেক জায়গাতেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় এ্যাথলেটিক্সের জাম্প ইভেন্টের একমাত্র মহিলা রেফারি হিসেবে অনন্য কৃতিত্ব তিনিই গড়েছেন। আবার নবম সাফ গেমসে এ্যাথলেটিক্সের জাজ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। মিমু একসময় যেমন এ্যাথলেট হিসেবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন আলোকিত করেছেন তেমনি এখন ব্যবস্থাপক, পরিকল্পক এবং প্রশাসক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। সবচেয়ে বড় কথা এক দীর্ঘসময় ধরে তিনি ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছেন। এ্যাথলেটিক্সে আলোকিত পথও রেখে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তবে নিজের মাঝে তাঁর অসন্তোষও আছে। বিশেষ করে সাফ লড়াই-এ হাই জাম্প ইভেন্ট থেকে কোনো পদক না পাওয়ার দুঃখ তাঁর রয়েই গেছে। শামীমা সাত্তার মিমু বলেন, টেকনিক্যাল সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণেই হাইজাম্পে এ দেশের এ্যাথলেটরা নারী-পুরুষ দু’বিভাগেই খুব বেশি দূরে এগুতে ব্যর্থ হয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতা টেনে তিনি বলেন, একসময় তারা বালুতে লাফিয়ে কম্পিটিশন করেছেন। অনেক পরে জাতীয় পর্যায়ের লড়াই-এ ফোমের সুবিধা দেয়া হয়। মিমু আরও বলেন, এখন জাতীয় পর্যায়ে হাই জাম্পের লড়াই-এ ফোমের ব্যবহার থাকলেও গ্রাসরুট পর্যায়েতো এ্যাথলেটরা বালুতেই লাফাচ্ছে। ফলে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা। মিমুর মতে, এ ধরনের ইভেন্টে ভাল ফলাফলের জন্য অবশ্যই সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। শুধু রাজধানী ঢাকাতে নয়, সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে জেলা পর্যায়েও, তবেই না ভাল ফলাফল করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। শামীমা সাত্তার মিমু আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের এক অন্যতম সাক্ষী। নিজে মাঠে খেলেছেন, খেলোয়াড় তৈরি করেছেন। মাঠ ছেড়ে যাননি, মাঠেই থেকেছেন। ফলে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিও অনেক বড়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরেছেন। আন্তর্জাতিক সব ইভেন্টে কখনও খেলোয়াড়, কখনও কোচ, কখনও ম্যানেজার, জাজ হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি মনে করেন বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীর নতুন এক অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে। এই অগ্রযাত্রার সূচক হলো আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং সাফল্য প্রাপ্তি। তাঁর মতে, নারী এ্যাথলেটরা এখন এ্যাথলেটিক্স, ক্রিকেট এবং ফুটবল এই তিনটি ধারাতে চমৎকার সব সাফল্য অর্জন করে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে সুরভিত এবং সৌন্দর্যময় করছে। সর্বশেষ এসএ গেমসের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলেন, ‘ভারতে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে যে সাফল্য সেখানে মেয়েদের সামগ্রিক অবদান পঁচাত্তর ভাগ, বাদবাকি ছেলেদের। দেশের পক্ষে অর্জিত চারটি সোনার তিনটিই নিয়ে এসেছে মেয়েরা। শিলা আর মাবিয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ওদের দুজনের সাফল্যই এবারের সাফ গেমসের বড় অর্জন।’
×