ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজস্ব বোর্ডের সামর্থ্য নেই, নাকি কর্মকর্তাদের যোগসাজশ?

এনবিআরের জালে ধরা পড়েননি কর ফাঁকিবাজ বাড়িওয়ালারা

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ২ জুন ২০১৬

এনবিআরের জালে ধরা পড়েননি কর ফাঁকিবাজ বাড়িওয়ালারা

রহিম শেখ ॥ ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছেন কর ফাঁকিবাজ বাড়িওয়ালারা। গত দুই বছর রিটার্ন জমার সময় বাড়িওয়ালাদের করের জালে আটকাতে পারেনি সরকারের রাজস্ব বিভাগ। কথা ছিল ২৫ হাজার টাকার বেশি হলেই বাড়ি ভাড়া ব্যাংকে জমা দিতে হবে। কিন্তু সে কথা রাখেননি নগরীর অধিকাংশ বাড়িওয়ালা। তবে এজন্য শুধু বাড়িওয়ালাদের দুষলে ভুল হবে। বড় ভুল করেছে খোদ এনবিআর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাড়ি ভাড়া ব্যাংক হিসাবে জমা দেয়ার নামে যে বিধান করা হয়েছিল, সেটি বাস্তবসম্মত ছিল না। বাড়ির মালিকরা তাই এতে সাড়া দেননি। এছাড়া আইনটি বাস্তবায়নের জন্য রাজস্ব বোর্ডের যে ধরনের সক্ষমতা দরকার, তাদের তা নেই। ফলে বিদ্যমান আইনটি শুধু কাগজ কিতাবেই আছে, বাস্তবায়ন নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কর ফাঁকি দিতে বাড়িওয়ালাদের অনেকেই ভাড়া ২৫ হাজার টাকার কম দেখিয়ে ব্যাংকে জমা দেখাচ্ছেন। বাকিটা তারা ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে নিচ্ছেন নগদ টাকায়। অনেকে আবার আদৌ ব্যাংকে বাড়ি ভাড়ার কোন হিসাবই দেখাচ্ছেন না। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন কর ফাঁকি দেয়া বাড়ির মালিকের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর। এক বছরের বেশি সময় জরিপ চালিয়ে এক লাখ ৬৬ হাজার ৫৪৬ বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায় যেগুলোর ভাড়া ২৫ হাজার টাকার বেশি। বাড়িওয়ালাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন যাদের করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই। ফলে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এমন উপলব্ধি নিয়ে বাড়ির মালিকদের কর ফাঁকি বন্ধে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে নতুন আইন করা হয়। এতে বলা হয়, কোন বাড়ির মালিকের একক বা একাধিক ফ্ল্যাট যাই- থাকুক না কেন, মাসিক ভাড়া ‘সর্বসাকল্যে’ ২৫ হাজার টাকার বেশি হলে তাকে ব্যাংক এ্যাকাউন্টে ভাড়ার টাকা জমা দিতে হবে। যদি তা করা না হয়, তাহলে ভাড়ার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। ২০১৪ সালের ১ জুলাই থেকে এ বিধান কার্যকর করা হয়। এ মর্মে পরিপত্র জারি করে এনবিআর। আইনটি কী ভাবে কার্যকর করা হবে, সে বিষয়ে আলাদা একটি নীতিমালাও তৈরি করা হয়। তখন আইনটি নিয়ে সারাদেশে বাড়ির মালিক, ভাড়াটিয়া ও সংশ্লিষ্ট মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বাড়ির মালিকরা বলছেন, এটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে কেউ তা গ্রহণ করেননি। ভাড়াটিয়ারা মনে করেন, আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা নেই। আইনটির সমর্থনে সে সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, প্রভাবশালীরা এ আইন বাস্তবায়নে বিরোধিতা করছেন। তবে যত বাধাই আসুক, এটি কার্যকর করা হবে। সূত্র মতে, বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত প্রচলিত যে আইন আছে, তাতে ভাড়াটে ও বাড়ির মালিক উভয়ের মধ্যে চুক্তি করার বিধান রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা মানা হয় না। ফলে বেশিরভাগ বাড়ির মালিক ভাড়া বাবদ যে আয় করেন, আয়কর রিটার্নে তা দেখান না। এনবিআর সূত্র বলছে, সারাদেশে এখনও অর্ধেক বাড়ির মালিক করের আওতার বাইরে রয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর আইনজীবী জনকণ্ঠকে বলেন, বাস্তবতার আলোকে বাড়ি ভাড়া ব্যাংকে জমা করার আইনের যৌক্তিকতা নেই। করযোগ্য সব বাড়ির মালিককে করের আওতায় আনতে না পারাটা এনবিআরের ব্যর্থতা। এ প্রসঙ্গে এনবিআর সদস্য (কর নীতি) মোঃ পারভেজ ইকবাল জনকণ্ঠকে বলেন, ফিল্ডে সাড়া কম। কারণ এরকম করদাতারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন যে আইনটি আদৌ বলবৎ আছে কি না। কিন্তু তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, বিধানটি অবশ্যই কার্যকর আছে। ট্যাক্স রিটার্নের সময় আমরা দেখব যে কারা সে অনুযায়ী সরকারী কোষাগারে কর জমা দিয়েছেন, আর কারা দেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর ফাঁকি দিতে বাড়িওয়ালাদের অনেকেই ভাড়া ২৫ হাজার টাকার কম দেখিয়ে ব্যাংকে জমা দেখাচ্ছেন। বাকিটা তারা ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে নিচ্ছেন নগদ টাকায়। অনেকে আবার আদৌ ব্যাংকে বাড়ি ভাড়ার কোন হিসাবই দেখাচ্ছেন না। আক্ষেপের সুরে মিরপুরের শেওড়াপাড়ার ভাড়াটিয়া আলিমুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমে ভাড়া দিলে আমরা যেমন হয়রানির হাত থেকে বাঁচি, তেমনই সরকারও কিছু রাজস্ব পায়। ব্যাংকে বাড়ি ভাড়া জমার আইন থাকার কথা তিনি জানেন না উল্লেখ করে বলেন, শুধু তিনি না; বেশিরভাগ মানুষেরই আইনের কথা জানা নেই। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাড়ির মালিকদের সংগঠন পুরান ঢাকা জনকল্যাণ সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, এই আইন আমরা গ্রহণ করিনি। আইনটি কার্যকর হওয়ার পর থেকে কোন বাড়ির মালিক ব্যাংকে ভাড়ার টাকা জমা দিয়েছেন বলে জানা নেই। বাড়িওয়ালারা বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিচ্ছেন এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা অস্বীকার করছি না। তবে বাড়ির মালিকদের একতরফা দোষারোপ করা যাবে না। কেননা, কর্মকর্তাদের যোগসাজশের কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেয়া হয়। ভাড়াটিয়া কল্যাণ সোসাইটির সভাপতি সুলতান বাহার বলেন, বেশিরভাগ বাড়ির মালিক বিধান মোতাবেক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেন না। ফলে ভাড়া বাবদ বাড়ির মালিকদের আয় কত, তা নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই।
×