ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজিজুল ইসলামের বাঁশির সুরে মুগ্ধ শ্রোতা

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১১ অক্টোবর ২০১৫

আজিজুল ইসলামের বাঁশির সুরে মুগ্ধ শ্রোতা

গৌতম পাণ্ডে ॥ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন ইতোমধ্যেই শ্রোতার উপস্থিতিতে কানায় কানায় ভর্তি। সবাই উৎসুক হয়ে বসে আছে ওস্তাদ আজিজুল ইসলামের বাঁশির ঝংকারের অপেক্ষায়। মঞ্চকেও সাজানো হয়েছে বাহারি ফুলের বিচিত্র শোভায়। শুক্রবার শিল্পীর একক বাঁশিবাদনের এ আয়োজন করে জাতীয় জাদুঘর। শিল্পীর বাঁশির সুরে এদিন শ্রোতারা শুধুমাত্র মুগ্ধই হয়নি, বিস্মিতও হয়েছিলেন। সুরের মায়াজালে সবাই যেন ধ্যানের জগতে চলে গিয়েছিলেন। মিলনায়তনজুড়ে তরঙ্গায়ীত হচ্ছিল শুধুমাত্র বাঁশির সুর। বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ প্রয়াত ওয়াহিদুল হক শিল্পীর এক বাঁশিবাদন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বাদক কিংবা গায়ক মাত্রই শিল্পী নয়। বাংলাদেশে শিল্পী খুঁজতে হলে অনুবীক্ষণ যন্ত্র লাগবে। আজিজুল ইসলাম শিল্পী, যাঁকে সাঙ্গীতিক পরিভাষায় বলা হয় আত্যয়ী। কেবলমাত্র সঙ্গীতকে ভালবেসে তাতেই জীবন সমর্পণ করেছেন। সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে যিনি খুঁজে পেয়েছেন বাঁশির সুর, পেশাদারিত্বের তাগিদে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তর, নিঃসঙ্গতার মাঝে এই নাবিক হাতে তুলে নিয়েছিলেন বাঁশের বাঁশি। তাঁর বাঁশির সুর শুধুমাত্র দেশের শ্রোতাদের মুগ্ধ করেনি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রোতাদেরও মুগ্ধ করেছে অবলীলায়।’ শিল্পীকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস। জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি এম. আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে স্বাগত ভাষণ দেন জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে শিল্পী আজিজুল ইসলামকে ফুল ও সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। এরপর উপস্থিত হলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। শিল্পী রাগ ‘কিরওয়ানী’ দিয়েই শুরু করেন তাঁর পরিবেশনা। প্রথমে আলাপের মাধ্যমে রাগটির গাম্ভীর্যকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন শিল্পী। পরে জোর ও ঝালা এবং মত্ত তাল ও তিন তালে গৎ বাজিয়ে শোনান। প্রায় এক ঘণ্টা ব্যপ্তিতে অসাধারণ এক সুরের মূর্ছনা ছিল মিলনায়তনজুড়ে। শিল্পীর সঙ্গে সৈয়দ মেহের হোসেনের তবলা বাদন ও মোঃ জাহাঙ্গীরের তানপুরার সুর এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছিল। শ্রোতাদের সবার যে রাগ-রাগিণী সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল এ কথা বলে যাবে না, কিন্তু সুরের আবর্তন যে সবাইকে মোহময় করে তুলেছিল এটা বলা যায়। বাাঁশির সুরের ঢেউ কোন কোন ক্ষেত্রে সবাইকে আলোড়িত করছিল, এটা ঠিকই বোঝা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে হাত তালি দিয়ে বাহবা জানানে ভুল করেনি শ্রোতারা। শিল্পীর পরবর্তী পরিবেশনা ছিল রাগ ‘হংসধ্বনি’। রাগটির সময়কাল যদিও রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর, তবে রাগটির পরিবশেনায় প্রগাঢ় এক বৈকালিক আবহ যেন খুঁজে পাওয়া যায়। যখন নিঃস্তব্ধ জলাভূমির ওপর দিয়ে উড়ে যায় ঝাঁক ঝাঁক হাঁস গোধূলী লগ্নের চরাচরের স্তব্ধতাকে ভেঙেচুরে রাগ হংসধ্বনি সে রকমই কিছু বলে হয়ত। শিল্পী সেতারখানী তাল ও তিন তালে রাগটি বাজিয়ে শোনান। মিলনায়তনজুড়ে যখন চলছে রাগ-রাগিণীর সুরের খেলা। সবাই পিন পতন নীরবতায় শুধু সুরের মধ্যে নিজেদের সিক্ত করে চলেছেন ঠিক তেমন সময় সামান্যের জন্যে হলেও শ্রোতাদের অন্য মনস্ক করে তোলে একটি বিষয়। আর সেটা হলো আয়োজক পক্ষ থেকে খাবার বিতরণ। সবার মধ্যে বিতরণ হতে থাকে একটি পানির বোতল ও চিপসের প্যাকেট। এটা দেখতে যেমন ছিল দৃষ্টিকটু, মিলনায়তনজুড়ে চিপস খাওয়ার শব্দটাও ছিল বিরক্তিকর। যেটা শিল্পীকে বাঁশি বাদনে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটাতে দেখা যায়। শিল্পী বাদনের ফাঁকে বার বার বলার চেষ্টা করছিলেন মাইকের শব্দের কোন সমস্যা হচ্ছে কি না। এরপর তিনি পরিবেশন করেন রাগ ‘ঝিনঝটি’। সেতারখানি তালে দারুণ এক আবহ সৃষ্টি হয় তখন। রাগে কখনও কখনও ভাটিয়ালীর রূপ পরিগ্রহ করে। শিল্পীর সব শেষ পরিবেশনা ছিল মিশ্র খাম্বাসের ধুন। যার শুরু ছিল ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’। কীর্তন, ভাটিয়ালী আর পিলুর মিশ্রণে অসাধারণ এক সুর কল্লোলে শিল্পী সবাইকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করেন।
×