ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

রূপপাথারে নৈসর্গিক রূপের খনি চান্দার বিলের রূপ

শরিফুল রোমান,মুকসুদপুর,গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৩:০০, ১৯ জুন ২০২৫

রূপপাথারে নৈসর্গিক রূপের খনি চান্দার বিলের রূপ

ছবি: জনকণ্ঠ

জীব বিচিত্রের লীলাধার এ বিলে মানুষের জীবনধারা  বর্ণনাতীত সংগ্রামমুখর। পথ হয়ত বদলায়, জীবন বদলায় না। 

জীব বিচিত্রের আধার ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চান্দা বিল । ২৭টি গ্রাম ও ৬টি মৌজা নিয়ে বিল চান্দার অবস্থান।  

চান্দা বিলের জন্ম হয়েছে কতদিন আগে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও সুন্দরবনাঞ্চল অধ্যুষিত এ এলাকায় ধারণা করা হয় এক সময় সুন্দরবন ছিল। 

কালেরগর্ভে প্রাকৃতিক দূর্যোগে বা ভূমিকম্পে বনাঞ্চল ধসে বিলের সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। কারণ চান্দার মাটিতে প্রচুর পিট কয়লা সে ইঙ্গিত বহন করে।
চান্দা বিলের নামকরণেও রয়েছে নানান কল্পকাহিনি। নামকরণের যত কল্পকাহিনি রয়েছে তার মধ্যে গ্রহণযোগ্য হলো যে, মোঘল আমলে দক্ষিণ বাংলার বিখ্যাত ব্যবসায়ী চাঁদ সওদাগর বাণিজ্য শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় দৈবাৎ মালামাল বোঝাই ৭টি নৌকা নিমজ্জিত হওয়ার পরে এই বিলের নাম বিল চান্দা নামকরণ হয়েছে।
চান্দা বিল এলাকায় কয়েক বছর আগেও যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা।  এই বিলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ। 
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ বিলে রয়েছে নানা প্রজাতির মাছ, পাখি-অতিথি পাখি, শাপলা ফুল, পিট কয়লা, কচুরিপানা, শ্যাওলা, কেঁচো, পদ্মফুল, কলমিশাক, হিঞ্চা শাক, পানি লজ্জাবতীগাছ, নল খাগড়া ইত্যাদি নাম না জানা প্রজাতির গাছ পালা জীবজন্তু। জীব বৈচিত্রের আধার ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর।

চান্দার বিলের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মাছ অন্যতম। এখানে প্রায় দেড়শ প্রজাতির মাছ এখনও বিদ্যমান।
বিল চান্দা থেকে প্রতিদিন ঢাকায় মাছ  সরবরাহ করা হয়। এই মাছ ধরা, বিক্রি করা, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে কর্মসংস্থান করে জীবিকা নির্বাহী করে কয়েক হাজার পরিবার। প্রতিদিনই ধরা পড়ে কৈ, শিং, শোল, গজার, দেশী সরপুটি, রুই কাতলা, মাগুর, টাকি, পুটি, বাইন, টেংরা, মলা-ঢেলা অসংখ্য প্রাকৃতিক মাছ ছাড়াও সরকারি অনুদানে উন্মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্ত করা হাইব্রিড জাতের মাছ।

 চান্দা বিলে স্বতন্ত্র প্রাকৃতিক সম্পদ হলো পিট কয়লা। নিম্নাঞ্চলের এখনো প্রায় ১ হাজার পরিবারের একমাত্র আয় পিট কয়লা আহরণ করে বিক্রি করা। ক্রেতারা ওই শুকনো কয়লা দিয়ে বিশেষভাবে প্রস্তুত চুলায় রান্না করে। এই চুলায় পরিবেশ দূষণ অর্থাৎ ধোঁয়া হয় না বলে অনেক রাঁধুনি পিট কয়লা ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।

