ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হৃদয়ে গেঁথে নিচ্ছেন বাংলা সংস্কৃতি

নগরে ভিনদেশীদের বৈশাখ উদযাপন

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

নগরে ভিনদেশীদের বৈশাখ উদযাপন

আনোয়ার রোজেন ॥ তাঁদের কারও মাতৃভাষা বাংলা নয়, তবু তাঁরা গাইলেন, ‘আমি বাংলায় গান গাই/আমি বাংলার গান গাই,’ ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ আবৃত্তি করলেন নজরুলের কবিতা, নাচলেন জনপ্রিয় বাংলা লোকগানের তালে তালে, ফ্যাশন শোতে অংশ নিলেন চিরায়ত বাঙালী পোশাকে। সব শেষে খিচুড়ি খেলেন ডাল, বেগুন ভর্তা আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে! ভাবছেন তাঁরা কারা? তাঁরা এক ঝাঁক ভিনদেশী নাগরিক। লরা সুজ, কনর ইনস্কিপ, শেলবি ইনস্কিপ, ডেভিড জে ডেভিলা, জোয়েল কার্টার, মিরিয়াম সিমস, সু জিন পার্কসহ ৩৫ জন। হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানির এই নাগরিকরা বাংলা শিখছেন। নিছক কাজের প্রয়োজনে নয়, বাংলাকে ভালবেসেই তাঁরা বাংলা ভাষা শিখছেন। একটু একটু করে হৃদয়ে গেঁথে নিচ্ছেন বাংলা সংস্কৃতি। এই বিদেশীরা যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি হৃদয় দিয়ে শিখছেন তার ‘প্রমাণ’ পাওয়া গেল গত ৮ এপ্রিল। চলনে, বলনে ও পোশাকে এই ভিনদেশীরা হয়ে উঠলেন আপাদমস্তক বাঙালী পুরুষ ও রমণী। সেদিন বিকেলে বনানীর যাত্রা বিরতি হলে ষষ্ঠ বর্ষপূর্তি এবং বিদেশী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সনদপত্র বিতরণ ও বাংলা নববর্ষ ১৪২৩ উদযাপন উপলক্ষে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে লার্ন বাংলা। এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু বিদেশী শিক্ষার্থীদের বাংলা শিখিয়ে থাকে। রাজধানীর বনানী ও উত্তরা শাখায় লার্ন বাংলার রয়েছে শতাধিক বিদেশী শিক্ষার্থী। সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। অন্যানের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব সুবোধ চন্দ্র ঢালী, লার্ন বাংলার চেয়ারম্যান লেনিন পিনারু। লার্ন বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেরী জুলিয়েট পিনারু জানালেন, বিদেশীদের বাংলা ভাষা শিক্ষা দিতে, পাশাপাশি তাদের বাংলা সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে অবহিত করতে এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মধ্যে একটি ইতিবাচক ধারণা জন্মানোর প্রচেষ্টায় ২০১০ সালের ১৪ এপ্রিল ‘লার্ন বাংলা’ তার কার্যক্রম শুরু করে। একজন ছাত্রী নিয়ে এটি শুরু হয়েছিল। এখন প্রায় ৫০টি দেশের শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা শিখছেন এবং তাদের প্রতিদিনের কার্যক্রমে বাংলা ভাষা ব্যবহারও করছেন। দেশজুড়ে হওয়া বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও যাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সে জন্য পহেলা বৈশাখের আগেই লার্ন বাংলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীও বৈশাখী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবার ৩৫ জন বিদেশী শিক্ষার্থীরা হাতে বাংলা ভাষা শিক্ষার সনদ তুলে দেয়া হয়। সনদ বিতরণের পর পরই শুরু হয় তাঁদের বাঙালী সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। দর্শকসারিতেও তখন বিদেশীদের দাপট! প্রথমেই সমবেত ভিনভাষী কণ্ঠ তবলা-হারমোনিয়ামের সুরে স্পষ্ট