ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নাসরীন মুস্তাফা

বোতল বাবার বেলুন ফোলানো

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৫ মার্চ ২০১৬

বোতল বাবার বেলুন ফোলানো

সাজ্জাদটা যে কেন আজব আজব মানুষের খবর নিয়ে পড়ে থাকে সারাক্ষণ, আমরা বুঝতে পারি না। পত্রিকার কাটিং দেখিয়ে আমাদেরকে এসব খবর বিশ্বাস করানোর জন্য চাপাচাপিও শুরু করে। আমি একদিন সাফ সাফ বলে দিলাম, পারলে জলজ্যান্ত একখান আজবকে চোখের সামনে হাজির র্ক! সাজ্জাদ ঝড়ের বেগে চলে গেল। বগলে গোঁজা পত্রিকার কাটিংগুলোও চলে গেল ওর সঙ্গে। সাজ্জাদ সত্যিই পথে পথে আজব মানুষ খুঁজে বেড়াতে লাগল। তাপু বলেছিল, সাজ্জাদকে নাকি আজব মানুষ খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হবে না। এ দেশের পথেঘাটে অনেকেই কেঁচোর তেল, শেয়ালের ঘিলু বিক্রি করে। এসব নাকি মহৌষধ। ক্যান্সারও নাকি সারিয়ে ফেলতে পারে। কিছু বোকা মানুষ এই দুষ্টু লোকগুলোর কথা বিশ্বাসও করে। আমাদের বন্ধু সাজ্জাদ বোকা লোকদের মতোই কা- করে বসল! একদিন টগবগে ঘোড়ার মতো ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ও নাকি সত্যি সত্যিই খুব খুব আজব একজনের দেখা পেয়েছে। তিনি বোতল বাবা! বিশ্বাস র্ক, উনি বোতলের ভেতর জিন ভরে রাখেন। বোতল বাবা জিনের সাহায্যে মানুষের সব সমস্যার সমাধান করে দেন। সমাধান হবে কি না, এটা বোঝা যায় খুব সহজে। বোতলের মুখে আটকানো বেলুনটা ফুলে ওঠে। বোতলের ভেতরে থাকা জিনগুলোই ফুঁ দিয়ে নাকি বেলুন ফুলিয়ে দেয়। ভীতু বলে দুর্নাম আছে রহমতের। ও মিনমিন করে বলল, বোতল বাবা কি বোতলের মতো দেখতে? তাপু বলল, নিজের চোখে দেখলেই বুঝবি। অগত্যা এক বিকেলে আমি, তাপু আর রহমত সাজ্জাদের নেতৃত্বে চলে এলাম বোতল বাবার আস্তানায়। রহমত আসতে চায়নি। তাপুই জোর করে নিয়ে এলো। নিজের চোখে বোতলের ভেতরের জিন দেখতেই হবে রহমতকে। বোতল বাবাকে দেখতে ঠিক বড়সড় কলসের মতো বলা যায়। বিশাল ভুঁড়িটার উপর ঘাড় ছাড়া মাথাটা স্রেফ বসানো। বিশাল সোফায় বসে থাকেন। সোফার এক পাশে রাখা বড়সড় একটা কাঁচের বোতল। একের পর এক মানুষ আসছে, লুটিয়ে পড়ছে বোতল বাবার বিশাল শরীরের সামনে মাটিতে। কেঁদে কেঁদে কত রকমের সমস্যার কথাই যে বলছে! বোতল বাবার কোন নড়াচড়া নেই, মুখের কোন ভাবও টের পাওয়া যাচ্ছে না। তবে লাল বেলুনটা ফুলে উঠেছে। তার মানে বাবার আদেশে জিনগুলো ফুঁ দিচ্ছে, বেলুনও ফুলছে। ফুলে ওঠা বেলুন দেখে চোখের পানি মুছে সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মানুষগুলো, তাদের মুখে হাসি। আপনা থেকে বেলুন ফুলে উঠছে, এটা নিজের চোখে দেখেও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না রহমত। আর