ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানস ঘোষ

মমতার বিজয় ॥ মুসলিম ভোটাররাই ছিল নিয়ন্ত্রক

প্রকাশিত: ০৭:০১, ৫ জুন ২০১৬

মমতার বিজয় ॥ মুসলিম ভোটাররাই ছিল নিয়ন্ত্রক

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার ভোটে বাম-কংগ্রেস জোট ও বিজেপির ভরাডুবি এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচিত হওয়ার পেছনে প্রধানত যে বিষয়গুলো কাজ করেছে তার মধ্যে একটি হলো- সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাঙালীর চিন্তা-চেতনায় যে আমূল পরিবর্তন হয়েছে, তা সঠিকভাবে বুঝতে বিরোধী পক্ষের ব্যর্থতা। বাঙালী এক সময় নিজেদের নিয়ে গর্ব করত- তারা ঘুষ গ্রহণ, তহবিল তছরুপ থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি বা যে কোন ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করে না। কিন্তু এখন বাঙালীরা এসব কর্মকা-কে অনৈতিক মনে করে না যদি তারা লুটপাটের ভাগ পায়। বাম শাসনের ৩৪ বছর এবং বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জীর ক্ষমতার পাঁচ বছর বাঙালী মনোভাবকে এত জঘন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, আজ কোন দুর্নীতিই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় না। বরং নিজ স্বার্থ রক্ষা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে বাঙালীরা দুর্নীতি করাকে প্রয়োজন ও ‘মহৎ গুণ’ বলে মনে করে। ফলে নারদ ও সারদার মতো কেলেঙ্কারি এবং ফ্লাইওভার ধসে পড়ার ঘটনা ভোটারদের বিবেককে দুর্নীতির লজ্জাজনক ইতিহাস রচনাকারী তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে ভোটদানে জাগ্রত করবে- বিরোধী সব নেতার এমন ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। বিরোধী পক্ষ দুর্নীতি ইস্যুকে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার বানায় এবং তারা দুর্নীতিবাজকে ‘না’ বলতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানায়। তবে বিরোধী পক্ষ কাক্সিক্ষত জবাব না দেয়ায় ভোটাররা তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। পক্ষান্তরে দুর্নীতিতে দুষ্ট পাঁচ মন্ত্রী ও বিধানসভার সদস্যের সবাই বিপুল ভোটে পুনর্নির্বাচিত হন। এতে মমতা বলতে সুযোগ পান যে, জনগণের রায় বলছে এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ মিথ্যা। তিনি দাবি করেন, পশ্চিমবঙ্গে কোন দুর্নীতি হয়নি। বিগত বছরগুলোয় বাঙালীর মূল্যবোধে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, সে বিষয়ে বিরোধী পক্ষ সচেতন ছিল না। রাজ্যের বৃহত্তর মঙ্গলের চেয়ে দ্রুত ব্যক্তি সাফল্য অর্জনের বিষয়টি হয়ে ওঠে বাঙালীদের পথনির্দেশক বিশ্বাস ও প্রাত্যহিক জীবনের মূলনীতি। অতীতে দুর্নীতির কালিমা নিয়ে একজন রাজনীতিক পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারতেন না। কারণ, জনগণের বৃহত্তর অংশ তাকে বয়কট করত। আজ সেই দুর্নীতিবাজ ‘সম্পদ’ হিসেবে বিবেচিত। তিনি তার ভোটারদের খুশি রাখতে তাদের পেছনে উপার্জিত অবৈধ সম্পদ ও রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেদার খরচ করছেন। ভোটার ও রাজনীতিকদের সঙ্গে দেয়া-নেয়ার এই সম্পর্ক কয়েক বছরে বেশ মজবুত হয়েছে, বিশেষ করে মমতার আমলে। ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক এই বাঙালী চেতনা ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে ব্যর্থ হয় এবং যা ফের তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে। যখন নারদ কেলেঙ্কারি জানাজানি হলো তখন মমতাপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এটিকে কোন ইস্যু না বলে নাকচ করে দেন এবং যুক্তি দেখান ঘুষ দেয়া-নেয়া বাঙালী জীবনের অপরিহার্য অংশ। তারা দুর্নীতির ইস্যুকে ‘তুচ্ছ’ বলে উড়িয়ে দেন এবং খোঁড়া যুক্তি পেশ করেন যে, দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে দুষ্ট রাজনীতিকরা ঘুষ হিসেবে যে পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন তার অনেক বেশি ভোটারদের দিয়েছেন। অধিকন্তু এই রাজনীতিকরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকার ভাতা দিয়ে হাজার হাজার ক্লাব ও এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যের উপকার করেছেন, যাদের অধিকাংশই ছিল বেকার। আর খুব দ্রুত জনপ্রিয় এই ভাতা অন্যান্য অসংগঠিত সেক্টরেও দেয়া হয়। ফেরি করে জীবিকা অর্জন করা লাখ লাখ হকারকে লাইসেন্স দেয়া হয় এবং সেই সঙ্গে তাদের বিশেষ বীমা সুবিধার আওতায় আনা হয়। রাজ্যের ১০ কোটি মানুষের মধ্যে ছয় কোটি মানুষকে দুই রুপীর বিনিময়ে এক কেজি চাল পাওয়ার কর্মসূচীর আওতায় আনা হয়। সরকার স্কুলগামী প্রত্যেক কন্যাশিশুর এ্যাকাউন্টে ২৫ হাজার রুপী প্রদান করে, এতে গ্রামবাংলায় তৃণমূলের প্রতি জনসমর্থন ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়। অধস্তন ও বিভিন্ন সামাজিক গ্রুপকে