উচ্চারণে গেয়ে ওঠে, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/ তাপস-নিশ্বাস, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে...। গানের আয়োজনটি আয়োজনটি ছিল একেবারে বৈঠকী ঢঙের। এরপর ‘বাজেরে বাজে ঢোল আর ঢাক/ এলো রে পহেলা বৈশাখ’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন মালয়েশিয়ার তরুণী শাকিরা ফিরুজ। খোঁপায় গোঁজা গোলাপ আর পরনের লাল শাড়িতে শাকিরা যেন সত্যিই বাঙালী রমণী! এমন সাজ কার কাছ থেকে শিখলেন? জানা গেল, ভালবেসে বিয়ে করেছেন বাংলাদেশী তরুণকে। সেই ভালবাসা থেকেই শিখছেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। ডেভিড জে ডেভিলা আর লরা সুজ মিলে আবৃত্তি করলেন নজরুলের কবিতা। ডেভিড ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কন্সু্যুলেট অফিসার। দাফতরিক প্রয়োজনে নয়, ভালা লাগা থেকেই শিখছেন বাংলা তিনি। অন্যদিকে কেবল বাংলা ভাষা শেখার জন্যই সুদূর হাঙ্গেরি থেকে ঢাকায় এসেছেন লরা। ঢাকার একটি হাসপাতালে কাজ করেন নিউজিল্যান্ডের জোয়েল কার্টার ও মিরিয়াম সিমস। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা ‘ভালো আছি, ভালো থেকো/ আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’ গানটি দরদ দিয়েই গাইলেন দুই কিউই। এরিক রিগ শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবুর ভক্ত কি না তা জানা গেল না। তবে বাংলাদেশী শিল্পীর মতোই ঝুঁটি বাঁধা লম্বা চুল, দাঁড়ি-গোঁফ আর পাঞ্জাবিতে নজর কাড়লেন এই মার্কিন নাগরিক। গিটারের টুংটাং সুরে গাইলেন মাহমুদুজ্জামান বাবুর কণ্ঠে জনপ্রিয় হওয়া প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান ‘আমি বাংলায় গান গাই/ আমি বাংলার গান গাই।’ কনর ইনস্কিপ ও শেলবি ইনস্কিপ যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের বাসিন্দা। একটি আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এই মার্কিন দম্পতি। রাজধানীর কল্যাণপুরে তাদের অফিস। অনুষ্ঠানে কনর দম্পতির পরিবেশনায় হাততালি পড়েছে সবচেয়ে বেশি। দর্শক উচ্ছ্বাসও ছিল দেখার মতো। ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে...’ গানটির সঙ্গে এই দম্পতির সাবলীল নাচ সবাইকে মুগ্ধ করেছে। পরে কথা বলে জানা গেল, গানের সঙ্গে ঠিকঠাক নাচ ও অভিব্যক্তির জন্য দু’জনেই অনেক পরিশ্রম করেছেন। এমনিতে কনর ইনস্কিপ ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’খ্যাত বলিউড অভিনেতা আমির খানের ভক্ত। প্রিয় তারকার মতো নাচে ‘পারফেকশন’ আনতে বাসায় ওই গানের পুরনো ও নতুন অনেক ভিডিও দেখেছেন বলে জানালেন কনর। সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শেষ হয় ফ্যাশন শোর মধ্য দিয়ে। চিরায়ত গ্রামীণ বধূ, বাঁশিওয়ালা, একতারা হাতে বাউল, ঢোলবাদক, লাল-সবুজ পতাকা হাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সমর্থকসহ নানা বাঙালীরূপে হাজির হন একেকজন বিদেশী-বিদেশিনী। উপস্থাপক ইল রিও ও সু জিন পার্ক যখন বৈশাখের শুভেচ্ছা জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানলেন, তখনও ঘোর কাটেনি। এতসব চমৎকার পরিবেশনার অনুষ্ঠানটি বাংলায় সঞ্চালনা করলেন যে জুটি, তারাও যে বিদেশী (কোরিয়ান) তা মনেই হলো না! ততক্ষণে সদ্য ‘বাঙালীরা’ ছুটছেন নারকেলের নাড়ু, মুড়ি, পিঠা, তরমুজ, খিচুড়ি, ডাল, বেগুন ভর্তা, কাঁচা লঙ্কায়... সাজানো খাবার টেবিলের দিকে।
×