ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ ইমরান এইচ সরকার

অভিজিতরা হারলে হেরে যাবে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

অভিজিতরা হারলে হেরে যাবে বাংলাদেশ

একটি গুমোট সময় পার করছি- সন্দেহ নেই। যে ফেব্রুয়ারি মাস রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গর্জে ওঠা বাঙালীর অনন্য আত্মত্যাগের মাস, বইমেলার উৎসবে প্রাণে প্রাণ মেলানো ফাল্গুনের মাস- ক্রমেই তা শোকের পাথরে ভারি হয়ে উঠছে। এ যেন চিরাচরিত বাঙালীর উৎসবের বসন্ত নয়; বরং শোকের মাতমে, সহযোদ্ধা হারানোর যন্ত্রণায় আর বিচারহীনতার কিংবা প্রহসনের বিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে-প্রতিবাদে জাজ্বল্যমান এক অন্য বসন্ত। ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারি মাসের একেকটি তারিখ কী ভীষণ রক্তাক্ত আর ক্ষত-বিক্ষত। শাহবাগ থেকে শহীদ মিনার, টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর- সবখানেই কী এক পাথরচাপা শোক। এই শোক আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে, চোখ থেকে চোখে সঞ্চারিত হচ্ছে দারুণ ক্রোধে এবং জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছে চেতনার মোমবাতি আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে এবং সর্বশেষ আমাদের এনে দাঁড় করাচ্ছে সেই ন্যায্য প্রশ্নটির সামনে- এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার আমরা কবে পাব? বছর ঘুরে এসেছে ২৬ ফেব্রুয়ারি; ২০১৫ সালের এই দিনে বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসির জনবহুল চত্বরেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় লেখক অভিজিত রায়কে। গুরুতর আহত হন তার জীবনসঙ্গী বন্যা আহমেদ। এই এক বছরে অভিজিতের হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করেছি আমরাÑ তার সহযোদ্ধারা। সন্তান হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে সেই আন্দোলনে স্থির-অবিচল আর দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটেছেন শিক্ষাবিদ ড. অজয় রায়। কিন্তু এক বছরেও এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কোন কিনারা করতে পারেনি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উপরন্তু বিচারহীনতার সুযোগে ২০১৫ সালেই একের পর এক হত্যা করা হয়েছে মুক্তচিন্তার লেখক-প্রকাশকসহ আমাদের পাঁচজন সহযোদ্ধাকে, হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়েছে তিনজনকে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ কোন পথে দাঁড়িয়ে আছে, তা নিয়ে এক তীব্র সংশয়ের দোলাচল কাজ করছে প্রতিটি মানুষের মাঝেই। সারা পৃথিবী যেখানে বিজ্ঞান ও সভ্যতার আলোকে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, জাতি ও সম্প্রদায়গত বিভেদ ভুলে নতুন পৃথিবী গড়ার ডাক আসছে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে, সেখানে বাংলাদেশ কোথায়? এখনও বাংলাদেশে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা চলছে। কথায় কথায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলা হচ্ছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান সময়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ’ কেবলই একটি কাগুজে শব্দবন্ধ ছাড়া কিছুই না। প্রতিদিনের সংবাদমাধ্যমে যে বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠছে, তা কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ নয়; বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে রক্তাক্ত করে মধ্যযুগীয় বর্বরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী। যদিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ চলছে এবং অনেক রায় বাস্তবায়িতও হয়েছে; তবুও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি এখনও পূরণ হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে এখনও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি রাষ্ট্র। এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বদৌলতেই যুদ্ধাপরাধী ও দেশবিরোধী সংগঠন জামায়াত-শিবির দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। একের পর এক মুক্তমনের চিন্তাশীল মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে সারাদেশে তারা স্থাপন করছে কূপমণ্ডুকতার স্থবির ও কুৎসিত নজির। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাদের বেশি দূর যেতে হবে না। এক বছর আগে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক অভিজিত হত্যাকাণ্ডের তৎপরবর্তী রাষ্ট্রীয় ভূমিকাগুলোই যথেষ্ট। নাকের ডগার উপর ঘটে যাওয়া এ হত্যাকাণ্ডের কোন কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। তাহলে আমরা কী ধরে নেবÑ বাংলাদেশের পুলিশ অদক্ষ? না-কি তাদের মানসিকতাটাই অনেকটা জেগে ঘুমানোর মতো। একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিত রায়। কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ সময় তার স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন। বাংলাদেশী মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গীগোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’। পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। গত বছরের ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ কার্যালয়ে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফীন দীপনকে হত্যা করে এই মৌলবাদী ও জঙ্গীগোষ্ঠী। প্রাথমিকভাবে সিসিটিভির ফুটেজের কথা জানা গেলেও এক সময় পুলিশ এ বিষয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়। উপরন্তু