ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুকের আদ্যোপান্ত

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৫ জানুয়ারি ২০১৬

ফেসবুকের আদ্যোপান্ত

পান্থ আফজাল একুশ শতকের এই বিশ্বায়নের যুগে পরিবর্তনের পাগলা হাওয়া মানুষের জীবনধারায় এনেছে ব্যাপকতা আর নব্য প্রযুক্তি বা সিস্টেমের কল্যাণে জীবন হয়েছে সহজ ।পূর্বের সময়ের সেই ঘোড়া বা পায়রা দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো তাবত দূর-দূরান্তের মানুষের সঙ্গে আর সেখানে কিছু কিছু আবিষ্কার অনন্ত বিশ্বকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়। অকল্পনীয় বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদ জীবনের সুখে-দুখে, মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা-চেতনায় ফেলেছে প্রভাব। এই সময়ের তেমনি প্রযুক্তির আশ্চর্যজনক বিশ্বসামাজিক আন্তঃযোগাযোগ মাধ্যম হলো ফেসবুক, যা ছাড়া মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত করা অসম্ভব বটে! ফেসবুক বা ফেবু হলো আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থার একটি ওয়েবসাইট, যা ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মালিক হলো ফেসবুক ইনক। ব্যবহারকারীরা বন্ধু সংযোজন, বার্তা প্রেরণ এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলী হালনাগাদ ও আদান-প্রদান করতে পারেন, সেই সঙ্গে একজন ব্যবহারকারী শহর, কর্মস্থল, বিদ্যালয় এবং অঞ্চলভিক্তিক নেটওয়ার্কেও যুক্ত হতে পারেন। সারাবিশ্বে বর্তমানে এই ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করছেন ৩০০ মিলিয়ন কার্যকরী সদস্য। ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ফেসবুকের মূলধন ২১২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে উঠেছে। সে এক বিরাট ইতিহাস! মার্ক জাকারবার্গ, হার্ভার্ড এ তার ২য় বর্ষ চলাকালীন সময়ে, অক্টোবর ২৮, ২০০৩ এ তৈরি করেন ফেসবুকের পূর্বসূরি সাইট ফেসম্যাস। মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তার কক্ষনিবাসী ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র এডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিত্স এবং ক্রিস হিউজেসের যৌথ প্রচেষ্টায় ফেসবুক নির্মাণ করেন। এতে তিনি হার্ভার্ডের ৯টি হাউসের শিক্ষার্থীদের ছবি ব্যবহার করেন। তিনি দুটি করে ছবি পাশাপাশি দেখান এবং হার্ভার্ডের সব শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে বলেন। কোন ছবিটি হট আর কোনটি হট নয়। এজন্য মার্ক জুকারবার্গ হার্ভার্ডের সংরক্ষিত তথ্য কেন্দ্রে অনুপ্রবেশ বা হ্যাঁক করেন। ফেসম্যাস সাইট এ মাত্র ৪ ঘণ্টায় ৪৫০ ভিজিটর ২২০০০ ছবিতে অন লাইনের মাধ্যমে ভোট দেন। ফেসম্যাস হতে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০৪-এর জানুয়ারিতে মার্ক তার নতুন সাইটের কোড লেখা শুরু করেন এবং ফেব্রুয়ারিতে হার্ভার্ডের ডরমিটরিতে দি ফেসবুক.কম এর উদ্বোধন করেন। শীঘ্রই মার্ক জাকারবার্গের সঙ্গে যোগ দেন ডাস্টিন মস্কোভিৎজ (প্রোগ্রামার), ক্রিস হুগেস ও এডোয়ার্ডো স্যাভেরিন (ব্যবসায়িক মুখপাত্রও) এবং অ্যান্ডরু ম্যাককলাম (গ্রাফিক্ আর্টিস্ট)। জুনে প্যালো আল্টোতে অফিস নেয়া হয়। ডিসেম্বরে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছায়। ২০০৫ সালের আগস্টে ‘দ্য ফেসবুক ডটকম’ নাম পাল্টে কোম্পানির নাম রাখা হয় শুধু ‘ফেসবুক’। ফেসবুকের আয় কিভাবে আসে? ফেসবুকের বেশিরভাগ আয় হয় বিজ্ঞাপন থেকে। ফেসবুকে সাধারণত অন্যান্য প্রধান ওয়েবসাইট থেকে কম ক্লিকথ্রু হার (সিটিআর) রয়েছে। বিজনেসউইক.