এলাকার লোকেদের কাছে বর্ষাকালীন সবজি হিসেবে শাপলা বহুল ব্যবহৃত। বিল চান্দার আশপাশের গ্রামবাসীরা বর্ষা মৌসুমে শাপলা সবজি হিসেবে খায়। গোপালগঞ্জ, খুলনা, ঢাকা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ হাট বাজারে শাপলা সবজি হিসেবে বিক্রি হয়।
 আশ্বিন-কার্তিক বা অক্টোবর নভেম্বর মাসে শাপলা গোড়ার পানি কমে গেলে অপেক্ষাকৃত কম বয়েসি শাপলা গাছের গোড়ায় যে গোটা অংশ থাকে তাকে শালুক বলে। শালুক একটি সুস্বাদু খাবার। 

 বর্ষা মৌসুমে চান্দার বিলের শামুক এখন অর্থকরী পণ্য, চান্দার বিল এলাকায় বড়-বড় সাইজের শামুক খুলনা এলাকায় চিংড়ি ঘেরে বিক্রি হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে চান্দার বিলের পার্শ্ববর্তী সড়কের পাশে প্রতিদিন বসে শামুক বিক্রির হাট। জলিরপাড়, কলিগ্রাম, রাঘদী, উজানী, রাহুথড়, বেদগ্রাম, মোচনা এলাকা থেকে প্রতিদিন ৮/১০ ট্রাক ছাড়াও বিল রুট ক্যানেলে নৌকা ভিড়িয়ে কয়েকটি ট্রলারযোগে খুলনা বাগেরহাটসহ বিভিন্ন চিংড়ি চাষ এলাকায় শামুক চলে যায়। এই শামুক খাওয়ার জন্য প্রচুর অতিথি পাখিও আসে।

চান্দা বিলের উন্মুক্ত জলাশয়, পুকুরসহ নিম্নাঞ্চলের অপার প্রাকৃতিক সম্পদ শ্যাওলা। শ্যাওলা আগে কোন কাজে না লাগলেও বর্তমানে শ্যাওলা মূল্যবান পণ্যে রূপান্তর হয়েছে। মাছের উৎকৃষ্ট খাদ্য শ্যাওলা।

 পানি ফল ও পদ্মফুল জলজ উদ্ভিদ থেকে উৎপাদিত ফসল। পদ্মফুলের থেকে মৌমাছির সংগৃহীত মধু পদ্মমধুর উপকারিতা অনেক। ওই পদ্মফুল বিভিন্ন পূজা অর্চনাতেও ব্যবহৃত হয়। এটারও অনেক ঔষুধিগুন রয়েছে। 

বিলের পানিতে হিচনা শাক ও কলমি শাক খুবই জনপ্রিয়। পুষ্টিকর ও ঔষধি গুন সম্পন্ন শাক। বিলে প্রচুর পরিমাণ শাক উৎপন্ন হয়।

 চান্দা বিলের এলাকার অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিগুলোতে বোনা হয় অনেক পানিতে টেকসই বিভিন্ন প্রজাতির ধান। এরমধ্যে দিঘা ও শাইল জাতের ধানই বেশি। দিঘার আরো কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে। দিঘার ধানের ঢেঁকি ছাঁটা চাল এখন অমূল্য সম্পদ। এটা গ্রামেও অপেক্ষাকৃত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বেশী পানিতে জন্মানো শালিধানের বিভিন্ন প্রজাতির ধানে ভাত ছাড়াও সুস্বাদু মুড়ির ধান জন্মে এই বিলে।

 প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে পাল্টে যেতে পারে ওই এলাকাসহ সারাদেশের জীবনযাত্রা। 
মুকসুদপুর তথা বাংলাদেশের ঐতিহ্য,  সৌন্দর্যের লীলাভূমি চান্দার বিলকে বাঁচাতে হবে। আর এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের জীবন-জীবিকার আঁধার এ বিল হোক জীব-বৈচিত্রের অভায়ারণ্য। টিকে থাকুক যুগের পর যুগ। 

সাব্বির

×