ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

শান্তি তুমি কত দূর?

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১৯ মার্চ ২০১৬

শান্তি তুমি কত দূর?

আমি যখন পাক-ভারত সীমান্তে তখন বিকেলের সূর্য প্রায় অস্তাচলে। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির দেখে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল কী আশ্চর্য এই রাজনীতি। যে শিখরা ভারতকে যুদ্ধে জেতায় যাদের শৌর্যে বীর্যে ভারত গৌরবের শিখরে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল একসময়। সে এক নিদারুণ ইতিহাস। ইন্দিরা গান্ধীর মতো দেশপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রী ও কঠিন নেতার সঙ্গে শিখদের ভুল বোঝাবুঝি এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনে হচ্ছিল আর কোনদিনও এই সম্পর্ক আগের মতো হবে না। ধর্মীয় দিক থেকে শিখ ধর্ম যেমন কঠিন, তেমনি নিয়মানুবর্তী। আমি এবার গিয়ে দেখলাম তারা কতটা ধার্মিক আর নীতি মেনে চলেন। বলতে দ্বিধা নেই এমন সেলফ সার্ভিস বা নিজের কাজ নিজে করার ধর্মাশ্রম আগে দেখিনি। শয়ে শয়ে মানুষ খাটছেন। সবাই যার যার ইচ্ছে আর মনের তাগিদে এসে সেবা কাজ করছেন। কেউ রান্নায় কেউ পরিষ্কারে কেউবা পাহারায়। যারা জুতা রাখার দায়িত্বে তারাও স্বেচ্ছাসেবী। মধ্যবয়সী এক ভদ্রমহিলা যার মুখ দেখলেই বোঝা যায় তিনি অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মহিলা, আমার জুতাজোড়া ফেরত দেয়ার সময় তার একটা ছবি তুলতে চাইলে আপত্তি জানালেন। জানতে পারলাম স্বামী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি সুখী, স্ত্রী নিজ থেকে এসে এই কাজ করেন। মানুষের জুতা রাখার মতো কাজে যে ধর্ম প্রেরণা দেয় তার দুটো দিক তো থাকবেই। একটি হলো আকর্ষণের চুম্বক পাওয়ার। আরেকটি এর নিয়ম ও নিষ্ঠার পাশাপাশি কঠোরতা। সে জায়গাটাকে পুুঁজি করে সতবন্ত সিংহ ভিন্দ্রেন ওয়ালারা স্বর্ণমন্দিরে ঢুকে জঙ্গীবাদী কাজ চালাতে চেয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী তা হতে দেননি। অবশ্য তার পরিণতিতে তাকেও জানে বাঁচতে দেয়া হয়নি। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস জানি না যেদিন তিনি প্রাণ হারান সেদিন সন্ধ্যায় আমি বর্ডার পার হয়ে ভারত যাই। চারদিকে থম থমে অবস্থা। কলকাতা ছাড়া সব জায়গায় তাদের জান হাতের মুঠোয়। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার সেই অপারেশনে ভারতের ঐক্য টিকে গেলেও ইন্দিরাজী প্রাণ হারান। পরে বুটা সিংহ ও অন্যান্য শিখ নেতার ইজ্জত ধুয়ে গালে জুতার বাড়ি খেয়ে মাথায় জুতা নিয়ে সমাজে ফিরতে হয়েছিল। এমন কঠিন শিখ সম্প্রদায়ে খালিস্তান আন্দোলন তখন তুমুল জনপ্রিয়। বিদেশে যে কোন খেলা বা সুযোগ পেলেই তারা খালিস্তানের পতাকা হাতে মাঠে ছুটতেন। বলাবাহুল্য সে দুর্যোগে পাকিস্তানও চুপ করে বসে ছিল না। পাকিস্তানী মদদে শিখদের বিচ্ছিন্নতা বোধ জাগিয়ে উঠলেও বেশি দূর গড়াতে পারেনি। কারণ মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার পর ভারতীয়রা যেমন নেতাদের উদারতা ও সহিষ্ণুতা দেখেছিল বহু বছর পর ইন্দিরার বেলায়ও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। বড় ছেলে রাজীব যেমনি মনোহর তেমনি পরিমিত। দু’দিন পর টিভি ও অন্যান্য মিডিয়ায় তিনি এবং তার দল হানাহানি ও হিংসার বিরুদ্ধে বলে সাময়িক উত্তেজনা থামানোর পাশাপাশি ভারতীয় ঐক্য ও সংহতির যে দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন সে কারণে শিখ ও পাঞ্জাব এখনো ভারতের এক