ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান -মুনতাসীর মামুন

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৫ জানুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান  -মুনতাসীর মামুন

(২৪ জানুয়ারির পর) মিটিংয়ে লাখ লাখ মানুষ হয়েছে। এক ভদ্রলোক আপনার পরিচয় দিয়ে বলেছিল, ‘এই হচ্ছে মেজর জিয়া’। আপনার মনে আছে তারপর মানুষ কী ভালোবাসায় আর আনন্দে অভিভূত হয়ে আপনার সাথে করমর্দন করেছিল। সেখানে লাখ লাখ মানুষ ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবকে ছেড়ে আপনার সাথেই করমর্দনে ব্যস্ত ছিল। সেদিনই বুঝতে পেরেছি, বাংলাদেশের মানুষের কত আস্থা আপনার ওপর।” [পৃ. ২২] এত বড় একটা ঘটনা! ওই দিনের [অর্থাৎ পরদিন] সংবাদপত্রগুলো আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো খবর চোখে পড়েনি। ভাবছি, এত বড় একটা ঘটনা সবার চোখ এড়িয়ে গেল কিভাবে? এরপর তিনি, জিয়া ও নূরুল ইসলাম [নূরুল ইসলাম শিশু] মিলে আকবরের ভাষায় “সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি আগে গিয়ে একটা বেইজ ক্রিয়েট করবÑএকটা দল ক্রিয়েট করব যাতে তারা পরবর্তীতে এসে সেই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে পারেন এবং যাতে রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারেন।” [পৃ. ২৩] অর্থাৎ মুজিবকে অপসারণ, রাজনৈতিক দল সৃষ্টি, রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের [সিভিল শাসন উৎখাত] পরিকল্পনা অনেকদিন থেকেই এবং সেনাবাহিনীর আইন ভেঙ্গেই তারা এসব কাজ করেছিলেন। মোশতাক ক্ষমতায় এসে জিয়াকে সেনাপ্রধান করার মাধ্যমে তাদের ইচ্ছাপূরণ হয়। আকবর নিজেই লিখেছেন, মুজিব সরকার উৎখাতের জন্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং জিয়া তা জানতেন। শফিউল্লাহও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে লিফলেট বিতরণের ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন কিন্তু বিশদ কিছু লেখেননি। আকবর হোসেন স্বেচ্ছায় এই স্বীকারোক্তি না দিলে আমরাও বিষয়টি জানতাম না। এগারো. শফিউল্লাহ কর্নেল শাফায়াত জামিল সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন বারবার। তিনি বলতে চেয়েছেন, জামিল যদি সচেষ্ট হতেন তাহলে ফারুক-রশীদ গংকে তখনই গ্রেফতার করা যেত। শফিউল্লাহর আগে ১৯৯৮ সালে জামিলের গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। জামিলের অভিযোগ প্রধানত শফিউল্লাহর বিরুদ্ধে, খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে। জিয়ার বিরুদ্ধে ততটা নয়। জেনারেল ওসমানী ও জেনারেল এরশাদকেও তিনি অভিযুক্ত করেছেন। তিনি যখন আত্মপক্ষ সমর্থনে সাক্ষাতকার দিচ্ছেন বা বইটি লিখেছেন তখন শফিউল্লাহ বিদেশে। তার গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি জামিলের বক্তব্য খণ্ডন করেছেন বিস্তারিতভাবে। আমি সে বিশ্লেষণে যাব না। আমি নিজের পর্যবেক্ষণসহ এ বিষয়ে তার বক্তব্য তুলে ধরছি। কর্নেল শাফায়াত জামিলের বইয়ের নাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ : রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর। সুমন কায়সারের সহযোগিতায় বইটি প্রণীত। ১৯৯৮ সালে ১৫১ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করে সাহিত্য প্রকাশ। বইয়ের দুটি পর্ব। প্রথম পর্বে মুক্তিযুদ্ধে তার যোগদান, দ্বিতীয় পর্বে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুর হত্যাবিষয়ক ঘটনাবলি। আরও বহু বাঙালী অফিসারের মতো তিনিও বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে উদ্দীপ্ত হন ও মার্চের শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার চিন্তা করতে থাকেন এবং যথাসময়ে পাকিস্তানী কমান্ডিং অফিসারকে বন্দী করে বাঙালী সেনাদের নিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মিলিত হন। বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত যেসব যুদ্ধ করেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। নবেম্বরে রাধানগরে আহত হন। অপারেশন থেকে সুস্থ হলে আবার যুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন মেজর হিসেবে। আগস্ট ১৯৭৫ সালের পর কর্নেল হিসেবে তাকে অবসর দেয়া হয়। অবসর না হলে সাহসী এই যোদ্ধা নিশ্চয় জেনারেল হতেন। ১৯৭৫ সালের আগস্টে তিনি ছিলেন ঢাকা ব্রিগেডের অধিনায়ক। কৌশলগত কারণে পদটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর খুনী মেজর রশীদ ছিলেন তার অধীনে গোলন্দাজ ইউনিটের অধিনায়ক। তার পোস্টিং ছিল রংপুরে। সেনাপ্রধান তাকে বদলি করেন ঢাকায়। ১৫ আগস্ট সকালে এই মেজর প্রথম তার ঘুম ভাঙায়। তাকে বিস্মিত করে ঘোষণা করে ‘উই হ্যাভ কিল্ড শেখ মুজিব’। লিখেছেন তিনি, “আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে রশীদ বলে যেতে লাগল। উই হ্যাভ টেকেন ওভার দ্য কনট্রোল অব দি গভর্নমেন্ট আন্ডার দ্য লিডারশিপ অব খন্দকার মোশতাক। আপনি এই মুহূর্তে আমাদের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশনে যাবেন না। কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া মানেই গৃহযুদ্ধের উসকানি দেয়া।” [পৃ. ১০২] মেজর রশীদ বেরিয়ে যেতে না যেতেই সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ তাকে ফোন করলেন। বললেন, “তুমি কি জানো বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কারা ফায়ার করেছে? ... উনি তো আমাকে বিশ্বাস করলেন না।” বিড় বিড় করে একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন সেনাপ্রধান। তার কণ্ঠ বিপর্যস্ত। টেলিফোনে তাকে বিধ্বস্ত মানুষ মনে হচ্ছিল। আমি বললাম, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, তবে এইমাত্র মেজর রশীদ এসে আমাকে জানাল, তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করছে। তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণভারও গ্রহণ করছে। রশীদ যে আমাকে কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার বিরুদ্ধে হুমকিও দিয়েছে সেনাপ্রধানকে তাও জানালাম। সেনাপ্রধান তখন বললেন, বঙ্গবন্ধু তাকে টেলিফোনে জানিয়েছেন যে, শেখ কামালকে আক্রমণকারীরা সম্ভবত মেরে ফেলেছে। তবে সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা শেষে তার অবস্থান কী সে সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারলাম না। প্রতিরোধ উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ বা নির্দেশ কিছুই পেলাম না।” [ওই] জেনারেল শফিউল্লাহ কি এতই বিপর্যস্ত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন যে, কর্নেল জামিলকে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার কোন নির্দেশ দিলেন না? এ বিষয়ে শফিউল্লাহর বক্তব্য আগেই উল্লেখ করেছি। মেজর রশীদ মেজর হাফিজ ও লে. কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরীকে ধরে নিয়ে এসেছিলেন জামিলের বাসায়। জামিল হাফিজকে নিয়ে চললেন ডেপুটি চীফ জিয়াউর রহমানের বাসায়। জিয়া তখন শেভ করছিলেন। জামিল তাকে জানালেন সব বৃত্তান্ত। “মনে হলো জিয়া একটু হকচকিত হয়ে গেলেন। তবে বিচলিত হলেন না তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, 'So what, President is dead? Vice President is there, Get your troops ready, uphold the constitution.' [পৃ. ১০৩] বঙ্গবন্ধু শুধু রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন জাতির পিতাও। তার নিহত হওয়ার সংবাদে তিনি বিচলিত না হয়ে বলেন, উপ-রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নেবে। যেন এটি