ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আব্দুল জব্বার খাঁন

ভূমিকম্প ঝুঁকি ও করণীয়

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২০ এপ্রিল ২০১৬

ভূমিকম্প ঝুঁকি ও করণীয়

পর পর কয়েকটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে গেল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ২০১৫ সালে ঘটে যাওয়া নেপালের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৮। এই ভূমিকম্পের হাইপোসেন্টার বা ভূগর্ভস্থ উৎসস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের মাত্র ৮.২ কিঃ মিঃ গভীরে। এত উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ভূপৃষ্ঠের এত কাছে সংঘটিত হওয়ায় নেপালে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অবর্ণনীয়। এই ভূমিকম্পে হাজার-লাখো বছরের যে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন হারিয়েছে নেপাল, সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব। বাংলা নববর্ষ ১৪২৩ বরণের আগের দিন ঘটল মিয়ানমার ভূমিকম্প মাত্রা ৬.৯। ভূপৃষ্ঠ থেকে এই ভূমিকম্পের গভীরতা ছিল ১৪০ কিঃমিঃ। উৎসস্থল অনেক গভীরে হওয়ায় বাংলাদেশ, ভারত এবং নেপালে এই ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হলেও খোদ মিয়ানমারেই তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা যায়নি। মিয়ানমার ভূমিকম্পের রেশ কাটতে না কাটতেই জাপানের কিউসু অঞ্চলে আঘাত হানল ৭.০ মাত্রার বড় দুটি ভূমিকম্প। ভূপৃষ্ঠের নিচে এর উৎসস্থল ছিল মাত্র ১০.০ কিঃমিঃ গভীরে। ফলে, এই ভূমিকম্পেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয়েছে ব্যাপক। একই পরিণতি দেখা গেছে ভূপৃষ্ঠের মাত্র ১৯.০ কিঃমিঃ গভীরে অবস্থিত উৎসস্থল থেকে ৭.৮ মাত্রার ইকুয়েডর ভূমিকম্পেও। অর্থাৎ ভূমিকম্পের মাত্রার সঙ্গে সঙ্গে এর উৎসস্থলের দূরত্ব এবং গভীরতার বিষয়টিও গুরুত্ববহ। সহজে বোঝার জন্য বলা যেতে পারে আপনার বাড়িতে শোবার ঘরে আপনি যদি একটি ১০০ ওয়াটের বাতি লাগান, সেটির আলো ঐ ঘরে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল আলো ছড়াবে, কিন্তু আপনার পাশের ঘরেই এর তীব্রতা কমে যাবে। তাই ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎসস্থল মিয়ানমারে হওয়ার মানেই হলো বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় এর মাত্রা ৬.৯ এর কম। উৎসস্থলের গভীরতা, বাংলাদেশ থেকে এর দূরত্ব এবং মাটির বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করবে ঐ ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের কতভাগ শক্তি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত ৬.০ এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের উৎসস্থল আমাদের ভূখ-ের মধ্যে না থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দুশ্চিন্তার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। ভূমিকম্প হয় কেন? আমাদের ভূপৃষ্ঠকে মোটামুটিভাবে ৭-৮ প্লেটে ভাগ করা যায়। এই প্লেটগুলোর পুরুত্ব ১০০ কিঃমিঃ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা পৃথিবীর অভ্যন্তরের উত্তপ্ত তরলের উপরে ভেসে আছে এবং প্রতি বছরে ০-১০০ মিঃমিঃ হারে সব সময়ই পা টিপেটিপে হাঁটছে। এদের এই নড়াচড়ার কারণে একটি প্লেটের সঙ্গে আরেকটি প্লেটের সংঘর্ষ হয় এবং এর ফলে আমরা কম্পন অনুভব করি। এ ধরনের ঘর্ষণজনিত কম্পন সারা বছরই ঘটে। মৃদু কম্পনগুলো আমরা অনুভব করতে পারি না। কম্পনের মাত্রা যখন বড় হয় তখনই আমরা বুঝি যে ভূমিকম্প ঘটেছে। বিভিন্ন সূত্রমতে জানা যায় ২-৩ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে বছরে এক লাখেরও বেশি, আর বড় ধরনের ভূমিকম্প অর্থাৎ ৬.