ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বাংলা সাহিত্যের নারী চরিত্রের ধারা বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং নজরুল

প্রকাশিত: ০৭:১১, ৩ জুন ২০১৬

বাংলা সাহিত্যের নারী চরিত্রের ধারা বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং নজরুল

ঊনবিংশ শতাব্দীর এক বিরাট কাল পর্ব জুড়ে বঙ্কিম-সাহিত্যের যে উজ্জ্বল চ্যুতি তার কিরণছটা বিংশ শতাব্দীতেও ধূসর হয়ে যায়নি। নবজাগরণের সমৃদ্ধ সময়ের স্বীকৃত এই সাহিত্য সম্রাট ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত প্রথম ভারতীয় স্নাতক। আর তাই শিক্ষায়, মননে, সৃজনশীলতায় বঙ্কিমচন্দ্র, নতুন আলোয় যেভাবে বাঙালীর চিত্তকে অভিষিক্ত করলেন তা সত্যিই অতুলনীয়। ‘রজনী’, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘কপালকু-লে’, ‘আনন্দমঠ’, ‘রাজসিংহ’, ‘বিষবৃক্ষ’ ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ এবং ‘দুর্গেশনন্দিনী’র মতো কালজয়ী উপন্যাস সৃষ্টি করে আজও তিনি পাঠককূলের কাছে সমাদৃত এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক স্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ। বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালী সমাজকে অনেক নতুনত্বের স্বাদ দিলেও রক্ষণশীল ধারায় কিছুটা পেছনের দিকেও ঠেলে দেন। সমকালীন সমাজ, নারী জাতির সামাজিক শৃঙ্খল, উপনিবেশিক শাসন এবং ইউরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির যোগসাজশ সব মিলিয়ে অবিভক্ত বাংলা তখন এক চরম টানাপড়েনে। সৃষ্টিশীল মানুষের উপরও পড়ে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব। নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্ব সংঘাত যেমন সামাজিক অবয়বে একইভাবে সাহিত্য- সাংস্কৃতিক পরিম-লেও। সুতরাং স্বকীয় চেতনাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া কিংবা কিছুটা পশ্চাৎমুখী হওয়া যুগেরই অনিবার্য পরিণতি। আর তাই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং অদ্ভুত শিল্পসত্তায় সমৃদ্ধ বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সৃষ্টিশীল আঙ্গিনাকে তৎকালীন সমাজ আলোকেই চিত্রিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। বাস্তব সমাজ কাঠামো, ইংরেজী শিক্ষার নতুন আবহ এবং এর প্রতিক্রিয়া, নতুন যুগের হাওয়া এসব কোন কিছুকেই অতিক্রম করা কোন সৃষ্টিশীল প্রতিভাবান স্রষ্টারও পক্ষে সত্যিই অসম্ভব ছিল। মানুষের জীবন ছিল এক চরম ক্রান্তিলগ্নে। নারীর অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। ইতোমধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারী জাতির অগ্রদূত হিসেবে আর্বিভূত হলেন নারীদের সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্ত করার দায়বদ্ধতায়। তার পরেও আইন, সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্ম এমন শক্ত গাঁথুনীতে মানুষের প্রতিদিনের জীবন যাত্রায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে তার থেকে বেরিয়ে আসা সত্যিই দুঃসাধ্য এবং অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর তাই বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলোর প্রচলিত সমাজব্যবস্থা থেকে কোনভাবেই আলাদা ছিল না। বিশেষ করে ‘বিষবৃক্ষে’র কুন্দনন্দিনী এবং ‘কৃষ্ণকান্ত উইলে’র রোহিণী চরিত্র যা সমকালীন অঙ্গনকে প্রচ-ভাবে নাড়া দেয় সে চরিত্রগুলোকে সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কারণ বিদ্যমান একেবারেই প্রতিকূলে ছিল। সেই