কমের মতে ফেসবুকের ব্যানার বিজ্ঞাপনে পাঁচ ভাগের একভাগ ক্লিক পড়ে অন্য ওয়েবের তুলনায়, যদিও সত্যিকার বিশেষ তুলনায় এটা অসম হতে পারে। ফেসবুকে ব্যবহারকারী জীবনলেখ্য একক ব্যবহারকারী পাতার ফরমেটটি ২০১১ সালের শেষের দিকে পুনর্গঠন করা হয় এবং যা পরবর্তীতে হয় প্রোফাইল অথবা ব্যক্তিগত টাইমলাইন হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। ব্যবহারকারীরা তাদের প্রোফাইল ছবি, চিত্র, ব্যক্তিগত আগ্রহ, যোগাযোগ ঠিকানা, জীবনের স্মরণীয় ঘটনা এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য (যেমন: চাকরি তথ্য) সহকারে তৈরি করতে পারে। ব্যবহারকারীরা একে অন্যের সঙ্গে উন্মুক্ত এবং গোপনীয়ভাবে যোগাযোগ করতে পারে বার্তা ও চ্যাটের সাহায্যে। এছাড়া ওয়েবসাইট ঠিকানা, ছবি এবং ভিডিও শেয়ার করে নিতে পারে। ৬ নবেম্বর ২০০৭ সালে ১০০,০০০ বেশি ফেসবুক পেজ তৈরি করা হয়েছিল। ফেসবুকে নিউজ ফিড, নোট, চ্যাট ও উপহার ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে খবরের বিষয়টি প্রকাশিত হয় যা প্রতিটি ব্যবহারকারীর হোমপেজ আসে এবং বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে যেমন প্রোফাইলে কোন পরিবর্তন, আগত কোন ইভেন্ট বা বন্ধুদের জন্মদিনের খবর ইত্যাদি। ২০০৬ সালের আগস্টের ২২ তারিখ ফেসবুক নোট চালু করা হয়, যা মূলত একটি ব্লগিং বৈশিষ্ট্যের ধারক। এটিতে ট্যাগ এবং ছবি যোগ করা যায়। ব্যবহাকারীরা পরবর্তীতে তাদের জাংগা (ঢধহমধ), লাইভজার্নাল, ব্লগার এবং অন্যান্য ব্লগিং সেবা থেকে ব্লগ আমদানি করতে পারার সুবিধা যোগ হয়। ২০০৮ সালের ৭ এপ্রিলের সপ্তাহে কমেটভিত্তিক তাৎক্ষণিক বার্তা আদান-প্রদান এ্যাপ্লিকেশন চালু করে যা চ্যাট নামে পরিচিত বিভিন্ন নেটওয়ার্কে। এটি ব্যবহাকারীদের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দেয় আর এটির ডেস্কটপভিত্তিক তাৎক্ষণিক বার্তার এ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে মিল রয়েছে। ২০০৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ফেসবুক উপহার সেবাটি চালু করে। যাতে ব্যবহারকারী বিভিন্ন উপহার তাদের বন্ধুদের পাঠাতে পারে। প্রতিটি এক ডলার করে দাম এবং এর সঙ্গে প্রেরকের নিজস্ব বার্তা জুড়ে দেয়া যায়। ভয়েস কল, ভিডিও কল, ভিডিও দেখা ও বার্তা প্রেরণের অনন্য মাধ্যম ২০১১ সালে এপ্রিল থেকে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা লাইভ ভয়েস কল করতে পারেন ফেসবুক চ্যাট দিয়ে, যা দিয়ে সারা বিশ্বের ব্যবহারকারীরা একে অন্যের সঙ্গে চ্যাট করতে পারেন। ২০১১ সালের ৬ জুলাই ফেসবুকের ভিডিও কল সেবা চালু করা হয় স্কাইপকে তাদের প্রযুক্তি অংশীদার করে। এতে স্কাইপ রেস্ট এপিআই ব্যবহার করে এক থেকে এক ব্যবস্থায় কল করা যায়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুক ঘোষণা করে তারা প্রতিদিন ১ বিলিয়ন ভিডিও দেখার সুবিধা প্রদান করছে। ৬৫ ভাগ ফেসবুকের ভিডিও দেখা হয় ফেসবুক মোবাইল থেকে যার ব্যবহারকারী দিন দিন বাড়ছে এবং ভিডিও দেখার হার ৫০ ভাগে এসে যায় মে থেকে জুলাই মাসে