ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘একের পর এক ম্যাচ খেলাই উন্নতি ঘটিয়েছিল’

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৫ মে ২০১৬

‘একের পর এক ম্যাচ খেলাই উন্নতি ঘটিয়েছিল’

মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে দীর্ঘদিনের জন্য যাওয়া। পরিবার ছেড়ে একাকী অচেনা পরিবেশে প্রতিটা দিন বেশ চ্যালেঞ্জের ছিল শচীন টেন্ডুলকরের জন্য। কঠিন সংগ্রাম যেমন করছিলেন তেমনি জীবনমুখী শিক্ষাটাও পেয়েছিলেন ইয়র্কশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলার সময়টাতে। ইয়র্কশায়ারের পক্ষে শচীন ছিলেন তখন ১২৮ বছরের মধ্যে প্রথম বিদেশী ক্রিকেটার। তাই দারুণ অভিভূত ও উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনি। তবে ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর নানাবিধ সমস্যায় পড়েছিলেন। একে তো বয়স কম, তারপর আবার ইংল্যান্ডের আবহাওয়া, পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান কম ছিল। কিন্তু এই সময়টাকে ক্যারিয়ারের পরবর্তী সময়ে নিজেকে গড়ে তোলার অন্যতম মাধ্যম হিসেবেই মনে করেছেন লিটল মাস্টার। শুধু একজন ক্রিকেটার হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেক কার্যকরী একটা ভূমিকা রেখেছিল সেই অভিজ্ঞতাটা। আর টানা ম্যাচ খেলতে হয়েছে সে সময় যা আরও কর্মঠ এবং পরিশ্রমী করে তুলেছিল তরুণ শচীনকে। আর সেটা পরবর্তী সময়ে দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল শচীনের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে। এ কারণেই নিজের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’-তে শচীন দাবি করেছেন একের পর এক ম্যাচ খেলাই তার ব্যাটিংয়ে অনেক বড় উন্নতি ঘটিয়েছিল। ইংল্যান্ডে শচীনের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল কন্ডিশন। কারণ নিজের দেশ ভারতের চেয়ে আলাদা ছিল পরিবেশ-পরিস্থিতি। ব্যাটিং করাটাও অনেক কঠিন ছিল ভিন্নধর্মী উইকেটে। ভারতের চেয়ে উইকেটগুলো অনেক বেশি সুইং করত। এসব শচীনের জন্য সহায়ক হয়েছে কৌশল বাড়ানো, ভিন্ন কন্ডিশনে মানিয়ে নেয়ার সামর্থ্যটাকে। আর এ সবই দারুণ সহায়ক হয়েছিল যখন ভারতের পক্ষে ইংল্যান্ড সফর করেছেন তিনি। সামাজিকভাবেও খুব ভাল শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা ছিল ইয়র্কশায়ারে কাটানো দিনগুলো। কর্তৃপক্ষ এবং ইয়র্কশায়ার কাউন্টি দলের প্রেসিডেন্ট স্যার লরেন্স বাইফোর্ড নিজেও ছিলেন দারুণ সামাজিক। রবিবারের দিনগুলোতে ক্লাবের পুনর্মিলনীগুলো দারুণ উপভোগ করেছেন শচীন। কোন কোন সময় চমৎকার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। যেমন শার্ট ছাড়াই শুধু টাওয়েল আর টাই পরিহিত অবস্থায় হোটেলের কনভেনশন কক্ষে হাজির হওয়া ছিল দারুণ কৌতুকময় পরিস্থিতি। প্রথমে যখন শচীনকে ওইভাবে সতীর্থরা যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন হয়তো মজা করার জন্যই সেটা বলা হচ্ছে তাঁকে। এজন্য তিনি অপেক্ষা করেছেন অন্যরা ওই পরিচ্ছদ গ্রহণ পর্যন্ত। করিডরে বের হয়ে দেখেছেন সতীর্থরা ওভাবে সত্যি সত্যিই যাচ্ছে কিনা! এরপর নিজেও একই বেশভুষা নিতে বাধ্য হয়েছেন! তবে ওই সন্ধ্যাগুলো দারুণ উপভোগ্য আর আনন্দময় ছিল। ইয়র্কশায়ারের দলে তখন শচীনই ছিলেন সবার চেয়ে বয়সে ছোট। এ কারণে যে কোন ব্যাপারে সাহায্য করতে আগ্রহ নিয়েই এগিয়ে আসতেন সবাই। ১৯৯০ সালে যদিও ইংল্যান্ড সফর করেছিলেন তিনি। কিন্তু সে সময় ভারতীয় দলের সঙ্গে ছিলেন এবং সবকিছুই জাতীয় দলের পক্ষ থেকেই ব্যবস্থা করা হতো। সে কারণে আসলে কোন ধরনের সমস্যাই মোকাবেলা করতে হয়নি। কিন্তু এক্ষেত্রে নিজে থেকেই সবকিছু করতে হয়েছে। সেটা নিজের খাবার তৈরি করা থেকে শুরু করে পোশাক ধোয়া ও ইস্ত্রি করা। তবে এভাবে নিয়মিত করতে করতে বিরক্তিবোধ এসে গিয়েছিল