ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

সেই লর্ডস এই আমির

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২২ জুন ২০১৬

সেই লর্ডস এই আমির

জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ড সফর দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনটাকে নিজেই ‘পুনর্জন্ম’ বলে অভিহিত করেছিলেন মোহাম্মদ আমির। ইংল্যান্ডে আসন্ন টেস্ট সিরিজের দলে সুযোগ পাওয়া, অতঃপর ভিসা জটিলতার অবসান হওয়ায় এবার ‘সত্যিকারের’ ফেরার অপেক্ষায় বহুল আলোচিত পাকিস্তানী পেসার। ২০১০ সালে লর্ডস টেস্টে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। সেই লর্ডস দিয়েই ফের আভিজাত্যের সাদা পোশাকে ফিরতে যাচ্ছেন। আমির তাই ভীষণ রকমের আবেগাপ্লুত,‘যদি সত্যি বলি, এভাবে ফেরার কথা কখনও ভাবতে পারিনি। পাকিস্তানের হয়ে আবার টেস্ট খেলতে পারব... নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবান মনে করছি। সাদা পোশাকের ক্রিকেট নিয়ে আমি শিহরিত। লর্ডস দিয়ে ফিরতে পারছি বলে শিহরণটা আরও অনেক বেশি।’ সেই স্মৃতি স্মরণ করে আমির আরও যোগ করেন, ‘অপরিণত বয়সে করা এক মারাত্মক ভুলে এই লর্ডসেই আমার ক্যারিয়ার থেমে গিয়েছিল। হয়ত কাকতালীয়, কিন্তু ২০১০ সালে যেখানে থামতে হয়েছিল সেখান থেকে শুরু করতে পারাটা হবে আশীর্বাদ। স্পষ্ট মনে করতে পারি, ওই সিরিজে কিছু কাজ বাকি ছিল, এবার সেটা শেষ করতে চাই। এবার আমরা একমাত্র লক্ষ্য সিরিজের সেরা বোলার হওয়া, পাকিস্তানকে জয়ী হতে সাহায্য করা, এবং চমৎকার স্মৃতি নিয়ে শুরু করা। যা আমাকে নতুন পথের দিশা দেখাবে।’ ২০১০ সালে নিজেরই ভুলে জীবনে অভিশাপ নেমে এসেছিল। তৎকালীন অধিনায়ক সালমান বাট ও অপর পেসার মোহাম্মদ আসিফের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন স্পট ফিক্সিংয়ে। লন্ডনে জেলও খাটতে হয়েছিল (বয়স কম হওয়ায় কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে)। আবার টেস্ট খেলতে পারবেন, আমিরের যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রায়শ্চিত্ত করে আবার ভক্তহৃদয় জয় করতে চান, যেমনটা করেছিলেন আলোচিত সেই সিরিজে, ‘এরই মধ্যে ওয়ানডে-টি২০ খেলেছি। কিন্তু টেস্টে সঙ্গে তার তুলনা হয় না। এটাই হবে আমার সত্যিকারের ফেরা। আমি ফের লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম তুলতে চাই। ইংলিশ ক্রিকেটপ্রেমীদের সমর্থনও ফিরে পেতে চাই।’ ২০১০Ñএ আলোচিত ওই সিরিজে ১৮ বছর বয়সে নিজের প্রথম ইংল্যান্ড সফরে এই লর্ডসেই ৮৪ রান দিয়ে ৬ নিয়ে ইতিহাসে সর্বকনিষ্ট খেলোয়াড় হিসেবে অনার্স বোর্ডে নাম লিখিয়েছিলেন। ১৯ উইকেট নিয়ে ছিলেন সিরিজে পাকিস্তানের শীর্ষ শিকারি, যৌথভাবে পেয়েছিলেন ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ এর পুরস্কার। স্বপ্ন ও তার মৃত্যুÑ এক সঙ্গে মুদ্রার দু-পিঠ দেখা সেই স্মৃতি আমির ভোলেন কি করে? নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলেও ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়ানো ক্রিকেটারের আজীবন নিষিদ্ধ হওয়া উচিত বলেই মনে করেন আমির! সম্প্রতি ইংল্যান্ড অধিনায়ক এ্যালিস্টার কুকের দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এ কথা বলেন তিনি। অতীত ভুলে টেস্ট প্রত্যাবর্তনে কুক-স্টুয়ার্ট ব্রড’রা অবশ্য তাঁকে সাদর আমন্ত্রণই জানিয়েছেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরার পর দুরন্ত নৈপুণ্যে যখন জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পান তখনকার একটি ঘটনা, আমিরকে নেয়ায় মোহাম্মদ হাফিজসহ একাধিক সিনিয়র ক্রিকেটার ক্যাম্প বর্জন করেছিলেন। হাফিজের পায়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করেছিলেন আমির। প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ চেয়েছিলেন। অথচ নিষিদ্ধ হওয়ার আগে তিনি ছিলেন বিশ্বের আলোচিত উঠতি পেসার, তার মাঝে পাকিস্তানীরা গ্রেট ওয়াসিম আকরামের ছাঁয়া দেখতেন। বয়স ২৫ পূর্ণ না হলেও এই শেষ ছয় বছরে জীবন থেকে আমির অনেক কিছুই শিখেছেন। আসন্ন ইংল্যান্ড সফরের জন্য ডাক পেয়েছেন পাকিস্তান টেস্ট দলেও। কাকতালীয় পাকিরা এবার সিরিজের প্রথম টেস্ট খেলবে লর্ডসে (১৪ জুলাইÑ২০১৬ শুরু চার ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্ট), এখানেই ছয় বছর আগে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন ১৮ বছরের তরুণ। ভিসা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে ‘অসম্ভব ভাগ্যবান’ বলে অভিহিত করেছেন আমির। প্রায়শ্চিত্তের পথে দেশকে আরও বেশি কিছু দিতে মরিয়া ‘সেনসেশনাল’ বাঁহাতি-পেসার। জীবনের কঠিন ছয়টি বছরে অনেক কিছু শিখেছেন, অনেক পাল্টে গেছেন আমির ‘এটি ছিল আমার জীবনের কঠিনতম সময়। পুনর্জন্মের সুযোগ করে দেয়ায় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি), দেশবাসী এবং ভক্তদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের চাওয়া ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। দেশের ক্রিকেটের জন্য আমি আমার শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করব। এই কঠিন শিক্ষাটাই আমাকে বাড়তি অনুপ্রেরণা যোগায়।’ ২০১০ সালে পাকিস্তানের ইংল্যান্ড সফরে লর্ডস টেস্টে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পড়েন তৎকালীন অধিনায়ক বাট, অপর পেসার আসিফ ও আমির। দোষ প্রমাণিত হওয়ায় সব ধরনের ক্রিকেট থেকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন তারা। সেময় মাত্র ১৮ বছর বয়স ছিল আমিরের। লন্ডনে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে শাস্তি ভোগের পর চলতি বছরের শুরুর দিকে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরার অনুমতি পান তিনি। কলঙ্কিত ক্রিকেটারদের পুনরায় জাতীয় দলে ফেরানো নিয়ে পাকিস্তানজুড়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। গ্রেট জাভেদ মিয়াদাদ, এমনকি বর্তমান টি২০ অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদিও চাননি এদের ফেরানো হোক। তাদের যুক্তি ছিল, সেক্ষেত্রে ড্রেসিং রুমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। তাই তো উইকেট শিকার ও ভাল আচরণ দিয়ে আমিরের মন জয় করার এই প্রয়াস, ‘ফেরা নিয়ে কারও আপত্তি থাকলে আমি নিশ্চিত যে তারা এবার আমার আচরণ ও ভাল পারফর্মেন্স দেখে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবেন। আমি নিশ্চিত যে আরও ভাল খেলোয়াড়, আর ভাল মানুষ হয়ে তাদের মন জয় করতে পারব। এটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য।’ একই সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা, ‘আমি আমার অতীত ভুলের জন্য পরিবার, বন্ধুবান্ধব, দেশবাসী এবং সব ভক্তের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। বলে বোঝাতে পারব না, এই ভুলের জন্য ভেতরে ভেতরে আমি কতটা কষ্ট আমি পেয়েছি। ক্রিকেটের সেবা করেই তার মাসুল দিতে চাই।’ তবে সমর্থনও পেয়েছেন আমির। সাবেক তারকা ওয়াসিম আকরাম যেমন বলেন,‘একজন তরুণ ভুল করেছিল, তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। বয়সের বিবেচনায় ওকে আমাদের ক্ষমা করে দেয়া উচিত।’
×