সাজ্জাদের যা অবস্থা! ভক্তিতে গদগদ ওর মুখটা। তাপু পর্যন্ত হা হয়ে আছে। তবে ওর মুখটায় আস্তে আস্তে রাগও জমতে দেখলাম। সেই রাগ নিয়ে তাপু যখন এগিয়ে গেল ঠিক বোতল বাবার দিকে, তখন বুঝলাম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এক হাতে বোতল আর আরেক হাতের দুই আঙ্গুলে লাল একটি নেতানো বেলুন ঝুলিয়ে তাপু হাঁক দিয়ে বলল, ওরকম বেলুন ফোলাতে আমিও পারি। আমরা এই প্রথম দেখলাম, বোতল বাবা নড়ে উঠলেন। বললেন, এ ছেলে পাগল! ওকে বেঁধে ফ্যাল্! খেপে যাওয়া মানুষের সঙ্গে সাজ্জাদও আকাশে মুঠো পাকিয়ে সেøাগান দিচ্ছে, বাবার সঙ্গে বেয়াদবি/ মানব না মানব না! তাপু বিপদে পড়েছে বুঝে গেলাম। আমি তাপুর সামনে গিয়ে বুক চিতিয়ে হুঙ্কার দিলাম, তাপুকে বেলুন ফোলাতে দিতে হবে। এই কথায় বেশ কাজ হলো। বেশির ভাগ মানুষ আমার কথায় সায় দিল। তাপু ব্যাগের ভেতর থেকে ভিনেগারের বোতল বের করে ওর হাতে ধরা কাঁচের বোতলে চার আউন্স পরিমাণের ভিনেগার ঢেলে দিল। মুুখে বলল, এই বোতলের ভেতর আমি ভিনেগার ঢাললাম। এরপর একটা ছোট্ট ফানেল বের করে বোতলের মুখের সঙ্গে ফানেলের নল আটকে নিল। কাগজের প্যাকেট বের করে এর ভেতর থেকে কিছু একটা ফানেলের সাহায্যে ঢেলে দিল বেলুনের ভেতর। বলল, দুই চামচ পরিমাণের বেকিং সোডা দিলাম। তাপু বোতলের মুখে বেলুনের মুখ আটকে দিয়ে বেলুনের ভেতরকার বেকিং সোডা বোতলের ভেতরকার ভিনেগারের ভেতর পড়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে দিতে বাবাকেই প্রশ্ন করল, এবার কিছু হবে? বাবা, বলুন না? ভক্ত-সাগরেদরাও জানতে চাইল, এবার কিছু হবে, বাবা? বোতল বাবা হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, বোতলের ভিনেগার আর বেলুনের বেকিং সোডার মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হবে। তখন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস তৈরি হবে। সেই গ্যাস বেলুনটাকে ফুলিয়ে দেবে। বোতল বাবার কথা সত্য প্রমাণিত হলো। তাপুর বোতলের মুখে লাগানো বেলুনটাও বোতল বাবার বেলুনের মতো ফুলে গেল। তখন ভক্ত-সাগরেদের মুখ থেকে বেরুনো আ ধ্বনি কাঁপিয়ে দিল চারদিক। সেই আ ছাপিয়ে শুনতে পেলাম বোতল বাবার কান্না। নিজের কান দুই হাতে ধরে বলছেন, তিনিও বেকিং সোডা আর ভিনেগার দিয়ে বেলুন ফুলিয়েছিলেন। সবাইকে বোকা বানানোর জন্য বলেছেন, বোতলের ভেতর জিন পুরে রেখেছেন। আসলে ওসব কিছুই সত্য নয়। এরপর তার ভক্তরা খুব খেপেছিল। সবার আগে ছিল সাজ্জাদ। তাপু আর আমি বোতল বাবাকে ঘিরে দাঁড়ালাম। রহমতের দুই হাত আমাদের সঙ্গে মিলিয়ে রিনরিনে গলায় বলছিল, আইন নিজের হাতে তুলে নিতে নেই। ভাগ্যিস পুলিশ এসে নিয়ে গেল বোতল বাবাকে। নইলে যে কী হতো! অলঙ্করণ : নাসিফ আহমেদ
×