ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জুবায়ের আব্দুল বারি

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ১৬ অক্টোবর ২০১৫

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী

ডিএনএ গবেষণায় রসায়নে নোবেল সব জীবের ডিএনএ জিনোম থাকে। ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণের জিনগত নির্দেশ ধারণ করে। মানুষের ডিএনএর এমন একটি অংশ বা জিন নকশা তার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে, যা শত শত কিংবা হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় অব্যাহত থাকে। চারপাশের পরিবেশগত পরিবর্তন ওই জিনের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করলেও তা অটুট থেকে কুল রক্ষা করে। দেহকোষ কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ মেরামত করে সারিয়ে তোলে এবং বংশকুলের তথ্য রক্ষা করে, সেই কৌশল ব্যাখ্যা করেছেন এবারের নোবেল বিজয়ী তিন বিজ্ঞানী- থমাস লিন্ডাল, পল মোদরিচ ও আজিজ সানকার। এ বিজ্ঞানীদের গবেষণা জীবন্ত কোষের ভেতরে কী ঘটে সে বিষয়ে আমাদের মৌলিক ধারণা দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাদের পদ্ধতিগত কাজের মাধ্যমে কিভাবে জীবন্ত কোষ কাজ করে, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে কোষের বেশকিছু বংশানুক্রমিক রোগের কারণ সম্পর্কে ধারণাকে বিস্তৃত করবে। রসায়নে নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আজিজ সানকার , যুক্তরাজ্যের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউট ও ক্লেয়ার হল ল্যাবরেটরির সুইডিশ গবেষক টমাস লিনডল আর তৃতীয় বিজয়ী পল মডরিচ যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড হিউজ মেডিকেল ইনস্টিটিউট ও ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের গবেষক। নোবেল কর্তৃপক্ষ রসায়নে এবারের পুরস্কার বিজয়ী নির্বাচনের ব্যাখ্যায় বলেছে, ওই তিন গবেষক তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনাময় সীমানা খুলে দিয়েছেন। শরীর কিভাবে ডিএনএর ক্ষয় সারিয়ে তোলে, সে রহস্য তাঁরা উন্মোচন করেছেন। ডিএনএর এ ধরনের ক্ষয় বা পরিব্যক্তি মানুষের অসুস্থতা ও বুড়িয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী থাকে। ১৯৭০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা ডিএনএকে স্থিতিশীল অণু মনে করতেন। কিন্তু এটি দ্রুত ক্ষয়ে যায় বলে প্রমাণ করেছেন টমাস লিনডাল। নোবেল কমিটির ভাষ্য, ‘রসায়নে এবারের তিন নোবেল বিজয়ীর মৌলিক গবেষণা মানবদেহের অভ্যন্তরীণ কার্যপ্রণালী সম্পর্কে আমাদের ধারণা সুগভীর করেছে। তাছাড়া এ গবেষণার সহায়তায় জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পদ্ধতি বের করার চেষ্টায়ও বড় অগ্রগতি হতে পারে।’ নোবেল পাওয়া ওই তিন বিজ্ঞানী আট মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার ভাগাভাগি করে নেবেন। রহস্যময় কণা জয় করায় পদার্থে নোবেল লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি কণার স্রোত। অবিরাম বয়ে চলেছে সেই স্রোত। বয়ে চলার পথে মানুষকেও ভেদ করে চলেছে। কিন্তু মানুষ কিছুই বুঝতে পারে না। অনুভব করতেও পারে না। এই কণার নাম নিউট্রিনো। এক রহস্যময় কণা। বিজ্ঞানীরা এতকাল যাকে ‘ভুতুড়ে কণা’ বলে এসেছেন। এই কণা স্রোতের মতো বয়ে চলে। প্রায় আলোর গতিতে তারা ছুটে বেড়ায়। সেই কণার কিছু তৈরি হয়েছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির