ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

প্রচলিত মিথের বাইরে দাঁড়িয়ে রাবনকে নায়কের আসনে বসানোর সাহস দেখানো সোজা কথা নয়। তাও সেই ঊনিশ শতকে। ঝড়ের মতো আবির্ভূত হয়ে বাংলা সাহিত্যের গদ্যে-পদ্যে আধুনিকতার আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দুর্দান্ত বর্ণময়তায়। তার আবির্ভাবের প্রচ-তা ধারণ করার ক্ষমতা সেকালের বাঙালী সমাজের ছিল না বলেই তার সাহিত্য-কর্ম নিয়ে যতটা না আলোচনা, তার চেয়ে বেশি সমালোচিত তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনযাপনের জন্য। স্কুল পাঠ্যবইয়ে তার সঙ্গে পরিচয় ‘কপোতাক্ষ নদ’ এর মধ্য দিয়ে- সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে; ... বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে? দুগ্ধ-স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে! আর কি হে হবে দেখা? -যত দিন যাবে ওই বয়সে এ কবিতা সুখপাঠ্য হওয়ার কথা নয়। তবু মাইকেল মনে গেঁথে আছেন ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক’ ‘বাংলায় সফল মহাকাব্যের জনক’ ইত্যাদি পরীক্ষা পাসের পাঠক্রম পেরোনোর মুখস্ত বিদ্যার পাশাপাশি তার বর্ণিল ব্যক্তি জীবনের জন্য। বাঙলা সাহিত্যে দু’জন উজ্জ্বল নক্ষত্র কর্মজীবন এবং ব্যক্তিজীবনে সমান বিদ্রোহী ছিলেন। একজন মধুসূদন দত্ত অন্যজন কাজী নজরুল ইসলাম। এদের জীবনে শঠতা বা ভ-ামী ছিল না, যা ভেবেছেন যা সত্য মনে করেছেন, তাই করেছেন। সে জন্যই দু’জনার ব্যক্তিগত জীবন কেটেছে নানা দুঃখে-কষ্টে। যদিও দু’জনার শ্রেণী অবস্থান বিপরীতমুখী, তাহলেও সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কারের তীর দু’জনাকেই সমান বিদ্ধ করেছে। ছাপোষা কিংবা সুবিধাভোগী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের মতো তাল মিলিয়ে চলার গতানুগতিক জীবন বেছে নেননি। ইংরেজী ভাষা ও ইংরেজ জীবনযাপনে প্রচ- প্রভাবিত ছিলেন মধুসূদন কিন্তু যখন নিজের সৃষ্টিতে মনোযোগী হলেনÑ ফিরলেন একেবারে নিজের ঐতিহ্য ও মিথের দিকে। বাল্মীকি রামায়ণকে উল্টে দিলেন। নিয়তির আশীর্বাদপুষ্ট নায়ক রামকে তিনি পাত্তাই দিলেন না। পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলোকিত মধুসূদন আলোড়িত হয়েছিলেন ইউরোপীয় রেনেসাঁয়। ইউরোপে পনেরো শতকে শুরু হয়েছিল রেনেসাঁ। ষোলো শতকে রিফর্মেশন আন্দোলন। দুটো ধারা আলাদাভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। একদিকে রিফর্মেশন আন্দোলন, অন্যদিকে রেনেসাঁ ইউরোপীয় সমাজে সামন্তবাদ বিরোধিতা, বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভরতা, রাষ্ট্রকে ধর্মের প্রভাবমুক্ত করা, জাতীয় রাষ্ট্রের আবির্ভাবকে এগিয়ে নেয়া ইত্যাদিকে ক্রমশ বেগবান করছিল। রেনেসাঁর সঙ্গে ধর্মীয় আন্দোলনের সম্পর্ক ছিল না। এর মধ্য দিয়ে বিকাশ ঘটেছিল সেক্যুলার সংস্কৃতির। সামন্তবাদের বিরোধিতা এবং বাণিজ্যিক বুর্জোয়ার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকেও ত্বরান্বিত করেছিল এ আন্দোলন। এতে আলোড়িত হয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ছাড়াও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ইত্যাদি প্রহসনে এর ছাপ রয়েছে। রেনেসাঁর ঢেউ লেগেছিল হিন্দু কলেজে তার সমসাময়িক অন্য অনেকের মধ্যে। ইতিহাসে যারা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত। রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের মাঝামাঝি সময়ে এদের আবির্ভাব। এই ইয়ংদের আন্দোলন সমাজে ঢেউ তুলেছিল। হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে এ আন্দোলনে আর যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রাম গোপাল ঘোষ প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। ‘ইয়ংবেঙ্গল’ আন্দোলনের স্থায়িত্ব খুব বেশি দিন ছিল না এবং সমাজ-ধর্মের প্রতি তাদের বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত উল্টো স্রোতে বয়েছিল। অর্থাৎ তারা ফিরেছিলেন প্রচলিত সমাজের গড্ডালিকায়। এর অন্যতম কারণ ছিল নিজের দেশ ও সমাজকে সঠিকভাবে চিনতে না পারা। ঊনিশ শতকের বাংলাদেশকে তারা ঊনিশ শতকের ইংল্যান্ড হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। হয়ত সেজন্যই হিন্দুধর্মের কুসংস্কারের উর্ধে উঠে সংস্কার আন্দোলনকে ধর্মের বাইরে রেখে বিধবা বিবাহ আন্দোলন, বহু বিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ আন্দোলনের নতুন ধারা তারা শুরু করলেও শেষে পুরোদস্তুর ধর্মীয় রীতিনীতি সংরক্ষণে মনোযোগী হয়েছিলেন। মধুসূদন পৈত্রিক ধর্মে আর প্রত্যাবর্তন করেননি। তিনি ইউরোপ গিয়েছিলেন আঠারো শ’ বাষট্টি সালে। যাওয়ার আগের ছয় বছর তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল সময়। এ সময় একে একে লেখেন শর্মিষ্ঠা, একেই কি বলে সভ্যতা?, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী ইত্যাদি নাটক ও প্রহসন, রতœাবলী নাটকের ইংরেজী অনুবাদ, তিলোত্তমা সম্ভব, ব্রজাঙ্গনা, মেঘনাদবধ, বীরাঙ্গনা ইত্যাদি কাব্য ও কবিতা এবং দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজী অনুবাদও এ সময় করেন। আঠারো শ’ সাতষট্টি সালে দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে আইন প্র্যাকটিস করেন। এ সময় প্রচুর টাকা আয় করলেও অমিতব্যয়িতার কারণে আবার অর্থ কষ্টে পড়েন। দীনহীনভাবে মৃত্যু হয় বাংলা সাহিত্যের সত্যিকারের এ দিকপালের।
×