অনিবার্য অংশ। এবার দেখলাম পাক-ভারতের সীমান্ত সামলাচ্ছে তারাই। লাহোর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরের এই সীমান্ত জনপদে পতাকা বিনিময় ও সমবেত জনতার উত্তেজনা সামলানোর কাজে নিয়োজিত এদের দেখে কে বলবে একদা এরা প্রায় স্বাধীন হবার পথে পা বাড়িয়েছিল। উভয়দিকে সমবেত পাকি ও ভারতীয়দের ভেতর আর যাই থাকুক দেশপ্রেমের ঘাটতি ছিল না। তারা নিজ নিজ অবস্থান ও দেশের ব্যাপারে একরোখা। একমাত্র আমরাই এখনও নিজেদের কথা ভুলে এই দু’দেশের রাজনীতির লেজুড়গিরি করে চলেছি। যারা দেশে ভারতীয় রাজনীতির বাহক বা নানা কারণে এদের লবিং মেনে চলেন তারা কেন হিংসা ও বিবাদ ভুলে সমঝোতার পথ বেছে নিতে পারেন না? যারা কংগ্রেসের নেতাকে মারল, যারা ইন্দিরার মতো নেতাকে খুন করল তাদের মাফ করে দেয়ার ভেতর যে উদারতা ও অতীতকে দূরে সরিয়ে এগিয়ে যাওয়া সেটা আমরা মানিনি। একইসঙ্গে যারা আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির দুশমন তারাও তাদের প্রতিশোধ স্পৃহা দমিয়ে জাতীয় স্রোতে আসেনি। যে কারণে একাত্তরের হানাহানি ও হিংসা এখনো রাজনীতির মূল হাতিয়ার। এভাবে চললে একসময় নতুন প্রজন্ম হয়ত জানতে চাইবে এই স্বাধীনতা কি আসলেই জরুরী ছিল? ভারতের কথা নয় বাদই দিলাম, পাকিস্তানী দিকেও তাদের নেতা জিন্নাহ ও পতাকার গৌরব পত পত করে উড়ছিল। এত লড়াই মারামারি হানাহানির পরও পাকিস্তানী ঐক্য টাল খায়নি। আমাদেরই যত আপদ। যে কোন দেশের সীমান্তে এসে দাঁড়ালে বাংলাদেশীদের মনে বিকার এসে ভিড় করে। কারও কাছে ভারত দেবনগরী আর কারও কাছে পাকিস্তান মানে বেহশত। জাতীয় রাজনীতি যতদিন এর বিহিত না করবে ততদিন সুরাহা মিলবে না। আমার মনে হয়েছে বড় নেতাদের অকাল মৃত্যু ও ইতিহাস নিধনের কুফলে শাসনভার এমন সব নেতার হাতে গিয়েছে যাদের অনেকে এদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। আর একদল রাগে অপমানে এদের উৎখাত করাটাই দেশপ্রেম বলে মেনে নিয়েছেন। যে কারণে কোন বিষয়েই আমরা আসলে একক কোন জাতি সত্তা নই। সীমান্তে যখন গোধূলি তার আলো দিয়ে রাতকে স্বাগত জানাচ্ছিল পতাকা মুড়ে চৌকিতে ফেরত যাওয়া উভয় দেশের সেনাদের দেখলেই বোঝা যায় তারা ক্লান্ত। কাহাতক বা কতদিন? যারা দেখতে যায় তারা কয়েক ঘণ্টার অতিথি। তাদের উত্তেজনা সাময়িক। যারা পাহারাদার তাদের জীবন ও পরিবারের কথা কেউ ভাবে না। সীমান্ত যখন সুনসান ভোরে দুপুরে বা গভীর রাতে এরা মুখোমুখি হয়। এদের বুকের ভেতর কেবল গুলির আওয়াজ থাকে এমন ভাবনা সঠিক নয়। এদের ভেতর ভাব বিনিময় এমনকি দোস্তিও আছে। রাজনীতি ও শাসকদের হয়ে লড়াই করতে করতে একসময় পশুর মতো আচরণে বাধ্য হয় এরা। আমাদের চেহারা আরও করুণ। এক তরফা মার খাওয়া আর কথায় কথায় এর ওর দুশমন বলে গাল খাওয়া। রাজনীতির কঠিন শিকলে বাংলাদেশের দেশপ্রেম এমন আটকা পড়েছে এর পরিত্রাণ কোথায় কেউ জানে না। বহুকাল আগে শোনা একটি গল্পের কথা মনে পড়ছিল। বলা হয় যারা ফরাসী কলোনি ছিল একসময় তারা আবার একীভূত হয়ে যায়। যারা পর্তুগীজ বা অন্য কারও উপনিবেশ ছিল তাদেরও মিলন ঘটে। শুধু নাকি ইংরেজ ভাগ করে দিয়ে গেলে তারা আর কখনও এক হতে পারে না। পাক-ভারত সীমান্তে দাঁড়িয়ে নিজ দেশের কথা ভাবতে ভাবতে মনে হচ্ছিল এই কি আমাদের নিয়তি? কোন কালেও কি আর কোন নেতা বা দেবদূত এসে এই তিন দেশের মানুষদের আলাদা আলাদা করে ভালো থাকার মন্ত্র শিখিয়ে দিতে পারবে না? দেশ ও মানুষ কি পরাধীনতামুক্ত হয় হিংসা ও প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে? না সামনে এগিয়ে যেতে? এর উত্তর আমাদের জানা জরুরী।
×