অচলায়ন শক্ত সমাজের ভিত্তিমূল নাড়া দেয়া শুধুমাত্র একজন প্রতিভাবান সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষে সত্যিই পর্বত প্রমাণ বাধা ছিল। ‘নারী শিক্ষা’ কে মেনে নেয়া অসম্ভব ছিল, বাল্য বিবাহের প্রচলিত ধারাকে রোধ করা অসাধ্য ছিল এবং বিধবা বিবাহ তো ছিল প্রায়ই স্বপ্নের মতো। এহেন সামাজিক অপসংস্কারের দুঃসময়ে বঙ্কিমচন্দ্রের নারী চরিত্রও ছিল বিদ্যমান সমাজের সময়ের প্রতিনিধি। তবে ‘কৃষ্ণকান্ত উইলে’র ‘রোহিনী’ চরিত্রটি সৃষ্টি করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের শিল্পসত্তা তাঁকে যুগকে অতিক্রম করতে প্রাণিত করেছে। শেষ অবধি তিনি তাই করেছেন। এখানেই রক্ষণশীল বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে শৈল্পিক বঙ্কিমচন্দ্রের বিস্তর ফারাক। বঙ্কিমী চেতনায় যখন পুরো বাঙালী উদ্দীপ্ত সেই সুবর্ণ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে রুদ্ধশ্বাসে পড়লেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’। শুধু পড়লেন না মন প্রাণ দিয়ে তার রসসম্ভোগ করলেন, আত্মস্থ করলেন এবং এই চেতনায় নিজেকে সমর্পণও করলেন। রক্ষণশীল বঙ্কিমচন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথ বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা এবং যুক্তিশীল বিশ্লেষণ খ-ন করলেও শিল্পসত্তায় সমৃদ্ধ বঙ্কিমচন্দ্রকে অতিক্রম করা কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই রবীন্দ্র সাহিত্যে বঙ্কিমের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উপন্যাসে তো অনেকখানি। নারী চরিত্র চিত্রণে এবং নারীর সামাজিক অবস্থা নির্ধারণে রবীন্দ্রনাথের অনেক সময় লেগেছে বঙ্কিমচন্দ্রের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে। ঐতিহাসিক ধারা নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রেরই অনুগামী বলা চলে। নবজাগরণের সুফল-কুফল যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে একইভাবে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্ভারেও। রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’য় এর সচেতন অভিব্যক্তি। ‘রাজর্ষি’ এবং ‘বউ ঠাকুরানীর হাটে’ ও রবীন্দ্রনাথ সমকালীন সাহিত্যিক অঙ্গনের প্রচলিত ধারা থেকে বিচ্যুত হতে পারেননি। আর ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের ‘বিনোদিনী’ চরিত্রটি আজও পাঠক সমাজকে ভাবায়, বিচলিত করে। শুরুতে বিনোদিনীর নবজাগরণের সিক্ত পথে পা চলা, এমন ঐশ্বর্যম-িত ব্যক্তিক সুষমাম-িত বিনোদিনীকে যে পর্যায়ে নিয়ে যান সেভাবেই তো তার পরিণতি হয়নি। ইচ্ছা অনিচ্ছার বিরোধের সর্বশেষ পর্যায়ে বিনোদিনী তার সমস্ত মহিমা হারিয়ে ফেলে। বিধবা বিনোদিনী ঘর বাঁধার স্বপ্ন থেকে বিতাড়িত হয়, সমকালীন সমাজ তাঁকে আপন বৈশিষ্ট্যে বাঁচতে দেয় না। কাশীতে হয় তার অন্তিম আশ্রয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের নারী চরিত্রে বাল্য বিবাহের সংখ্যাই বেশি। কিশোরী মেয়ের বিয়ের সংখ্যাও হাতে গোনার মতো। আর প্রাপ্ত বয়স্কা নারীর বিয়ে বলতে ‘মহামায়ী’ গল্পের মহামায়ার বয়স একেবারে চব্বিশ, ‘হৈমন্তী’ গল্পের হৈমন্তীর বয়স সতেরো। যোগাযোগ উপন্যাসে কুমুর বয়স আঠারো আর ‘নৌকাডুবি’র কমলার বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্যের বয়সও একটু বেশি। ‘চতুরঙ্গে’র দামিনী ছাড়া বিধবা বিবাহ নেই বললেই চলে। সময়ের দাবি মিটিয়ে সমকালীন সমাজকে যুগোত্তীর্ণ করা আসলে সহজ কোন ব্যাপার নয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আর