সরকার ও পুলিশের নানা পর্যায়ের লোকজন ব্লগারদের সীমারেখা সংক্রান্ত অলৌকিক কিছু সারবত্তাহীন বক্তব্য দিতে থাকে। যেন অপরাধী গ্রেফতার বা অপরাধ দমনে কঠোর হওয়ার চেয়ে লেখকদের উপযাজক হিসেবে পরামর্শ দেয়াটাই এদের মূলকাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের এ ধরনের বক্তব্য হত্যাকারীদের জন্যই যেন এক ধরনের গ্রিন সিগন্যাল। অথচ তাদের বেতন-ভাতা সবই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় হয়, কেবল এদের বক্তব্যগুলো আর জনগণের বক্তব্য হয় না। আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে বাংলাদেশ হাঁটছে না। বাংলাদেশ হাঁটছে পেছন দিকেÑ বর্বর অন্ধকার সময়ের দিকে। এর কারণ অনুসন্ধান খুব জটিল কিছু নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি স্বাধীন বাংলাদেশকে নানাভাবে পশ্চাদপদ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ (বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য নানা দেশেÑ বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে তাদের লবিং চালিয়েছে। ষোলোই ডিসেম্বরের পর মুজিবনগর সরকার যখন দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে, তখন জামায়াতে ইসলামী নিয়ন্ত্রিত আলবদর, আলশামসের নরপিশাচরা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলনের ষড়যন্ত্র করেছে। স্বাধীন দেশে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনে বঙ্গবন্ধু সরকার। নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতে ইসলামীকে। বঙ্গবন্ধু সরকারের উদ্যোগে প্রণীত হয় বাহাত্তরের সংবিধান, যাতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন। কিন্তু পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আবার থমকে যায়। দালাল আইন বাতিলের মধ্য দিয়ে বন্ধ হয়ে যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া। সেনাতন্ত্রের ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় একাত্তরের পরাজিত শক্তি। আলবদরের নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন ছাত্রসংঘ রাতারাতি নাম বদলে হয়ে ওঠে ছাত্রশিবির। আমাদের রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার সুযোগ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে তারা শুরু করে বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতি। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছরে এ অপশক্তি ফুলে ফেঁপে এখন এক দানবের আকার ধারণ করেছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তারা পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির বিষ ছড়িয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে করেছে ভূলুণ্ঠিত। বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে এরা ক্ষমতায় এসেছে, অপবিত্র করেছে আমাদের মহান জাতীয় সংসদ। জঙ্গী অর্থায়নে বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে জঙ্গীবাদের অভয়ারণ্য হিসেবে এরা বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে। ২০০৮ সালে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। কিন্তু সেই বিচারের আইনে রাষ্ট্রপক্ষের আপীলের সুযোগ না থাকার যে বড় ফাঁদ রয়ে গিয়েছিল, তা ধরা পড়ে কসাই কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের পর। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে সরকার আইন পরির্বতন করে ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের রক্তের প্রতি তাদের দায় স্বীকার করে কিন্তু জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এই জামায়াত-শিবির বাংলাদেশে পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। জঙ্গী অর্থায়নের মাধ্যমে এরা বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠী তৈরি করেছে, যারা হত্যা করছে স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তচিন্তার মানুষদের। বিদেশী নাগরিক হত্যার মধ্য দিয়ে বারবার বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন, তেমন এখনও এ হায়েনারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, তাদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর-উপাসনালয়ের জায়গা দখল করছে। বিভিন্ন ধর্মীয় গুরুদের হত্যা ও আক্রমণ করা হচ্ছে। লেখক-প্রকাশকসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। এ হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্য দিয়ে সারা বাংলাকে এরা করে তুলছে অস্থিতিশীল। কিন্তু রাষ্ট্র যেন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। আজ পর্যন্ত অভিজিত হত্যাকাণ্ডের কোন ক্লু-ও তারা খুঁজে পায়নি। এতে রাষ্ট্রের মানসিকতাও আমাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, একটি দুঃসময়ের কঠিন পথ ধরে বাংলাদেশ খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে যাচ্ছে। যে স্বপ্ন আর দর্শনের আলোতে আমাদের পথচলার কথা, সেই আলো নিভিয়ে দিতে উদ্ধত হয়েছে মৌলবাদী, জঙ্গী আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিরা। রাজীব হায়দার, অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নীলাদ্রী নীল, অনন্ত বিজয় দাশ বা দীপনরা যে চিন্তা আর দর্শনের প্রদীপ জ্বালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সেই বাংলাদেশ নির্মাণের লড়াইয়ে এখনও আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সহযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ কোনভাবেই বৃথা যাবে না, কারণ তারাই আমাদের চেতনার অবিনাশী বহ্নিমশাল। লেখক : মুখপাত্র, গণজাগরণ মঞ্চ
×