মুহূর্ত- বিগ ব্যাঙের সময়ে। কিছু সৃষ্টি হয়েছে সুপারনোভার বিস্ফোরণ থেকে। কিছু পরমাণুর তেজস্ক্রিয়তা ক্ষয়ের সময়ে। মানবদেহে পটাসিয়ামের আইসোটোপের ক্ষয়ের সময়েও প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ হাজার এই কণা তৈরি হয়। সর্বব্যাপী এই কণার নাম নিউট্রিনো। কিন্তু তাদের ধরা বড় কঠিন। আর তাদের ধরার কাজেই ব্যস্ত ছিল জাপান আর কানাডার দুই ডিটেক্টর। সেখানেই মিলেছে বয়ে চলা নিউট্রিনোর রূপান্তরের প্রমাণ। যা পদার্থবিদ্যায় গভীর ছাপ ফেলেছে। যার জন্য এ বছরের নোবেল পুরস্কার ঘরে তুলেছেন জাপানের তাকাকি কাজিতা এবং কানাডার আর্থার বি ম্যাকডোনাল্ড। কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ডের নোবেল পাওয়ার বিষয়ে রয়েল সুইডিশ এ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিউট্রিনোর ভর নির্ণয়ে তাঁদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। পদার্থের অধিকতম অন্তর্নিহিত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমাদের ধারণা এ আবিষ্কার পরিবর্তন করে দিয়েছে। এ আবিষ্কার কণার ধারণাগত মডেল ও মহাবিশ্বের শক্তি সম্পর্কিত প্রচলিত স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। নতুন এ আবিষ্কারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস, গঠন ও ভবিষ্যত সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলেও জুরি বোর্ড আশা প্রকাশ করেছে। পদার্থের অণুতে নিউট্রিনোর রূপ বদলের স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে এই কণার ভর থাকার ইঙ্গিত পেয়েছিলেন এই দুই বিজ্ঞানী। নিউট্রিনো অসিলেশন নিয়ে কাজ করে তারা প্রমাণ করেন যে, নিউট্রিনোর ভর রয়েছে। নিউট্রিনো পরমাণুর চেয়েও ছোট কণা, যার ভর প্রায় শূন্য এবং বলতে গেলে অন্য কোন কিছুর সঙ্গে এর মিথষ্ক্রিয়া ঘটে না। এ কারণে এদের নিয়ে গবেষণা করা ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ড জাপান ও কানাডায় যন্ত্র ব্যবহার করে এই কণার বৈশিষ্ট্য ও সুনির্দিষ্ট পরিমাপ নির্ধারণ করেন। নিউট্রিনোর রূপান্তর নিয়ে এ কাজের স্বীকৃতি পেলেন তারা। জাপান ও কানাডায় দুটি পৃথক নিউট্রিনো ডিটেকটরের অন্যতম বিজ্ঞানী এরা দু’জন। ডিটেক্টরে ধরা পড়ার আগে নিউট্রিনো নিজেকে রূপান্তরিত করে ফেলে। কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ড মোট অর্থ পুরস্কারের আট মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার ভাগাভাগি করে নেবেন। চিকিৎসায় নোবেল পরজীবী জনিত সংক্রমণ মোকাবিলায় দুটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য এ বছর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পেলেন তিন জন। এরা হলেন আয়ারল্যান্ডের উইলিয়াম সি ক্যাম্পবেল, জাপানের সাতোশি ওমুরা এবং চীনের ইউইউ তু। ক্যাম্পবেল ও সাতোশি মানবশরীরে পরজীবী গোলকৃমির সংক্রমণ নিরাময়ের ওষুধ এবং ইউইউ তু ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় নতুন ধরনের থেরাপি আবিষ্কারের জন্য এই পুরষ্কার পেলেন। অণুজীবদের দ্বারা সৃষ্ট অসংখ্য রোগের মধ্যে অন্যতম তিনটি রোগের নাম রিভাব ব্লাইন্ডনেস, গোদ বা লিমোফাটিক ফাইলেরিয়া এবং ম্যালেরিয়া। এবার চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল স্বীকৃতি দিল এ তিনটি রোগের সঙ্গে বিজ্ঞানের লড়াইকে। পুরস্কার হাতে উঠল তিনজনের। আমেরিকায় কর্মরত, জন্মসূত্রে আইরিশ উইলিয়াম সি ক্যাম্পবেল ও জাপানের