ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম হাসান

নববর্ষের আচার-অনুষ্ঠান

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১১ এপ্রিল ২০১৬

নববর্ষের আচার-অনুষ্ঠান

যেকাল চলে গেছে ভাল হোক, মন্দ হোক সে তো চলেই গেছে। কিন্তু অনাগত যেকাল এখনও আসেনি সেকালের প্রতিই মানুষের আগ্রহ বেশি। কারণ অনাগত কালেই তো লুকিয়ে আছে তার স্বপ্ন। এই স্বপ্নের জন্যই তো মানুষ বেঁচে থাকে। তাই তো অনাগত কালের আগমন মানুষ উৎসাহ-উদ্দীপনায়, আনুষ্ঠানিকতায় বরণ করে নেয়। কালের প্রবাহে আবারও এসেছে নতুন একটি বছর। নতুন স্বপ্ন। নতুন আশা। প্রস্তুতি চলছে নববর্ষ বরণের। গ্রেগারিয়ান বা আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১ জানুয়ারি হচ্ছে নববর্ষ। ওই দিনটি সারা বিশ্ব মহা আড়ম্বরের সঙ্গে স্বাগত জানিয়ে থাকে। বাংলাদেশেরও তার কমতি থাকে না। কিন্তু আমাদের আছে একটি নিজস্ব ক্যালেন্ডার। বাংলা বর্ষপুঞ্জি বা বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ। বাংলা সনের প্রথম দিন হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। বাংলা ভাষাভাষী সারা বিশ্বে বসবাসরত বাঙালী, গ্রাম- শহর নির্বিশেষে জাঁকজমকপূর্ণভাবে এই দিন আচার-আনুষ্ঠানিকতায় উদ্যাপন করে থাকে, যা গ্রেগরিয়নি নববর্ষ উদ্যাপনের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। বরং ক্ষেত্র বিশেষে বেশিই থাকে। উদ্যাপিত এসব অনুষ্ঠানে থাকে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি। একান্তই বাঙালী সংস্কৃতি বা বাঙালীপনা। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ইংরেজী সন বা হিজরী সন পূর্ব থেকে প্রচলন থাকলেও বাংলা সনের প্রচলন শুরু হয়েছে অনেক পরে। অনেক ইতিহাসবিদদের মতে, রাজা শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন। এই কারণেই ইংরেজী বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের চেয়ে বঙ্গাব্দের বর্ষপুঞ্জি পিছিয়ে আছে ৫৯৩/৫৯৪ বছর। তবে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদগণ মনে করেন মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রচলন, উন্নয়ন, প্রচার ও প্রসার ঘটান। মুঘলরা ছিল মুসলমান। ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর মুঘল সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরী সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। দেখা যেত নির্দিষ্ট কোন তারিখে মৌসুম পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন আমরা জানি চন্দ্র বছর সৌর বছরের চেয়ে ১১ বা ১২ দিন কম হয়। যে কোন মৌসুম পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় প্রতিবছর ১১-১২ দিন এগিয়ে আসে। নির্দিষ্ট সময়ে কৃষকরা ফসল তুলতে না পারায় খাজনা প্রদান করতে পারত না। এই সমস্যার সমাধান কল্পে তিনি নতুন পঞ্জিকা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। তৎকালীন সময়ে হিন্দুরা সৌর পঞ্জিকা অনুসরণ করত। এই সৌর পঞ্জিকা শুরু হােত গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সম্রাট আকবর এই সৌর সন ও হিজরী সনের ওপর ভিত্তি করে ৯৯৮ হিজরী বা ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে তার আমত্যবর্গের সহযোগিতায় নতুন বাংলা সন চালু করেন। তবে সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের ঘটনা স্মরণীয় করে রাখতে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে বা ৯৬৩ হিজরী সন হতে বাংলা সন শুরু করেন। অর্থাৎ জন্মলগ্নেই বাংলা সনের বয়স ৯৬৩ বছর। ৯৬৩ হিজরীতে আরবী প্রথম মাস মহররম চলাকালে যে মাসটি চলছিল ওই বছর (সৌর পঞ্জিকা অনুসারে পূর্বে থেকেই মাস ছিল) তাকেই বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। তখন ছিল বৈশাখ মাস। ফলে বৈশাখকে বাংলা সনের প্রথম মাস এবং পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। নববর্ষের আচার-আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান সবচেয়ে পুরাতন। বাংলা সন প্রচলনের সময় অর্থাৎ মুঘল সময় থেকেই পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান করা হতো। প্রজারা চৈত্র মাসের শেষে খাজনা পরিশোধ করতেন। এই কারণে পহেলা বৈশাখে জমিদারগণ প্রজাদের মিষ্টি মুখ করাতেন, কিছু আনন্দ উৎসব করা হতো। কালক্রমে বাংলার ব্যবসায়ী ও দোকানদারগণ এই প্রথা চালু রাখেন। তারা খদ্দেরদের বিগত বছরের পাওনা আদায় পূর্বক হিসাবের যোগ-বিয়োগ করে পুরাতন খাতার পরিবর্তে নতুন বছরের জন্য নতুন খাতায় হালনাগাদ হিসাব লিপিবদ্ধ করেন। এটাই হালখাতা। এই কাজটি হয় অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে। আজকাল ক্রেতাদের মিষ্টি মুখ করানো ছাড়াও ফলমূল বা অন্যান্য খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। কেউ কেউ উপহার সামগ্রী প্রদান করেন। পণ্যের ওপর বিশেষ ডিসকাউন্ট প্রদান করা হয়। এসব কারণে টাকা দেয়া বা নেয়া দুটোই যেন আনন্দময় হয়ে উঠে। গড়ে উঠে পারস্পরিক সম্প্রীতি সৌহার্দ্য। বৈশাখ মাস যেন মেলার মাস। গ্রাম বাংলার বিভিন্ন স্থানে বসে এই মেলা। মেলায় থাকে নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস, আরও কত কি? কোথাও কোথাও এই মেলার নাম বউ মেলা। এছাড়া আছে বুড়ির মেলা, চক্র মেলা, ভূতের মেলা, বটতলার মেলা ইত্যাদি। চৈত্রের শেষদিক বসে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। এই মেলার রেশ পহেলা বৈশাখেও থাকে। মেলা শেষে শিশুরা বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে হরেক রকম খেলনা হাতে আর বড়রা মুড়ি-মুড়কি চিনি সাজ আর মিষ্টান্ন নিয়ে বাড়ি ফেরে। মেলা শেষে মেঠো পথে সারিবদ্ধভাবে বাড়ি ফেরা যেন চিরচেনা কোন দৃশ্য। নববর্ষ উপলক্ষে শিশুদের জন্য কেনা হয় সাধ্যমতো নতুন জামা-কাপড়। শহরে তো ঈদের মতোই সকল বয়সীদের নতুন জামা-কাপড় পরার ধুম পড়ে যায়। ফ্যাশন ডিজাইনার বের করে নতুন নতুন ফ্যাশনের পোশাক। ঘরে ঘরে অন্যান্য দিনের চেয়ে উন্নত খাবারের ব্যবস্থা থাকে। লোকজন পার্কে, রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়াতে যায়। এক সময় নববর্ষ উপলক্ষে নৌকা বাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর বসত। প্রতিবছর চট্টগ্রামের লাল দীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত বলী খেলা এই ঐতিহ্যেরই অংশ। মডেল : মেরিন, আখি, শিমুল, সায়হাম, মহসিন ও মুন
×