এবং নিদারুণ কষ্টও পেয়েছেন। যেমন ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করতে গিয়ে দারুণ অসুবিধায় পড়েছিলেন। ঠিক বুঝতে পারছিলেন না কি পরিমাণে ডিটারজেন্ট দিতে হবে। ধৌতকরণ প্রক্রিয়া শুরুর আগেই এক প্যাকেটের অন্তত অর্ধেকটা শেষ করতে হয়। কিন্তু সেটা প্রথমবার বুঝতে না পেরে মেশিন চালিয়ে বাইরে বের হয়েছিলেন। একটু পর ফিরে দেখেন দরজার নিচে চুইয়ে পানি বেরুচ্ছে। ঠিক তখনই তাঁর মনে পড়ে যায় যে ওয়াশিং মেশিন চালু রেখে চলে গেছেন। সবগুলো ডিটারজেন্ট ঢেলে দেয়ার কারণে মেশিন উপচে পড়ে গেছে পানি এবং রুমের সবখানে ছিল ফেনায় ফেনায় পূর্ণ। সেবারই প্রথম ও শেষবার নিজে নিজে কাপড় ধুয়েছেন শচীন। বাকি দিনগুলোতে সোলি এডামসের পরিবার শচীনকে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসতেন। পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের ডিউসবারিতে থাকতেন সোলি এবং তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন তিনি। দিলীপ ভেংসরকারের কোম্পানিতে ১৯৯০ সালে প্রথমবার সোলি এবং তাঁর স্ত্রী মারিয়ামের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল শচীনের। মুম্বাইয়ের যত ক্রিকেটার ইংল্যান্ডে লীগ ক্রিকেটে খেলেছেন তারা সবাই সোলি ভাইয়ের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতার বিষয়ে তাঁকে আগেই জানিয়েছিলেন। সে কারণে ইয়র্কশায়ারে আসার পর থেকেই সোলি ভাইয়ের সংস্পর্শে ছিলেন তিনি। তাঁর বাড়িটি হয়ে উঠেছিল ওই অঞ্চলে খেলতে যাওয়া ভারতীয় ক্রিকেটারদের জন্য শরণার্থী শিবিরের মতো! সোলিও দারুণ আপ্যায়ন করতেন। শচীনের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল তার ঘরে তৈরি বিরিয়ানি, চিকেন তান্দুরি, রাইটা এবং আমের লাচ্ছি। ইয়র্কশায়ারে থাকার সময় সোলির বাড়িয়ে সপ্তাহে তিনদিন যাওয়াটা ছিল শচীনের কাছে তীর্থযাত্রার মতো। সোলির ভাই ইউনুস ও তার স্ত্রী রুকসানাও দারুণ অতিথি পরায়ণ ছিলেন। সালাদের বাটি সাজানোর শিল্পটা তাদের থেকেই রপ্ত করে ফেলেছিলেন শচীন। মাঝে মাঝে শচীনের কাছে চলে আসতেন তিন বন্ধু জতিন পারাঞ্জপে, মুফি ও বিনোদ কাম্বলি। তারা কম মূল্যের ফাস্টফুড খেয়েই দিনাতিপাত করতেন। এই চারজনের মধ্যে শচীনই শুধু রোজগার করতেন বলে বিলটাও তাঁকেই দিতে হতো। অধিকাংশ সময় তারা কেএফসি, বার্গার কিংয়ের মতো কিছু বহুল প্রচলিত ফাস্টফুডেই খেতেন। কিন্তু সবারই পছন্দ ছিল পিজা হাটের ব্যুফে। কারণ সেখানে একটা নির্দিষ্ট মূল্যে যত খুশি পিজা খেতে পারতেন। সেখানে সালাদের বাটিটাও সাজিয়ে আনতেন শচীন। কারণ ট্রেনিংটা পেয়েছিলেন ইউনুস-রুকসানার কাছ থেকে। তারা শিখিয়ে দিয়েছিলেন লেটুস পাতা দিয়ে একটা দেয়ালের মতো বর্তনী গড়ে তোলার। এই বর্তনীটা সাধারণত প্লেটের কিনারার চেয়ে ২-৩ ইঞ্চি উচুু হতো। তবে প্রয়োজনমতো সেটা বাড়িয়ে ৫-৬ ইঞ্চিও করা যেত। এভাবেই দিনগুলো কাটিয়ে আগস্টের মাঝামাঝি ইয়র্কশায়ার অধ্যায় সেবারের মতো শেষ করে ভারতে ফিরে আসেন শচীন। কারণ ভারতে তখন দেশের দ্বিতীয় সেরা ও জনপ্রিয় ঘরোয়া ক্রিকেট আসর দুলীপ ট্রফি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯৩০ দশকের মাঝামাঝি ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছিলেন দুলীপসিনঝি। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর এগিয়ে আসছিল। এ কারণে বিসিসিআই চাচ্ছিল জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা এই দুলীপ ট্রফিতে সবাই খেলে নিজেদের ঝালিয়ে নেবে। ১৯৯২ এর অক্টোবরে ভারতীয় দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর ছিল। আর শচীনকে ছাড় দিতে ইয়র্কশায়ার ম্যানেজমেন্ট কোন ধরনের ঝামেলাই করেনি এবং আগেভাগে ছেড়ে দিয়েছিলেন শচীনকে। তথ্যসূত্র : শচীন টেন্ডুলকরের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ অবলম্বনে।
×