ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রযুক্তির পথ ধরে এগোচ্ছে

পিছিয়ে নেই গাঁয়ের নারী

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

পিছিয়ে নেই গাঁয়ের নারী

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে দেশে মোবাইল ফোন সাধারণের মধ্যে পৌঁছলে পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপনে নৌকায় বসে গাঁয়ের বধূর সেল ফোনে কথা বলার ছবি দেখে অনেকেই হাসাহাসি করেছে। কেউ বলেছে এও কি সম্ভব।...প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকে এক লোককে মোবাইল ফোনে কথা বলা দেখে অনেকে আনন্দ পেয়েছে। হাসা-হাসি হয়েছে।...একবিংশ শতকে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা নিরুপণের এক জরিপের ফলাফল- শহরাঞ্চলের ৯১ শতাংশ এবং গ্রামের ৮৭ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। ব্যবহারকারীদের মধ্যে গ্রামের মেয়েদের হারও কম নয়, প্রতি চার নারীর একজন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। মোবাইল ফোন ব্যবহারে নারী পুরুষের হার প্রায় সমান। এই জরিপ প্রমাণ করে গ্রামের নারীও পিছিয়ে নেই। বরং অনেক নারী একাধিক মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহার করে। যখন যে মোবাইল অপারেটর সাশ্রয়ী কল রেট দেয় গ্রামের অনেক নারী তার সুযোগ নেয়। অনেক পুরুষ হয়ত গুরুত্বপূর্ণ কথা কাউকে জানাতে ভুলে যায়, নারী তা ভোলে না। জরিপে এমনও দেখা গেছে পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে ছেলেরা যতটা যোগাযোগ রক্ষা করে মেয়েরা তার চেয়ে অনেক বেশি যোগাযোগ রাখে। এই যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম মোবাইল ফোন। মাঠ পর্যায়ের চিত্র বলে দেয় : গ্রামের প্রত্যেক নারী এখনই স্মার্ট (এন্ডরয়েড) ফোন ব্যবহার শুরু করলে তারা দ্রুত ইন্টারনেট এ্যাকসেস বা এ্যাপসের মাধ্যমে দুনিয়ার সকল খবর রাখতে পারবে। বর্তমানে গ্রামে বেসিক ফোনের ব্যবহার বেশি। ৯শ’ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যেই এই ফোন সেট মেলে। হালে গ্রামেও স্মার্ট ফোনের ব্যবহার বাড়ছে। শহরের অনেক পুরুষ যেখানে স্মার্ট ফোন ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারেনি অনেক ক্ষেত্রে বুঝতেও পারে না গ্রামের নারী এই স্মার্ট ফোন সহজেই রপ্ত করতে পারে। শহরের মতো গ্রামেও স্কুল ও কলেজপড়ুুয়া মেয়েরা সহজে স্বাচ্ছন্দ্যে বাটন ও স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে পারে। গ্রামের বধূরা তত সহজে পারে না তবে সন্তানদের কাছ থেকে শিখে নিয়ে ভয়েস কলের (কথা বলা) পাশাপাশি অন্যান্য এ্যাপ্লিকেশন (এ্যাপস) দ্রুত আয়ত্তে আনতে পারে। সামাজিক যোগাযোগে গ্রামের মেয়েরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঘরের কর্তা ব্যক্তি যখন পারিবারিক বন্ধনে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগে কার্পণ্য বোধ করে এই ক্ষেত্রে গ্রামের নারীর মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে যোগাযোগ অনেকটাই বেশি। যদিও তারা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক সুমধুর রাখতে ফোনে একটু বেশি কথা বলে তারপরও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে তাদের ভূমিকা বেশি। মোবাইল ফোনে টাকা আদান-প্রদানের মাধ্যম বিকাশের সঙ্গে গ্রামের বেশিরভাগ নারীর সেল ফোনের এ্যাকাউন্ট রয়েছে। কেউ টাকা পাঠালে ফোনের মেসেজ অপশনের ইনকামিংয়ে লেখা দেখেই তারা বুঝে নেয়। বাটন ফোনে এই কথাগুলো মনিটরে ইংরেজিতে ভাসে। স্মার্ট ফোন হলে ইউনিজয় ইনস্টল করা থাকলে ওই ক্ষুদে বার্তা বাংলাতেই আসে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো; গ্রামের যে বয়স্ক