একজন বলিষ্ঠ সৃষ্টিশীল উদ্যোগী পুরুষ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অসংখ্য গল্প উপন্যাসের স্রষ্টা, সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত (৪ পর্ব) থেকে আরম্ভ করে গৃহদাহ, দত্তা, দেবদাস, পথের দাবীর মতো সাড়া জাগানো উপন্যাস যেমন আছে তেমনি ‘বিন্দুর ছেলে’ ‘রামের সুমতি’, ‘আভাগীর স্বর্গ’, ‘বড় দিদি’, ‘মেজদিদি’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘বামুনের মেয়ের’ মতো নারী প্রধান চরিত্রের অনবদ্য, কালজয়ী গ্রন্থও আছে। শরৎচন্দ্র অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সমকালীন সমাজকে আঘাত করেছেন। বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছেন, সর্বোপরি সমস্ত অশুভ অপসংস্কারকে ভাঙতে চেয়েছেন যা কিনা মানুষকে মানুষের মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে দেয় না। শারৎচন্দ্র তাঁর সৃজান সৌধে আপন বৈশিষ্ট্যে মহীয়ান। তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলো প্রতিটি গল্পের নিজস্ব গতিপথ তৈরি করে। গৃহদাহের অচলা চরিত্রটি এক বলিষ্ঠ নারী ব্যক্তিত্বের। যে আপন মহিমায় গল্পের আবহ তৈরি করে, আপন মর্যাদায় নিজের অবস্থানকে মজবুত করে এমনকি মহিম সুরেশের অন্তদ্বর্ন্দ্বের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে অম্লান থাকে। শান্তশিষ্ট, নরম প্রকৃতির মহিম এবং উদ্ধৃত, বেপরোয়া স্বভাবের সুরেশের প্রতি সমান মনোযোগ অচলার কখনই ছিল না। স্বামী হিসেবে মহিমের প্রতি দায়বদ্ধতা অচলা চরিত্রের বিশিষ্ট পর্যায়। ‘দত্তার বিজয়া’ ও এক অসাধারণ সাহসী, স্পষ্টবাদী এবং অনমনীয় ব্যক্তিত্বের ধারক। অন্যদিকে ‘দেবদাসের পার্বতী’ও কম শক্তিশালী নয়। এমনতরো অনন্য, বলিষ্ঠ নারী চরিত্র শরৎচন্দ্রের সৃষ্টি সম্ভারের এক অবিচলিত দৃঢ়শক্তি। সবশেষে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যেও নারী তার আপন বৈশিষ্ট্যে দীপ্যমান। নারী কবিতায় তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। তাঁর লেখা বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে নারী চরিত্রের যে, নিশানা সেখানেও নজরুল একাধারে বিপ্লবী, সমাজ-চিন্তক এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিজেকে মহিমান্বিত করেছেন। ‘বাঁধন হারা’, মৃত্যুক্ষুধা এবং ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে নজরুল সমকালীন সমাজ, নারী-পুরুষের বৈষম্য এবং অসাম্প্রদায়িক বোধকে বিশেষভাবে উজ্জ্ব¡ল করে তুলেছেন। বাঁধন হারার নায়িকা মাহবুবার প্রচ- ক্ষোভ যেমন সমাজের প্রতি একইভাবে সে ক্ষুব্ধ শিক্ষিত পুরুষ জাতির উপরেও। যারা মেয়েদের যথার্থ সম্মান দিতে কুণ্ঠিত। সামাজিক অবিচারের শিকার হয়ে মাহবুবার বিয়েটাও সুখকর হয়নি। ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘মেহের-নেগার’, ‘রাক্ষসী’, ‘সাঁঝের তারা’ ইত্যাদি অনেক গল্পেও নজরুল নারী চরিত্র নির্মাণে সমাজ সংস্কারের মূলভিত্তিক নানাভাবে নাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। নজরুলও সচেতনভাবে কখনও নারীর অমর্যাদার বিষয়টি ভাবতে পারেননি। নারী যখন অসম্মান বা অপমানের শিকার হয় কিংবা সমাজের কারণে তাকে নানা অভিশাপে জর্জরিত হতে হয় সেখান থেকেও নজরুল নারীদের সসম্মানে তাদের জায়গাকে শক্ত করেছেন। সামাজিক-অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। নারীকে তার প্রাপ্য স্বাধীনতা এবং অধিকার দিতে এতটুকুও কার্পণ্য করেননি। কবিতায় যেমন গল্পের আঙ্গিনায়ও তাঁর সৃষ্ট নারীরা লক্ষ্মীপ্রতিমার আদলে দীপ্যমান হয়ে আছে।
×