ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

জয় বাংলা যেভাবে ছিনতাই হয়ে যায়

প্রকাশিত: ০৭:০২, ৫ জুন ২০১৬

জয় বাংলা যেভাবে ছিনতাই হয়ে যায়

(গতকালের পর) ॥ চার ॥ ভেবেছিলাম ১৯৭১ সালে ধর্ম নিয়ে খেলাধুলার বিষয়টি অবলুপ্ত হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করে দেয়ায় আরো আশ্বস্ত হয়েছিলাম। ১৯৭৫-এর পর বাঙালী পাকিস্তানী জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে ফের ধর্মকে নিয়ে আসেন। ধর্ম ব্যবসায়ীদের তুষ্ট করেন, যে ধারা অব্যাহতভাবে স্ফীত হয়েছে। ১৪ দল এবং ক্ষুদ্র কিছু বামপন্থী দল ছাড়া তিনটি বড় দল এখন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারে পক্ষপাতী এবং আশাবাদী। এরা হলো জামায়াত, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। আপাতদৃষ্টিতে জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেও প্রথম সুযোগেই তারা ধর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জোট বাঁধবে। এর উদাহরণ, হেফাজতীদের ঢাকা অভিযানে এরশাদের পক্ষে তাদের জন্য শীতল পানীয় নিয়ে অপেক্ষা এবং এখন নারায়ণগঞ্জে সেলিম ওসমানকে ওলি আখ্যা দেয়া। অর্থাৎ সেলিম যেন ধর্ম ব্যবহারে দ্বিধা না করেন এবং সেলিম ওসমান সে পরামর্শ শুনেছেনও। কয়েক বছর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধী মুজাহিদও আরেক মানবতাবিরোধী অপরাধী নিজামীকে ওলি আখ্যা দিয়েছিলেন। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকার সময়ই তাদের সহযোগী হিসেবে দেশে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন গড়ে তুলেছিল, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল। হেফাজতীদের ঢাকা অভিযানে অর্থ, লোকজন দিয়ে সহায়তা করেছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে জঙ্গী দমনে প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। জঙ্গীদের তৎপরতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল। দেশি-বিদেশি চাপ সত্ত্বেও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করেছিলেন। এর বিপরীতে এ প্রচেষ্টা নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তানের সহায়তায় বিএনপি-জামায়াত জোট ব্যাপক নাশকতার কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল। আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের অনেক দেশ ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের’ নামে তাতে সম্মতিও জানিয়েছিল। শেখ হাসিনাকে নোয়ানো যায়নি। বরং বিএনপি-জামায়াত জঙ্গী সংগঠনগুলোর প্রতি সাধারণের আস্থা ও সমর্থন কমেছে। বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমর্থক ধর্মভিত্তিক দলগুলো এখন একটি ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছেছে যে, শেখ হাসিনাকে দুর্বল করতে না পারলে বা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে না পারলে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না। বরং তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাস পাবে। এ কারণে মিথ্যা প্রচারণা, আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ, ধর্ম উন্মাদনা জাগিয়ে তোলায় সচেষ্ট রয়েছে। তাদের ওইসব প্রচেষ্টার একটি ছিল হেফাজতীদের ঢাকা অভিযান। তার ফলাফল সবার জানা। এ পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগে এক ধরনের অদৃশ্য মেরুকরণ হচ্ছে। জিগির তোলা হচ্ছে, ধর্ম ব্যবহারকারী দলগুলোর প্রতি বেশি কঠোর হলে আওয়ামী লীগ ‘ইসলামী ভোট’ থেকে বঞ্চিত হবে। এ যে এক ধরনের ফ্যালাসি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হেফাজতীদের ভোট আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কিভাবে আশা করে আমরা জানি না। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি-জামায়াত বিশেষ করে জামায়াত নতুন কৌশল গ্রহণ করে। অনেকের মতে, ইউপি নির্বাচনে স্থানীয় নেতাদের অর্থে বশীভূত করে অনেক বিএনপি-জামায়াত মনোনয়ন পায়। পত্রপত্রিকায় এ ধরনের অনেক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিষয়টি দৃষ্টিকটু পর্যায়ে পৌঁছালে ওইসব প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এর একটি উদাহরণ, চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাংলা ভাইয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ডকে মনোনয়ন দেয়া। ভেবে দেখুন, বাংলা ভাইয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড জয়বাংলা বলে ভোট চাইছে। অবশ্য সে প্রার্থীকে প্রত্যাহার করা হয়। যশোরেও এমন গোলযোগের সৃষ্টি হয়। জানা যায়, জয়বাংলা