ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

বাঙালী সুপারস্পাই মাসুদ রানা

প্রকাশিত: ০৭:০০, ৭ জুন ২০১৬

বাঙালী সুপারস্পাই মাসুদ রানা

তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, কিশোর ক্লাসিক, ওয়েস্টার্ন সিরিজ, কুয়াশা সিরিজ কিংবা রহস্য পত্রিকা- নামগুলো পরিচিত মনে হচ্ছে কি? লাল হলুদের চমৎকার লোগো... যদি এই শব্দগুলো আপনার কাছে নিছক শব্দের বাইরেও কিছু মনে হয়, তবে আপনার জীবনে একজন ভদ্রলোকের প্রভাব অনস্বীকার্য, ‘কাজী আনোয়ার হোসেন!’ বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারের দুর্লভ কিছু প্রাপ্তির মাঝে অন্যতম এদের বই পড়ার অভ্যাস, পাঠ্য বইয়ের ভাঁজের ভেতর লুকিয়ে গল্পের বই পড়া এবং ধরা খেয়ে বাবা-মা’র বকুনি খাওয়া আমাদের কৈশোরের সোনালি স্মৃতি। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন ও সাজেদা খাতুনের সন্তান কাজী আনোয়ার হোসেন পড়ালেখা করেছেন সেন্ট গ্রেগরিহাই স্কুল ও জগন্নাথ কলেজ থেকে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন তিনি। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে বাবার দেয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেসের যাত্রা শুরু করেন। আট হাজার টাকা দিয়ে কেনা একটি ট্রেডল মেশিন আর দুজন কর্মচারী নিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেসের শুরু, যা পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হয় সেবা প্রকাশনী (‘সেগুন’ শব্দের ‘সে’ এবং ‘বাগিচা’ শব্দের ‘বা’ নিয়ে ‘সেবা’)। লাল-হলুদ প্রজাপতির চিহ্ন ধারণ করা বইগুলো দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে আমাদের ক্লান্তিহীন আনন্দ দিয়ে আসছে। কাজী আনোয়ার হোসেন শুধু পাঠক সৃষ্টি করার ক্ষেত্রেই অবদান রাখেননি, তার হাত ধরে বেশকিছু স্বনামধন্য লেখক ও অনুবাদক বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিনায় পা রেখেছেন। হুমায়ূন আহমেদের মতো কালজয়ী লেখকও চরম আর্থিক কষ্টের সময় সেবা প্রকাশনী থেকে বই (অনুবাদ) বের করে টাকা পেয়েছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখায় সেই সাহায্যের জন্য কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রতি আকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বন্ধু গীতিকার মাসুদ করিমের নামের প্রথম অংশ ও আর নিজের প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্র রানা প্রতাপের নামের প্রথম অংশ মিলিয়ে মাসুদ রানার নামকরণ করেন কাজীদা। সাংবাদিক বন্ধু রাহাত খানের নামে নামকরণ বুড়ো মানে রানার বস মেজর রাহাতের চরিত্রটি। প্রথমে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের আর ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের (বিসিআই) প্রধান তিনি। রানার সহকর্মী ও বন্ধু সোহেল। আর আছে সোহানা চৌধুরী যে শুধু সহকর্মীই নয়, বান্ধবীও। প্রেমিকাও? হয়ত বা কখনও কখনও। গিলটি মিঞা অবশ্য সোহানাকে কখনও ‘বউদি’ সম্বোধন করেছে। আছে রানার চিরশত্রু পাগল বিজ্ঞানী প্রফেসর কবীর চৌধুরী। পাঠক ও ভক্তকুলের কাছে এই চরিত্রগুলোর আবেদনও কোন অংশে কম নয়। আত্মকেন্দ্রিক ও প্রচারবিমুখ এই নিভৃতচারী মানুষটি নিশ্চয়ই গর্ববোধ করতে পারেন বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে। বই পড়ার মতো চমৎকার অভ্যাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে যে তাঁর-ই আশ্চর্য রকম সহজাত লেখনীর মায়াবী পরশে! তিন প্রজন্মের কাছে আজ পত্রপল্লবে, ফুলে-ফলে, বৃহৎ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে মাসুদ রানা। বিপুল পাঠকসৃষ্টির এবং বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রথম কৃতিত্বও কাজী