যখন আইসবাকেট চ্যালেঞ্জের হিড়িক পড়ে ফেসবুকে। একটি নতুন বার্তার পথ যার নাম প্রজেক্ট টাইটান চালু করা হয় ১৫ নবেম্বর ২০১০ সালে। অন্যান্য ফেসবুক বৈশিষ্ট্যের মতো ব্যবহারকারী এখানেও কার থেকে বার্তা গ্রহণ করবে তা ঠিক করে দিতে পারে তা হতে পারে শুধু বন্ধু, বন্ধুর বন্ধু অথবা যে কেউ। এর জন্য ফেসবুকের একান্ত একটি এ্যাপ রয়েছে যা ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার নামে পরিচিত। সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক নেটওয়ার্ক কমস্কোরের মতে, মাসিক অনন্য ভিজিটরের ভিত্তিতে ফেসবুক প্রধান সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট এবং তার ফলে এটি মাইস্পেসকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ২০০৮ সালে এপ্রিলে। মস্কোর আরও বলে, ফেসবুক ১৩০ মিলিয়ন অনন্য ভিজিটরকে আকর্ষিত করেছে মে ২০১০ সালে যা ৮.৬ মিলিয়ন লোকের সমাগম। সরকার কর্তৃক বন্ধ হওয়া ফেসবুক অনেক দেশেই বারেবারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে বন্ধ করা হয়েছে যার মধ্যে আছে চীন, ইরান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম এবং উত্তর কোরিয়া। উদাহরণসরূপ এটি পৃথিবীর অনেক দেশেই ধর্মীয় বৈষম্য ও ইসলামবিরোধী কর্মের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অনেক জায়গায় অফিসের কর্মীদের কর্ম সময়ে ফেসবুক ব্যবহার না করার জন্য বন্ধ করা হয়েছিল। সর্বাধিক জনপ্রিয় পাতা জুলাই ২০১৪ সালে সাকিরা প্রথম প্রসিদ্ধ ব্যক্তি হন যার পাতা ১০০ মিলিয়ন লাইক পার করে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালডো ছিলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি যার লাইক ১০০ মিলিয়নে পৌঁছায়। এরপরই আছেন রিহানা (৯৮ মিলিয়ন) এবং এমিনেম (৮৯ মিলিয়ন)। মার্ক জাকারবার্গ অভিনন্দনসূচক বার্তা রাখেন তাদের ওয়ালে। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে আমেরিকান লেখক বেন মাজরিচ ২০০৯ সালের জুলাইয়ে একটি বই প্রকাশ করেন জাকারবার্গ এবং ফেসবুকের প্রতিষ্ঠা নিয়ে, বইটির নাম দ্য এক্সিডেন্টাল বিলিয়নিয়ারস : দ্য ফাউন্ডিং অব ফেসবুক, এ টেল অব সেক্স, মানি, জিনিয়াস, এ্যান্ড বিট্রেয়াল। দ্য সোস্যাল নেটওয়ার্ক একটি নাট্য চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ২০১০ সালের পহেলা অক্টোবরে, পরিচালক ছিলেন ডেভিড ফিঞ্চার। এটি বেন মাজরিচের বইয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। ২০০৮ সালে ইংল্যান্ড ব্রাডফোর্ডের আইভি বিন, ১০২ বছর বয়সে ফেসবুকে যোগ দেন। এভাবে তিনি ফেসবুকের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পান। জুলাই ২০১০ সালে তার মৃত্যুর সময় তার বন্ধুর সংখ্যা ছিল ৪৯৬২ জন এবং টুইটারে তার অনুসরণকারী ছিল ৫৬০০০ জন। ২০১১ সালের ১৬ মে ইসরাইলের এক দম্পতি ফেসবুকের ‘লাইক’ বৈশিষ্ট্যের অনুকরণে তাদের মেয়ের নাম রাখেন। ফেসবুকের অন্যান্য প্রতিযোগী ফেসবুকের প্রধান প্রতিযোগীর মধ্যে আছে চীনে কিউজোন এবং রেনরেন; ব্রাজিলে অরকুট, দক্ষিণ কোরিয়ায় সাইওয়ার্ল্ড; রাশিয়া, বেলারুস, কাজাকস্থান, কিরঘিস্তান, মালডোবা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তানে ভিকে এবং অডনক্লাসনিকি; ড্রাগিয়েম.এলভি লাটভিয়ায়; ইরানে ক্লুব; ভিয়েতনামে জিং এবং জাপানে মিক্সি।
×