ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

(২০ জানুয়ারির পর) সাত. মন্ত্রীদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর জিয়া খালেদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অপস অর্ডার’ তৈরি হয়েছে কিনা। খালেদ জানালেন, এখনও তৈরি হয়নি। জিয়া তখন রূঢ়ভাবে তাকে বললেন, যেখানে তার এখন বসে ‘অপস অর্ডার’ তৈরি করার কথা সেখানে তিনি বঙ্গভবনে বসে কী করছেন? তার সামনে খালেদের সঙ্গে জিয়ার এ রকম আচরণ শফিউল্লাহ পছন্দ করেননি। জিয়াকে তিনি জানালেন, একজন সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে এ রকম আচরণ ঠিক নয়, তাও আবার তার সামনে। তার মনে হচ্ছিল, জিয়া চাচ্ছেন না, খালেদ শফিউল্লাহর কাছাকাছি থাকুক। তারা যখন ফিরবেন তখন মোশতাক জানালেন, তিনি রাতে তিন প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। শফিউল্লাহ যেন বঙ্গভবন ছেড়ে না যান। রাতে বৈঠকে মোশতাক জিজ্ঞেস করলেন, সামরিক আইন জারির দরকার আছে কিনা? শফিউল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন এ প্রশ্ন আসছে কেন? সামরিক আইন তো ইতোমধ্যে জারি করা হয়েছে। এখন শুধু গেজেট নোটিফিকেশন করলেই চলে। মোশতাক জানতে চাইলেন, নোটিফিকেশন ইস্যু হবে কার নামে? শফিউল্লাহ বললেন, কেন রাষ্ট্রপতির নামে। মোশতাক চটে গিয়ে বললেন, সেনাবাহিনী সামরিক আইন ঘোষণা করেছে, এখন তা রাষ্ট্রপতির নামে ইস্যু হবে কেন? শফিউল্লাহ বললেন, একটি সরকার ক্ষমতায় থাকলে সামরিক বাহিনী মার্শাল ল’ ঘোষণা করতে পারে না। গলা চড়িয়ে মোশতাক বললেন, ‘তোমার বাহিনী যেহেতু ঘোষণা করেছে সেহেতু দায়িত্ব এখন তোমার।’ শফিউল্লাহ জানালেন, দায়িত্ব পালনে তিনি ভীত নন, সেনাবাহিনী যদি তার হতো তাহলে তার নামেই সামরিক আইন জারি হতো। কিন্তু তারা রাষ্ট্রপতির (মোশতাক) নামে ঘোষণা করেছে। মোশতাক এবার গলার স্বর নিচু করে বললেন, তিনি এতক্ষণ তর্ক করছিলেন আইনগত দিক সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা নেয়ার জন্য। এখন এ সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছার জন্যই আলোচনা। শফিউল্লাহ লিখেছেন, ওই সময় তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং বঙ্গভবন দখল করে রাখা ডালিমদের সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া। সে জন্য মোশতাকের সঙ্গে সব বিষয়ে তর্কের ইচ্ছা তার ছিল না। ১৬ আগস্ট বিকালে কনফারেন্সের আগে তিনি বঙ্গভবনে অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গভবন ছেড়ে নিজ নিজ ইউনিটে ফিরে যেতে। এ নির্দেশ তাদের হকচকিত করেছিল। অনেকের চোখে পানি চলে এসেছিল। কারণ, এ ধরনের নির্দেশ তারা আশা করেনি। শফিউল্লাহ কনফারেন্স রুমে পৌঁছার আগেই এসব অফিসার মোশতাকের কাছে গিয়ে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগে মোশতাক তাকে বললেন, এই অফিসারদের যেন আরো কয়েকদিন থাকতে দেয়া হয় বঙ্গভবনে। শফিউল্লাহ জানালেন, তিনি বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চান। মোশতাক ফের একই কথা বললেন। ১৭ আগস্ট খালেদ এসে শফিউল্লাহকে জানালেন, আর্মাড ইউনিট যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদের কাছে গোলাবারুদ নেই। শফিউল্লাহর কাছে এটি ছিল