জনপ্রিয় কল্যাণমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে টার্গেট করা হয়। কারও কাছে চড়া মূল্যে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের জন্য বেকার যুবকদের সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা হয়। আর এভাবে তাদের নির্মাণ ব্যবসায় জড়ানো হয়। এ কৌশলের উদ্দেশ্য ছিল তৃণমূলের জন্য ভোট কেনা এবং এর সুবিধাভোগীদের ব্যাপ্তি বাড়ানো। এর ফলে শহর ও গ্রামবাংলা দুই জায়গাতেই প্রতিন্দ্বন্দ্বীদের ওপর তৃণমূলের আধিপত্য ছিল। কেন সারদা ও নারদ কেলেঙ্কারি কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর প্রভাব ফেলল না এবং তৃণমূল কেন কলকাতার ১১টি আসনের সব কটি সহজে দখলে নিল- এটি ছিল প্রধান কারণসমূহের একটি। গ্রামবাংলায়ও মোটা অঙ্কের ঋণের ভারে জর্জরিত কৃষক শ্রেণী দ্বিধাহীনচিত্তে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন, যদিও তারা তাদের উৎপন্ন পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাননি। তাহলে কেন তারা তৃণমূলকে সমর্থন করলেন? তাদের আশঙ্কা ছিল, সরকার পরিবর্তন হলে বিনামূল্যে ও অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া সেবা এবং ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বাম-কংগ্রেস জোট নির্বাচনী প্রচারের সময় সমালোচনা করে বলেছিল, মমতার জনপ্রিয় বেকার ভাতার রাজনীতি বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এ ভাতা প্রদানের কৌশলে সরকার বড় ধরনের ঋণের বোঝা বহনে জড়িয়ে পড়ে। অনুৎপাদনশীল খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্বল্প রাজস্বের ওপর নির্ভরশীল একটি রাজ্য বড় ধরনের আর্থিক বোঝা বহন করে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু এই যুক্তি ও ব্যাখ্যা ভোটারদের মনে স্থান পায়নি। তারা রাজ্যের বৃহত্তর মঙ্গলের কথা চিন্তা না করে ব্যক্তিস্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলে বিজেপির সবচেয়ে নিশ্চিত আসন যেখানে ফ্লাইওভার ধসে ২৭ জন নিহত হয়েছিল সেই জোড়াসাঁকো তৃণমূলের হস্তগত হয়। এমনকি মাড়োয়ারি ভোটারদের একটি অংশ হয় তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে, নতুবা দেয়ইনি। অন্যদিকে বিজেপির বিরুদ্ধে একযোগে ভোট দিতে মুসলমানদের প্রতি ইমামদের নির্দেশনা ছিল। মমতার বিপুল বিজয়ের পেছনে ২৭ শতাংশ মুসলিম ভোটও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় নেতারা তৃণমূলের পক্ষে ব্যাপকহারে প্রচার চালিয়েছিলেন। তারা গর্ব করে বলেন, মুসলমানদের ভোট শুধু এই নির্বাচন নয়, আগামীর সব নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করবে। কেননা, ১৩২ আসনে মুসলমানরাই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে। যে দলকে আমরা ভোট দেব তারাই ক্ষমতায় আসবে। পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় নেতাদের একজন বলেন, রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করবে। ধর্মীয় নেতারা রাজ্যে বিজেপিকে সমুচিত জবাব দিতে প্রকাশ্যে মুসলমানদের উৎসাহিত করেন। জোট নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট দাবি করলেও মুসলিম ইমামরা এটিকে মুসলমানবিরোধী বলে অভিহিত করেন। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এবার সেই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশে। অন্তত এ পরিসংখ্যানে বিজেপির মনোবল বেড়েছে। বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ১৭ শতাংশ ভোটের পরিসংখ্যান বিধানসভা নির্বাচনে ধরে রাখতে না পারলেও দলটি থেকে উল্লেখ করার মতো ভোট জোটের বাক্সে গিয়ে পড়েনি। রাজ্যে বিশেষ করে উপজাতীয়দের মধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ব্যাপক সামাজিক নেটওয়ার্কিংয়ের কারণেই এটি হয়নি। বাম ও কংগ্রেসের ভোটারদের মধ্যে অধিকাংশ যারা ২০১৪ সালে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন তারা জোটের আপত্তির কারণে ‘ঘর ওয়াপসি’কে (ধর্মান্তরকরণ) মেনে নেননি। তাছাড়া বাম-কংগ্রেস জোট গঠনও এত দেরিতে হয়েছে যে, দুই দলের নেতারা জোটকে তৃণমূলের যোগ্য বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে মানুষের কাছে যাওয়ার সময় পাননি বললেই চলে। আর যদি জোট গঠন না হতো তাহলে দুই দলের আসন ও ভোট দুটিই ব্যাপকহারে কমত। এদিকে তৃণমূল কংগ্রেস ভোটের পরে জোট বিশেষ করে সিপিআই (এম) নেতা ও সমর্থকদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানোয় কংগ্রেস ও বাম দুটি পক্ষ আরও কাছাকাছি চলে আসে। তারা এখন এক সুরে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। এখন তৃণমূলকে মোকাবেলায় জোট বিজেপিকে বিরোধী দল হিসেবে বেড়ে উঠতে আর সুযোগ দেবে কিনা, তা গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। ভাষান্তর : মোহসিন উদ্দীন আহমাদ লেখক : ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক
×