ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জেনারেল জ্যাকবের প্রয়াণ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৬ জানুয়ারি ২০১৬

জেনারেল জ্যাকবের প্রয়াণ

চলে গেলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, ১৯৭১ সালে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ জেনারেল জেএফআর জ্যাকব। বুধবার সকালে দিল্লীর একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারসহ বাংলাদেশের জনগণ গভীরভাবে শোকাহত। আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন জেনারেল জেএফআর জ্যাকব। মিত্রবাহিনীর এই চৌকস জেনারেল মুক্তিযুদ্ধে যে ভূমিকা রাখেন, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ও অম্লান এক অধ্যায়। তিনি পাকিস্তান বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ দলিলের খসড়াও রচনা করেন জ্যাকব। তাঁর প্রণীত যুদ্ধ কৌশলের সাফল্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সেনাসহ নিয়াজী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল ‘সারেন্ডার এ্যাট ঢাকা : বার্থ অব এ ন্যাশন’ গ্রন্থের লেখক। জ্যাকব ছিলেন বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম মানবতাবাদী বন্ধু। তিনি একাগ্রচিত্তে বিশ্বাস করতেন এবং বরাবর অকপটে উচ্চারণও করতেন যে, মুক্তিযোদ্ধারাই বাংলাদেশীদের স্বতঃপ্রণোদিত সমর্থনে বাংলাদেশ ছিনিয়ে এনেছেন। ভারতীয় বীর যোদ্ধারা কেবল তাঁদের সহায়তা দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষকে প্রচ- ভালবাসতেন। তার প্রমাণও দিয়েছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বাংলাদেশ-ভারত জয়েন্ট কমান্ডের অধীনে কিংবদন্তিতুল্য ভূমিকা পালন করে যে ক’জন বীর ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন, জেনারেল জ্যাকব তাঁদের অন্যতম। বিশেষ করে ‘ঢাকার পতন’ ঘটাতে তিনি এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজী ও জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার মধ্যে ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানটি সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ছিলেন এর অগ্রগণ্য আয়োজন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে তিনি মধ্য ডিসেম্বরে ঢাকায় পা রাখেন। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরেই আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করতে তিনি মাঠপর্যায়ের মুখ্য রূপকার হয়ে উঠেছিলেন। এই ভূখণ্ডের মানুষের প্রতি তাঁর অনুরাগের প্রথম বহির্প্রকাশ ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে, যখন তিনি তাঁর সেনাদল নিয়ে বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি সব সময় বাংলাদেশ, দেশের জনগণের সাফল্য ও অগ্রযাত্রা কামনা করেছেন। জেএফআর জ্যাকবের জন্ম ১৯২৩ সালে। ব্যবসায়ী বাবার এই সন্তান দার্জিলিংয়ের একটি স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৯৪১ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নাম লেখান তিনি। পরিবার তাঁর সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিষয়টি প্রথম পর্যায়ে মেনে নিতে না পারলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইহুদীদের ওপর নাৎসী বাহিনীর নির্যাতনের বীভৎসতা মনোভাব পাল্টে দেয়। ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের চীফ অব স্টাফ হিসেবে কর্মরত অবস্থায় জেএফআর জ্যাকব ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে ও যুদ্ধ চলাকালীন নানাভাবে সহায়তা করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণকে। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য ভারত সরকার তাকে পিভিসিএম পদকে ভূষিত করে। একাত্তরের অবদানের জন্য ২০১২ সালের ২৭ মার্চ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জেনারেল জেএফআর জ্যাকবের হাতে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে জ্যাকব সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি ভারতের পাঞ্জাবের গবর্নর ও চ-ীগড়ের এ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা হারালাম একজন বিদেশী বন্ধুকে, যাঁর হৃদয়ে সব সময় জাগরূক থেকেছে বাংলাদেশ। আমরা এই বীরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
×