নারী এখনও নিরক্ষর তিনিও সন্তান ও নাতি পুতিদের কাছ থেকে বাটন ফোনের ইংরেজী অক্ষর ও স্মার্ট ফোনের বাংলা অক্ষর ছবির মতো দেখে নিয়ে ফোন ব্যবহার করেন। বয়স হওয়ার পরও তাদের স্মৃতি এখনও তীক্ষè। যা বর্তমানের তরুণীদের হার মানায়। বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) গ্রামের নারীদের বীজ সংরক্ষণ, গাছের চারা রোপণ ও পরিচর্যা, বাড়ির আঙিনায় সবজি আবাদ, পুকুরে মাছ চাষ, হাঁস মুরগি, গবাদি পশু পালনের প্রশিক্ষণ দেয়। এইসব নারী প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজেরা ঘর গৃহস্থালির পাশাপাশি সবজি আবাদ মাছ চাষ পশুপালন করার সময় কোন বিষয়ে ঠেকে গেলে পরামর্শের জন্য মোবাইল ফোনে দ্রুত যোগাযোগ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এই বিষয়ে বগুড়া আরডিএর কৃষি বিজ্ঞানের পরিচালক এ কে এম জাকারিয়া জানালেন, গ্রামের নারী এখন এতটাই সচেতন যে সবজির কিছু হলে মোবাইল ফোনে ছবি তুলে এমএমএস করে কর্মকর্তাদের কাছে পাঠায়। তারাও ফিরতি এসএমএসে পরামর্শ জানিয়ে দেয়। পরিচালক জাকারিয়ার কথা- এমন কথা শুনে কেউ বিশ্বাস না করলে বগুড়া আরডিএর কাছাকাছি গ্রামগুলোতে গেলে তার প্রমাণ পাবেন। এইসব গ্রামের নারী প্রশিক্ষণ পেয়ে এতটাই সমৃদ্ধ যে ফসলের ডাক্তারের মতো তারাই এখন পরামর্শ দেয়। বগুড়ার মারিয়া গ্রামের কিষান বধূ জাহান আরা বেগম বললেন, প্রাইভেট ব্যাংকে টাকা জমা ও উঠানের পর মোবাইল ফোনে যে মেসেজ আসে তা তিনি পড়ে বুঝতে পারেন। ব্যাংকের এটিএম কার্ডও তার আছে। কিভাবে টাকা তুলতে হয় তাও জানেন। মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে করতেই এইসব কার্ডের ব্যবহার বিধি শিখে গেছেন। বগুড়ার সোনাতলার রানীরপাড়া গ্রামের আঞ্জুমুনার বেগম বললেন, আগে ধান ভানার জন্য মিলে যেতে হতো। এখন মোবাইল ফোনে ভ্রাম্যমাণ হাসকিং মিলওয়ালাদের খবর দিলে বাড়ির উঠানে এসে ধান ভেনে দিয়ে যায়। উল্লেখ্য, হালে শ্যালো ইঞ্জিনের বহুমুখী ব্যবহারে ধান ভানাও হচ্ছে। সোনাতলার শিহিপুর গ্রামের আলতা বেগমের কথা- গ্রামের অন্তঃসত্ত্বা নারীর কোন ছোটখাটো অসুবিধা দেখা দিলে ধাত্রী বা নার্সের কাছে পরামর্শের জন্য মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। কখনও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার মোবাইল ফোন নম্বর দেয় যোগাযোগের জন্য। গ্রামের ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণীদের বেশিরভাগেরই স্মার্ট ফোন আছে। তারা অবসরে ফোনের মেমোরি কার্ডের অডিও গান শোনে ভিডিও ছবি দেখে। তাদের ফোনে স্কাইপ ভাইবার ইত্যাদি এ্যাপস আছে। গ্রামের যারা বিদেশে আছে এই এ্যাপসগুলোর মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেয়। যারা মনে করত গ্রামের নারী শুধু ঘর গেরস্থালি করে এইসব দেখে তাদের সেই মান্ধাতা ধারণা পাল্টে গিয়েছে। নব্বইয়ের দশকেও বৃহত্তর রংপুরের যে গ্রামগুলোর বহুল পরিচিতি ছিল মঙ্গাক্রান্ত সেইসব গ্রামের চিত্রও পাল্টেছে। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, মোবাইল ফোনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার রংপুরে। যেখানে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের ৮৭ শতাংশেরই মোবাইল ফোন আছে। যেখানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। ভাবা যায় যে এলাকা ছিল দারিদ্র্যপীড়িত সেই এলাকার তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের হার কত বেশি। এই চিত্রই বলে দেয় গ্রামের নারী মোবাইল ফোনের ব্যবহার কোন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। দিনে দিনে তারা যে আরও এগিয়ে যাবে সেই আলামত এখনই ফুটে উঠেছে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×