বিশ্বাস করে না এমন সব লোককে টাকা খেয়ে নমিনেশন দেয়া হয়। তারা আওয়ামী লীগের ‘নেতা’ হিসেবে হিন্দু বিতাড়ন শুরু করে। শাহরিয়ার কবির, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ যশোর গিয়েছিলেন অবস্থা পর্যালোচনার জন্য। তারা এ সংবাদের সত্যতা খুঁজে পান। সংখ্যা হিসেবে যাদের এমপি হিসেবে নমিনেশন দেয়া হয়েছিল তাদের একটি বড় অংশ এবং স্থানীয় অনেক নেতা এখন জয়বাংলা বলে জিয়ার সমন্বয়ের রাজনীতি শুরু করেছেন। গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে জঙ্গীরা মুক্তমনা ও ব্লগারদের হত্যা করছে। এ ধরনের হত্যাকা- ঘটলে রাজনীতিবিদরা ব্লগার ও মুক্তমনাদের সাবধান করে দেন, যাতে তারা ধর্মের অবমাননা না করে। যারা অন্তর্জাল ব্যবহার করে ধর্ম না বুঝে কটূক্তি করেন আমরা অবশ্যই তার বিরোধী। কিন্তু তার হত্যা তো সমর্থন করা যায় না। ইসলামও তা সমর্থন করে না। শুধু রাজনীতিবিদ নয়, পুলিশ কর্তারাও একই উপদেশ দেন। উল্লেখ্য, এ ধরনের যতগুলো হত্যাকা- হয়েছে তার দুয়েকটি ছাড়া পুলিশ হত্যাকারীদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। প্রত্যেকটি মাদ্রাসায় সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পড়ানো হচ্ছে। সরকারি রিপোর্টেও তা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মাদ্রাসা বোর্ড বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় সে সব ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সবাই ধরে নিচ্ছে এ এক ধরনের আপোসকামিতা। শেখ হাসিনা দেশকে একধাপ এগিয়ে নেন। আর অমনি এরা এমন এক কা- ঘটায় যাতে দেশ আবার পিছিয়ে যায়। সাম্প্রতিককালে দেশি-বিদেশি ও নানা ধর্মাবলম্বীদের হত্যা এর উদাহরণ। এখন আওয়ামী ওলামা লীগের নেতারা আওয়ামী লীগকে মুসলিম লীগে পরিণত করতে চায়। আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেছে এরা তাদের সহযোগী সংগঠন নয়। যদিও আওয়ামী নেতা হাছান মাহমুদকে দেখা গেছে তাদের ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে। হাটহাজারীর এক সময়ের মুজাহিদ বর্তমানে হেফাজতী নেতা জনাব শফি ঘোষণা করেছেন, পাঠ্য তালিকায় হিন্দুদের লেখা আছে। এসব প্রত্যাহার না করলে ইসলাম বিপন্ন হবে। আরও কিছু ছোট দলও একই ঘোষণা দিয়েছে। ব্যাপারটি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, কেউ যদি কোন সুযোগ নিতে চায় বা স্বার্থ হাসিল করতে চায় তখন ইসলাম গেল বা ধর্মের অবমাননা হলো বলে একটি অজুহাত তুলে চিৎকার শুরু করে। সরকার থমকে দাঁড়ায়। আগের মত কঠোরহস্তে এসব প্ররোচনা দমন করে না। ফলে উত্তরোত্তর তাদের সাহস বেড়েই চলছে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের ঘটনা। সেলিম ওসমান গ্রুপ নিজেদের আত্মপক্ষ সমর্থনে বার বার ইসলাম অবমাননার কথা তুলেছে। এখানে যুক্তি সম্পূর্ণভাবে অচল। একটি উদাহরণ দেই। একজন বলেছিলেন কোন এক আলোচনায় যে, নিখিল দর্জিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি মোহাম্মদ (স.) কে কোথায় স্থান দেন? তিনি বলেছিলেন তার ভগবান শ্রী কৃষ্ণ যেখানে তার স্থান সেখানে বা উঁচুতে। তিনি বলতে চেয়েছেন তার ঈশ্বরের স্থান যেখানে মোহাম্মদের (দঃ) স্থান সেখানে। এ বলে তিনি নবীজীকে সবার ওপরে স্থান দিতে চেয়েছেন। তখন একথা ছড়ানো হলো নিখিল দর্জি ধর্মের অবমাননা করেছেন। অতএব তাকে হত্যা করা হলো। সম্প্রতি আরেকটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ইউপি নির্বাচনে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল করার অজুহাতে সেখানে আওয়ামী লীগকে হিন্দু ভাবাপন্ন দালাল বলে প্রচার করা হচ্ছে। নির্বাচন বিধিতে ওয়াজ মাহফিলে এমন প্রচার করা যাবে না এমন বিধান নেই। ফলে তারা সে সুযোগ নিচ্ছে। গ্রামের বিভিন্ন মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে ফজরের নামাজের আগে তেলাওয়াত শুরু হচ্ছে। ইসলামের জন্য গ্রামবাসীকে বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হচ্ছে। প্রতি শুক্রবারে অনেক মসজিদের খুৎবায় একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এবং কোন ক্ষেত্রে কোন প্রতিরোধ নেই দেখে ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধর্মোন্মাদনা জাগিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে যাতে শেখ হাসিনা বিপাকে পড়ে যান। একটি উদাহরণ দেই। এখন এটি প্রমাণিত, বিএনপি সরকার উৎখাতের জন্য ইসরাইলের মোসাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে। মোসাদের ওই ব্যক্তি স্বীকার করেছেন তার সঙ্গে মি. রহমানের কথা হয়েছে। সেই মি. রহমান কে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। (চলবে)
×