আনোয়ার হোসেনের। শুধু তাই নয়, প্রায় তিন প্রজন্মের পাঠকদের তার রচনা ঘিরে সমাবেশ ঘটিয়ে বাংলা রহস্যসাহিত্যের এক অনন্য ইতিহাসও তাঁর দখলে। এককালে মাসুদ রানা বা কুয়াশা পড়া পাঠকদের পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠার পরে এগিয়ে গেছেন বিশ্বসাহিত্যের অন্দরমহলে। প্রথমে রহস্যসাহিত্যে কুয়াশা সিরিজ দিয়ে শুরু, বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে। এর পরে সে সময়ের পাঠককুলকে চমকিত করে শুরু করেন মাসুদ রানা সিরিজ। যে সময়ে রহস্যসাহিত্যে রোমান্স প্রায় অদৃশ্য (বড়জোর ‘মোহন গাঢ় স্বরে ডাকিল, রানী’)। সেই রক্ষণশীল সমাজে উদ্দাম এক তরুণ স্পাই, কালক্রমে সুপার স্পাই মাসুদ রানা যেন এক ভূমিকম্প! লেখকের কলম সময়ের চাইতে এগিয়ে গিয়ে ফেঁসে গেল, তাঁর স্বর্ণমৃগ বইটি অশ্লীলতার দায়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কাপড়চোপড়ে ঢেকে পুনঃপ্রকাশিত হলো। বাংলাদেশে (তৎকালীন পাকিস্তানে) এই মামলায় কাজীদার আর্থিক ক্ষতি কি হলো জানি না, তবে মাসুদ রানার গুণগ্রাহী পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়। সে থেকে আজ পর্যন্ত, চিরতরুণ সে দেশপ্রেমিক আজও ছোঁ মেরে পাঠকদের নিয়ে যায় কল্পনার জগতে। সেখানে চার দশক ধরে নিপুণ বাস্তবতায় চিত্রিত মাসুদ রানার সঙ্গে পাঠকরা কখনও শিউরে উঠেন, কখনও আতঙ্কে দমবন্ধ হয়ে পরের পৃষ্ঠায় যান আর সবশেষে বিজয়ী মাসুদ রানার সঙ্গে বিজয়ীর হাসিটি হাসেন। মাসুদ রানা এক আন্তর্জাতিক সুপার স্পাই হয়েও অন্তরজুড়ে তার বাংলাদেশ। তাই নীলনয়না স্বল্পবেশ ব্লন্ডের চাইতে কৃষ্ণনয়না, শাড়িপরা লম্বাচুলের বাঙালী ললনা সোহনা অনেক দূর এগিয়ে যায়। তাই তো ইতালির অখ্যাত শহরে বিখ্যাত গিল্টি মিয়া ‘রিস্টুরেন্টে’ ঢুকে নির্বিকার চিত্তে এক পেলেট গরম ভাত আর সর্ষে ইলিশের অর্ডার দিয়ে দেয়। কে ভাবতে পেরেছিল থ্রিলারে শরতের আকাশ সুপার স্পাই মাসুদ রানার মনে রবীন্দ্রনাথ গুঞ্জরণ তোলে, ‘কাছে এলো পুজোর ছুটি, রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপা ফুলের রং, হাওয়ায় শিশির উঠছে শিরশিরিয়ে, মন লাগে না কোন কাজে।‘ অর্থাৎ মাসুদ রানা এক আবহমান বাঙালী, যার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। আমরা এতক্ষণ মাসুদ রানা নিয়ে বলেছি বলে এর অর্থ এই নয় যে কাজীদার সোনার হাতের স্পর্শে বুঝি শুধু মাসুদ রানাই জেগেছে। ভুল। মাসুদ রানার কোন্ পাঠক ভুলবেন গিল্টি মিয়া, কাঁচাপাকা ভ্রুরুর নিচের কঠোর চোখের রাহাত খান, সদা হাসিখুশি সলিল সেন, সেই উ-সেন, গগল, রেমারিক, এমন কি ইউসুফ কে? আর সোহানা? কাজীদার উদ্ভাবনী মস্তিষ্কের সৃষ্টি ওয়েস্টার্ন, তিন গোয়েন্দা, নিজেকে জান, ধূমপান ত্যাগে আত্মসন্মোহন জাতীয় অসাধারণ সিরিজ। যারা স্বাধীনতার আগের রহস্য পত্রিকা দেখেননি, তারা আসলেই বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের এক মহামূল্যবান দ্রষ্টব্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ধ্বংস পাহাড়। সে সময় মউত কা টিলা নামে বইটির উর্দু সংস্করণও বেরিয়েছিল। এ পর্যন্ত মাসুদ রানা সিরিজের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪৪৭। প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী সামসুল ইসলাম। মাসুদ রানার প্রথম দিকের বইগুলোর প্রকাশক ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন। ২০১৫ সালে তিনি মারা যান। চরিত্র পরিচিতিতে ‘মাসুদ রানা’র যে নামলিপি ছাপা হয় সেটার নক্সা করেছেন হাশেম খান। মাসুদ রানার প্রিয় অস্ত্র ওয়ালথার পিপিকে। কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজের সর্বাধিক জনপ্রিয় বই স্বর্গমৃগ, বিস্মরণ শত্রু ভয়ঙ্কর এবং আরও অনেক! [email protected]
×