সুসংবাদ। কারণ, তা হলে এই বাহিনীকে দমন করা যাবে। তিনি খালেদকে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, খবরটা ঠিক কিনা? খালেদ বললেন, কথাটা সত্য; কিন্তু তিনি ১৫ আগস্ট তাদের গোলাবারুদ দিয়েছেন। শফিউল্লাহ বললেন, তার আদেশ ছাড়া খালেদ কিভাবে বিদ্রোহীদের গোলাবারুদ সরবরাহ করলেন। খালেদ বললেন, তিনি ভেবেছেন সব মীমাংসা হয়ে গেছে, গোলাবারুদ দিতে ক্ষতি কী? [ও ঃযড়ঁমযঃ বাবৎুঃযরহম ধিং ড়াবৎ ধহফ ঃযবৎব ধিং হড় যধৎস রহ রংংঁরহম ঃযবস ঃযব ধসসঁহরঃরড়হ ঃযবহ, ংড় ও ফরফ] খালেদের এই বিষয়টি শফিউল্লাহকে অবাক করেছিল। কারণ, এতক্ষণ ধরে খালেদকেই তিনি একমাত্র বিশ্বাস করছিলেন। এখন তাতে চিড় ধরল। তিনি এখন একা। হতাশ হয়ে একা বসে গত দুদিনের ঘটনাবলী তিনি পর্যালোচনা করছিলেন এবং জিয়া, শাফায়াত, খালেদ সবার কথাবার্তা, আচরণে একটা প্যাটার্ন খুঁজে পাচ্ছিলেন। তবে মন থেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কিন্তু তাদের কথাবার্তায় আচরণে যেন একটি ঐকমত্য ফুটে উঠছিল। এর মধ্যে মেজর রশীদ এসে বসলেন কাছে। শফিউল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এমনটি কিভাবে করতে পারলে? রশীদ বললেন, ‘স্যার, সে এক বিরাট কাহিনী। শফিউল্লাহ বললেন, বলো আমার সময় আছে। নিচে আমি রশীদের বয়ানের সংক্ষিপ্ত সার দিচ্ছি। সাফল্য আসবে না জেনেও তারা ঘটনাটি ঘটাতে চেয়েছিলেন, এটি ছিল এক ধরনের জুয়া খেলা। যদি সফল না হতেন, ধরা পড়তেন এবং ফাঁসি হতো; তা হলে ফাঁসিতে ঝোলার আগে বলে যেতেন, সিনিয়র সব অফিসারই এর সঙ্গে যুক্ত [...ঃযধঃ ধষষ ঃযব ংবহরড়ৎ ড়ভভরপবৎং বিৎব নবযরহফ ঃযরং বভভড়ৎঃ] এবং সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশেই তারা কাজটি করেছেন। শফিউল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, সিনিয়র অফিসার মানে কারা? ‘ঢাকায় আপনি ছাড়া প্রায় সবাই।’ রশীদ জানালেন, শফিউল্লাহকেও তিনি কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন জানাতে কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেননি। রশীদের মতে, প্রথমে তারা মেজর এবং লে. কর্নেলদের জানিয়েছিলেন, তারা এতে আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং বলেছেন যে, সিনিয়র অফিসারদেরও এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সিনিয়রদের মধ্যে প্রথমেই খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। খালেদ অফিসে ছিলেন, সেখানে শাফায়াত জামিলও ছিলেন। দু’জনকেই প্রস্তাবটি জানানো হয়, খালেদ বিষয়টিকে সিরিয়াসলি তো নিলেনই না বরং বললেন, ‘ভাগো ছেলেমানুষি করো না।’ [এবঃ ধধিু ধহফ ফড়হ’ঃ নব পযরষফরংয]। তারপর রশীদ জেনারেল জিয়ার কাছে প্রস্তাবটি নিয়ে যান। জিয়া জানালেন, সিনিয়র অফিসার হিসেবে তিনি এতে যোগ দিতে পারবেন না। তবে তারা যদি সফল হয় তাহলে তিনি সহায়তা করবেন। এরা কেউই শফিউল্লাহকে বিষয়টি জানাননি। শফিউল্লাহ লিখেছেন, এরপর সবার আচরণ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল এমনকি দিল্লী থেকে আসা জেনারেল মনজুরেরও। ১৭ তারিখ সারারাত আলোচনা চলল। ১৮ তারিখ ভোরে ফজরের নামাজের পর মোশতাক এলেন। তিনি সামরিক শাসনের একটি খসড়া শফিউল্লাহকে দিলেন। শফিউল্লাহ বললেন, রাষ্ট্রপতি এখন বিশ্রাম নিতে পারেন। ইতোমধ্যে তারা খসড়াটি পর্যালোচনা করে দেখবেন কোথাও ভুল আছে কিনা। ‘ভুল’ কথাটি শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন মোশতাক। হঠাৎ বলে ফেললেন, ‘জেনারেল শফিউল্লাহ, আমি গত তিন মাস ধরে এ নিয়ে কাজ করছি।’ এটি শুনে শফিউল্লাহ চমকে উঠলেন। কোনোমতে বললেন, ‘তা হলে মনে হয় সব ঠিকই আছে’, কী বলেছেন তার গুরুত্ব মোশতাক বুঝেছিলেন কিনা কে জানে। তবে মোশতাকের খসড়াই ২০ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ১৮ আগস্ট পর্যন্ত অর্থাৎ ৭২ ঘণ্টা শফিউল্লাহকে নানা অজুহাতে আটকে রাখা হয়েছিল বঙ্গভবনে। শফিউল্লাহর মনে হয়েছে, মোশতাক ধারণা করেছিলেন ক্ষমতা তার সংহত হয়েছে, না হলে শফিউল্লাহকে ছাড়তেন না। ১৮ তারিখ যখন তিনি সেনাসদরে ফিরছেন তখন দেখলেন, ডালিমরা আর তার পশ্চাদ্ধাবন করছেন না। তাহেরউদ্দিন ঠাকুরও নেই। অন্য সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তার সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকতেন। অফিসে ঢোকামাত্র তার এডিসি জানালেন, ৪৬ ব্রিগেডে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। আর্মার্ড আর্টিলারি গ্রুপই যে সমস্ত কিছু ঘটিয়েছে সেটি তারা নানাভাবে জাহির করছে। ৪৬-এর সৈন্যরা এখন বুঝতে পারছে এ বিদ্রোহ সেনাপ্রধানের নয়। সে থেকে তারা মুষড়ে পড়ছে। ১৮ তারিখ শফিউল্লাহ ঠিক করলেন সংশ্লিষ্ট অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করবেন। একে খন্দকার ও এমএইচ খানকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো। আলোচনার শুরুতেই ব্রিগেডিয়ার রউফ বললেন, যেহেতু এখানে গোপন বিষয় আলোচিত হবে সেজন্য সবার একবার গোপনীয়তার শপথ নিতে হবে। শফিউল্লাহ অবাক হলেন। এ ধরনের শপথ তো তাদের নেয়া আছে। তার ধারণা হলো, রউফ কাউকে সন্দেহ করছেন। সে জন্য শপথের কথা বলছেন। গোপনীয়তার শপথ নিতে সবাই রাজি হলেন। ওই সভায় সামগ্রিক বিষয় আলোচিত হয়। কয়েকজন ১৫ আগস্টের ঘটনার তীব্র নিন্দা করলেন। যে নৃশংসতা দেখানো হয়েছে সবাই তার নিন্দা করলেন এবং যারা আইন ভেঙেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হলো। শফিউল্লাহ এরপর ১৯ আগস্ট ফরমেশন কমান্ডারদের বৈঠক ডাকলেন। বৈঠক শুরুর আগে শাফায়াত ও মেজর হাফিজ ঢুকলেন তার রুমে। শাফায়াত ইতস্তত করে জানালেন, ‘স্যার, আপনার ডেপুটি জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাস করবেন না। সমস্ত ষড়যন্ত্রের হোতা তিনি।’ হাফিজও একই কথা বললেন। শফিউল্লাহ শুনে গেলেন। কারণ কাউকেই তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। ফরমেশন কমান্ডারদের সভায় শফিউল্লাহ সব খুলে বললেন এবং জানালেন এখন মূল কাজ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বৈঠক শেষ হওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ শাফায়াত জামিল মেজর রশীদ ও ফারুককে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বললেন, এরা নরমাল চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গেছে সুতরাং এদের শাস্তি হওয়া দরকার। এবং তিনি দেখবেন তাদের যেন কোর্ট মার্শাল হয়। রশীদ আর ফারুক অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। শফিউল্লাহ শাফায়াতকে থামালেন। চলবে...
×