সাধারণ একটি ব্যাপার। জামিলকে তিনি ট্রুপস রেডি করার কথা বলছেন। কিন্তু তা প্রতিরোধের জন্য নয়। সংবিধান রক্ষার জন্য। কয়েকদিন পর ক্ষমতা পেয়ে এই জিয়াই সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেন। দুটি বিষয়ে অভিযোগ তুলেছেন জামিল। তিনি লিখছেন, “এই রেজিমেন্টের কর্মরত প্রায় ১৩শ’ সৈনিকের মধ্যে মাত্র শ’খানেক সৈন্যকে মিথ্যা কথা বলে ভাঁওতা দিয়ে ফারুক-রশীদরা ১৫ আগস্টের এ অপকর্মটি সংঘটিত করে। কয়েকজন অফিসার দেয়াল থেকে বঙ্গবন্ধুর বাঁধানো ছবি নামিয়ে ভাঙচুর করছিল।... সব কিছু দেখে খুবই মর্মাহত হলাম। আমার অধীনস্থ একজন সিওকেই কেবল বিমর্ষ মনে হলো।” [পৃ. ১০৮] এর মধ্যে খালেদ মোশাররফ এসে তাকে জানালেন, সেনাপ্রধান তাকে ‘সমস্ত অপারেশন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব’ দিয়েছেন। জামিলের মনে হয়েছে সেনাপ্রধান তাকে বিশ্বাস করছেন না। সকাল সাড়ে আটটার দিকে সেনাপ্রধান, জিয়া, একে খন্দকার, এমএইচ খানসহ অভ্যুত্থানকারীরা প্রথম বেঙ্গল অফিসের সামনে জড়ো হয়েছেন। তারপর তারা বাংলাদেশ বেতারের দিকে চলে গেলেন। জামিল লিখছেন, “এরই মধ্যে বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছি আমরা। আমি আশা করছিলাম বিমানবাহিনীর সহায়তায় সেনাসদরের তত্ত্বাবধানে বিদ্রোহ দমনে একটি সমন্বিত আন্তঃবাহিনী অভিযান পরিচালনার ব্যবস্থা নেয়া হবে। ... অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করলাম, সেনাপ্রধানের তত্ত্বাবধানে বিদ্রোহ দমনের কোনো পরিকল্পনা করা হলো না, যদিও তিন বাহিনী প্রধানই একসঙ্গে ছিলেন।” [পৃ. ১০৪] অন্যদিকে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন সেটিও গুরুত্ববহ। তিনি লিখেছেন, “এরপর বঙ্গভবন থেকে আদিষ্ট হয়ে খালেদ মোশাররফ দিনভর বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক সংস্থা, ইউনিট ও সাব ইউনিটের প্রতি একের পর এক নির্দেশ জারি করেছিলেন। তখনকার মতো সব কিছুরই লক্ষ্য ছিল বিদ্রোহের সাফল্যকে সংহত ও অবৈধ মোশতাক সরকারের অবস্থানকে নিরঙ্কুশ করা। অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এই কাজগুলো সম্পাদন করা হয়েছিল সেদিন।” [পৃ. ১০৬] জামিল লিখেছেন, বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন সেটি কাদের দ্বারা? সেই আমরা কারা? এটি তিনি পরিষ্কার করেননি। ব্যাপারটি একটু ঘোলাটে রেখে গেছেন তিনি। জামিল আরও লিখেছেন, দুপুরে জেনারেল শফিউল্লাহ ট্যাংকগুলোতে গোলা সরবরাহ করার আদেশ দেন জামিলকে এবং তখন তারা জানতে পারেন ট্যাংকগুলোতে গোলা ছিল না। খালেদ মোশাররফ জামিলকে বারবার বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আওয়ামী লীগের যে অংশ ক্ষমতা দখল করেছে তাদের প্রতি আনুগত্য স্থাপন করা অত্যন্ত পীড়াদায়ক।... এই বেইমানগুলোকে যত শিগগির উৎখাত করা যাবে জাতির ততই মঙ্গল। সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে হত্যাকারী ও তাদের মদদদাতা রাজনীতিকদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।” [পৃ. ১০৯] তিনি আরও বলেছিলেন, পক্ষ-বিপক্ষ বোঝা দুষ্কর। তাই কোন ভুল পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না। ১৬ আগস্ট জামিলকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি সেনাসদরে ফিরে গেলেন। জামিলের লেখায় আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য আছে যা প্রণিধানযোগ্য। তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। তাই তিনি তোফায়েলের বাসায় গিয়েছিলেন। তেমন কোন কথাবার্তা হয়নি। এ কথা জানার পর রশীদ-ডালিমরা তোফায়েলকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে। “আনুগত্য ও সমর্থন আদায়ের জন্য তার ওপর প্রবল মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। চলবে...
×