০ মাত্রার অধিক ভূমিকম্প ঘটে বছরে এক শ’র কিছু বেশি সংখ্যক। ভূমিকম্পজনিত ঝুঁকি কমাবার জন্য আমাদের কিছু জরুরী প্রস্তুতি নিতে হবে। এই প্রস্তুতিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। এক. ভূমিকম্প আঘাত হানার আগের প্রস্তুতি। দুই. ভূমিকম্পের সময় করণীয় এবং তিন. ভূমিকম্পের পর দুর্যোগ মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। আমাদের দেশে এখন যে নতুন ভবনগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলো সবই বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মেনে ডিজাইন করতে হবে। এই দায়িত্বটি পুরকৌশলী এবং স্থপতিদের। একটি বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ভূমিকম্প সহনীয় করে ডিজাইন করলে ভবনের খরচ ধরনভেদে ৫-১০% বাড়তে পারে। ডিজাইন অনুযায়ী নির্মাণ কাজ হচ্ছে কিনা সেটি তদারকি করবে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং ভবন মালিকের পক্ষের কোন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। রাজধানী বা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলো সাধারণত শুধু অনুমোদিত স্থাপত্য নক্সা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হচ্ছে কিনা সেই বিষয়টি দেখে থাকে। নির্মাণের গুণগতমান দেখার মতো যথেষ্ট লোকবল এসব কর্তৃপক্ষের নেই। কাজেই তাদের কাছ থেকে এই সেবা প্রত্যাশা করা আপাতত অবাস্তব ভাবনা! ভবন নির্মাণের পর সেটি ব্যবহারের পূর্বে যে ‘অকুপেন্সি সনদ’ প্রয়োজন হয়, সেটির জন্য ঠিক যেভাবে ভবনটি নির্মিত হয়েছে সেসব তথ্যগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং ভবন মালিকের পক্ষের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে তৈরি করতে হবে। রাজধানী বা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এই তথ্যগুলোর সঙ্গে পুরকৌশলী এবং স্থপতি কর্তৃক ডিজাইনকৃত মূল নক্সা মিলিয়ে দেখে অকুপেন্সি সনদ প্রদান করলেই কেবল ভবনটি ব্যবহারযোগ্য বলে গণ্য হবে। উল্লেখ্য, শুধু এই কাজগুলো সবাই মিলে সততার সঙ্গে সুসম্পন্ন করলেই নতুন ভবনগুলোর শতকরা ৮০-৯০ ভাগ ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় হবে। অর্থাৎ, এসব ভবন ভূমিকম্পের সময় একেবারে ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। ফলে, প্রাণহানির পরিমাণ কমে যাবে। অনেকে ভূমিকম্পের সময় ভবন দুলে উঠলে আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। যেসব ভবন ভূমিকম্পের ফলে দুলতে পারে, সেগুলো প্রকৃত অর্থে অধিকতর ভূমিকম্প সহনীয় কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এসব ভবন হঠাৎ করে ভাঙবে না। বিষয়টা অনেকটা সুপারি গাছের মতো। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, প্রচ- ঝড়ের সময় সুপারি গাছের মাথা প্রচ-ভাবে দুলতে থাকে কিন্তু গাছ সহজে ভেঙ্গে পড়ে না। কিন্তু যেসব ভবন ভূমিকম্পে দোলে না, সেগুলো বরং হঠাৎ করে কাঁচের মতো ভেঙ্গে খানখান হয়ে যেতে পারে। যেসব ভবন পুরনো এবং যথেষ্টভাবে ভূমিকম্প সহনীয় নয় সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। এই কাজটি করতে হবে শীঘ্রই। কিছুদিন আগে রানা প্লাজার মর্মান্তিক ধসের পর আমরা আমাদের গার্মেন্টস শিল্প হারাতে বসেছিলাম। প্রতিকার হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে বাংলাদেশের সব গার্মেন্টস ভবনগুলোর অবকাঠামোগত ত্রুটি নিরূপণ করা হয়েছে এবং আমাদের দেশের প্রকৌশলীদের মাধ্যমে সেসব ত্রুটির প্রতিকারও করা হয়েছে। এ কারণে গার্মেন্টস শিল্প এখন ২০ বিলিয়নের বাজার থেকে ৫০ বিলিয়নের বাজার ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখছে। দেশের অন্যান্য ভবনের ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষা করার জন্যও একই পথে হাঁটতে হবে আমাদের এখন থেকেই। আমাদের পুরকৌশলীদের দক্ষতা এখন এমন পর্যায়ে রয়েছে যে, এ ধরনের কাজ করার জন্য কোন বিদেশী কারিগরি সহায়তার প্রয়োজন নেই। দুর্বল ভবনগুলোকে চিহ্নিত করে এগুলোকে মজবুতিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত অনতিবিলম্বে। একটি ধারণা দেয়ার জন্য বলা যেতে পারে যে, বিদ্যমান ভবনগুলোর মজবুতিকরণের জন্য খরচ এগুলো ভেঙ্গে ফেলে নতুন ভবন তৈরির চেয়ে কম। ভূমিকম্প যখন ঘটে তখন প্রথমেই আপনার মোবাইল ফোনটি সবার আগে হাতে নিয়ে ফেলবেন। এটি পরে উদ্ধার কর্মের সময় বাইরের পরিচিত মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সহায়তা করবে। বড় কাঠের টেবিলের তলায় অথবা খাটের নিচে আশ্রয় নিতে পারলে কনক্রিটের ছাদ ভেঙ্গে পড়লেও সরাসরি মাথায় আঘাত পাবার সম্ভাবনা কম থাকবে। অবশ্য আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টেবিলের উপরাংশ কাঠের না হয়ে কাঁচের হয়ে থাকে। আবার খাটগুলো হয় বক্স টাইপের। ভূমিকম্পের সময় এসব খাটের নিচে নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার কোন উপায় থাকে না। ভূমিকম্পের কথা বিবেচনায় রেখে আমাদের আসবাবপত্রের ডিজাইনেও কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। খাট বা টেবিলের নিচে আশ্রয় নিতে না পারলে সেক্ষেত্রে আপনাকে দৌড়ে গিয়ে কলামের কাছে দাঁড়াতে হবে। বিএনবিসি অনুযায়ী ডিজাইন করা থাকলে ঐ জায়গাটিই আপনার জন্য ঘরের মধ্যে একটি অন্যতম নিরাপদ জায়গা। যদি আপনার বিল্ডিংয়ে কলাম না থাকে, অর্থাৎ যদি আপনার ভবনটি লোড বিয়ারিং স্ট্রাকচার হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ছোট রুমের দেয়ালের কাছে অবস্থান নিন। ছোট রুমগুলোর ছাদ ভাঙ্গার সম্ভাবনা কম থাকে বা ভাঙলেও এই ছাদগুলোর কোণা অনেকটা ঝুলে থাকে। এতে করে আপনি সরাসরি আহত হবার বা একদম দম বন্ধ করা অবস্থায় আটকে পড়ার সম্ভাবনা কম থাকবে এবং পরবর্তীতে উদ্ধারকর্মীদের জন্য আপনাকে উদ্ধার করার কাজটিও সহজ হবে। কোন অবস্থাতেই ভবনের বাইরের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। কারণ, আপনার ভবনটি যদি সমূলে ভেঙ্গে পড়ে তাহলে আপনার চিড়েচ্যাপটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ভবনের বাইরে দৌড়ে পালিয়ে যাবার সময় পদপৃষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মনে রাখতে হবে, একটি ভূমিকম্পের স্থায়িত্বকাল মাত্র ৩০-৪০ সেকেন্ড হয়ে থাকে। তাই, ভূমিকম্প চলাকালীন সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন সময় পাবেন না আপনি। আগে থেকেই এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে সবার। স্কুল-কলেজে এবং অফিসে এজন্য ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত ড্রিল হওয়া দরকার। ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকর্মীরা যাতে করে সহজে ভবনগুলো থেকে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে পারে সেজন্য রাজধানী বা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত নক্সা অনুযায়ী দুই ভবনের মাঝে পর্যাপ্ত অফসেট (খালি জায়গা) রাখতে হবে। আমরা অনেক সময়ই এসব নিয়মের তোয়াক্কা করি না। এই খালি জায়গাটি না থাকলে উদ্ধারকর্মীদের যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করার জায়গা থাকে না। এর ফলে প্রাণহানির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস বিভাগকে এই উদ্ধারকর্মের জন্য ধীরলয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে। অগ্নি নির্বাপণের কাজের বাইরেও তাদের কর্ম পরিধি এখন অনেক বেড়েছে। শিশু জিহাদ থেকে শুরু করে ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া রাস্তার পাশের গাছ সরানো পর্যন্ত সব কাজই এই বিভাগকে করতে হয়। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, লোকবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া এবং আধুনিক উদ্ধার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম দিয়ে সুসজ্জিত করা এখন কালোত্তীর্ণ একটি প্রয়োজনীয়তা। একটু গভীরভাবে দেখলে এটিকে ফায়ার সার্ভিস বিভাগ না বলে দুর্যোগ মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ হিসেবে অভিহিত করা উচিত বলে মনে হয়। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস বিভাগ রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এটিকে দুর্যোগ মোকাবেলা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা উচিত কিনা সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে জরুরী ভিত্তিতে। লেখক : অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট
×