সাতোশি ওমুরা আর চীনের ইউইউ টুর হাতে। কাজটা শুরু করেন জাপানের মাইক্রোবায়োলজিস্ট ওমুরা। তার নজর পড়ে স্ট্রেপটোমাইস গোত্রের ব্যাকটেরিয়ার ওপর। মাটিতে বসবাসকারী এ গোত্রের ব্যাকটেরিয়া নানা ধরনের এ্যান্টি-ব্যাক্রিয়াল পদার্থ উৎপাদন করে। ওমুরা নতুন গোত্রের স্ট্রেপটোমাইসকে চিহ্নিত করেন, মাটি থেকে সংগ্রহ করেন, গবেষণাগারে কালচার করেন। এই কালচার থেকে ওমুরা অণুজীবের সংক্রমণের চিকিৎসায় কার্যকরী হতে পারে এমন ৫০টি কালচারকে বেছে নেন আরও বিশ্লেষণের জন্য। আমেরিকায় কর্মরত ক্যাম্পবেল এ বিশ্লেষণের কাজ শুরু করেন। পরজীবী বিশেষজ্ঞ ক্যাম্পবেল দেখেন এই ৫০টি কালচারের মধ্যে একটি গৃহপালিত পশুর পরজীবী সংক্রমণে ভাল কাজ দিচ্ছে। এই কালচার থেকেই মেলে এ্যাভারমেকটিন। যা থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে আরও শক্তিশালী ইভারমেকটিন তৈরি করা হয়। মানুষের ওপরে ইভারমেকটিন পরীক্ষা করে দেখা যায়, নানা পরজীবীর সংক্রমণের সুফল মিলছে। বিশেষ করে রিভার ব্লাইন্ডনেস আর গোদে চিকিৎসায় ইভারমেকটিন অত্যন্ত সফল। পাশাপাশি কাজ চালাচ্ছিলেন টু-ও। চীনের এই নারী বিজ্ঞানীর ক্ষেত্র ছিল অতিপরিচিত ম্যালেরিয়া। মানব ইতিহাসে ম্যালেরিয়ার কালো ছাপ সেই কবে থেকে রয়ে গিয়েছে। ছিল চিকিৎসা পদ্ধতিও। কিন্তু সেই প্রথাগত চিকিৎসা, ক্লোরকুইনের ব্যবহারের কার্যকারিতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছিল। ১৯৬০-এর দশক থেকেই এটা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। কিন্তু ম্যালেরিয়ার দাপট কমা তো দূরের কথা, ক্রমেই আরও ভয়ঙ্কর আকার নিচ্ছিল। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে ম্যালেরিয়ায় অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছিলেন। নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির খোঁজে চীনের প্রাচীন আয়ুর্বেদে ডুব দেন টু। তার চোখে পড়ে আর্টেমিসিয়া আনুয়া উদ্ভিদটির ওপরে। প্রাচীন আয়ুর্বেদ ঘেঁটে টু এই উদ্ভিদ থেকে একটি বিশেষ উপাদানকে চিহ্নিত করেন। পরে উপাদানটির নাম হয় আর্টেমিসিনিন। দেখা যায়, ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় আর্টেমিসিনিন খুব ভাল কাজ দিচ্ছে। ম্যালেরিয়ার পরজীবীকে সংক্রমণের একেবারে প্রথম দিকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম আর্টেমিসিনিন। গরিব দেশে আর্টেমিসিনিন প্রায় জাদুর মতো কাজ করেছে। কম্বিনেশন থেরাপিতে এ ওষুধের ব্যবহার পূর্ণবয়স্কদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার প্রায় ২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহারে মৃত্যুর হার কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। চীনের ইউইউ তু হলেন বিশ্বের ১৩তম এবং প্রথম চীনা নারী যিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন। ৮৪ বছর বয়সী তু বর্তমানে বেজিংয়ের চায়না একাডেমী অব ট্রাডিশনাল মেডিশিনে কর্মরত আছেন। অপরদিকে উইলিয়াম সি ক্যাম্পবেল নিউজার্সির ড্রিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিঞ্জানী এবং সাতোশি ওমুরা জাপানের কিতাসাতু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য বাবদ ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনারের অর্ধেক পাবেন উইলিয়াম সি ক্যাম্পবেল ও সাতোশি ওমুরা। আর বাকী অর্ধেক পাবেন ইউইউ তু। আগামী ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে। সূত্র : বিবিসি, সায়েন্স ডেইলি
×