ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

শহীদদের স্মৃতি, রাষ্ট্রের মর্যাদা: কসবা-আখাউড়া ও গণআন্দোলনের অসমাপ্ত ইতিহাস

কবীর আহমেদ ভূইয়া

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ১৬ জুন ২০২৫; আপডেট: ২৩:২৫, ১৬ জুন ২০২৫

শহীদদের স্মৃতি, রাষ্ট্রের মর্যাদা: কসবা-আখাউড়া ও গণআন্দোলনের অসমাপ্ত ইতিহাস

“একটি জাতি তখনই সম্মানিত হয়, যখন সে তার শহীদদের সম্মান দিতে জানে”—এই কথাটি শুধু কোনো নীতিকথা নয়, এটি একটি রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক ভিত্তির নির্দেশক। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে শহীদদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের অনেক শহীদের আত্মবলিদান যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি—তাদের স্মৃতি আজও অনেকাংশে উপেক্ষিত। এই লেখার মাধ্যমে কসবা-আখাউড়া অঞ্চলের শহীদদের স্মরণে একটি জাতীয় ঐতিহাসিক দায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বৃহত্তর বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অসমাপ্ত সংগ্রামও।

১৯৭১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আখাউড়া ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। বিশেষ করে আখাউড়া ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের একটি কৌশলগত প্রবেশপথ। এখানকার দরুইন গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল। তাঁর সমাধি এখনো দরুইন গ্রামের মাটিতেই শায়িত। অথচ এই জায়গাটি জাতীয় পর্যায়ে আজও অবহেলিত। সেখানে এখনো নির্মিত হয়নি কোনো আধুনিক স্মৃতিসৌধ, নেই কোনো দর্শনার্থী কেন্দ্র বা তথ্যভিত্তিক উপস্থাপনা, যেখানে নতুন প্রজন্ম শিক্ষালাভ করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, মোস্তফা কামালের সমাধি এলাকায় উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাস্তবায়িত হয়নি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে আঞ্চলিক শহীদদের ভূমিকা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা শুধু মুক্তিযুদ্ধেই নয়, গণতন্ত্রের জন্য পরবর্তী লড়াইয়েও প্রমাণিত হয়েছে। ২০২৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে যখন বিএনপির নেতৃত্বে “তারেক রহমান ঘোষিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন” চলছিল, তখন ঢাকার রাজপথে ছাত্রদল, যুবদলসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের বহু তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। আজ পর্যন্ত তাঁদের কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই, পরিবারগুলোর জন্য নেই আর্থিক সহায়তা, নেই কোনো শিক্ষাবৃত্তি—এমনকি সরকারের তরফে কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকাও প্রকাশিত হয়নি। এই অবহেলা শুধু রাজনৈতিক পক্ষপাত নয়—এটি জাতির নৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রতিচ্ছবি।

অথচ আন্তর্জাতিকভাবে শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের যে ঐতিহ্য দেখা যায়, তা আমাদের জন্য উদাহরণ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন রয়েছে Arlington National Cemetery এবং Vietnam Veterans Memorial, জাপানে Hiroshima Peace Memorial Park, ভারতে Amar Jawan JyotiKargil Vijay Memorial, ফ্রান্সে Arc de Triomphe–এর নিচে “অজানা শহীদের সমাধি”, কিংবা জার্মানিতে Holocaust Memorial—এসব রাষ্ট্র শহীদদের স্মৃতি শুধু সংরক্ষণ করে না, বরং তা জাতীয় ঐক্য ও মূল্যবোধ গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করে।

এই প্রেক্ষাপটে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা রাষ্ট্রপুনর্গঠন রূপরেখা শহীদদের মর্যাদা রক্ষার জন্য একটি সুপরিকল্পিত ও দৃষ্টান্তমূলক কাঠামো উপস্থাপন করেছে। এই রূপরেখার ৯ ও ১৬ নম্বর দফায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ১৭ নম্বর দফায় আঞ্চলিক ইতিহাসকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা আছে—যা কসবা-আখাউড়ার মতো অঞ্চলগুলোর অবহেলিত ইতিহাসকে মূলধারায় আনার জন্য জরুরি। ২২ ও ২৬ নম্বর দফায় শহীদ পরিবারের জন্য কল্যাণ স্কিম, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার প্রস্তাব রয়েছে। বিশেষভাবে ৩১ নম্বর দফায় বলা হয়েছে ডিজিটাল আর্কাইভ, ভার্চুয়াল মেমোরিয়াল এবং ইন্টার‌অ্যাকটিভ ইতিহাস সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে—যা ২১ শতকের প্রজন্মকে যুক্ত করবে জাতির শিকড়ের সঙ্গে।

এই সমস্ত দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কসবা-আখাউড়া অঞ্চলের শহীদদের স্মৃতি যেমন সংরক্ষিত হবে, তেমনি রাজপথে প্রাণদানকারী গণতন্ত্রকামী তরুণদের আত্মত্যাগও মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি পাবে। এই প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থ, প্রযুক্তি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সমূহের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, মোস্তফা কামালের সমাধিস্থলে একটি আধুনিক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, দরুইন ও কসবা যুদ্ধক্ষেত্রে ইন্টার‌অ্যাকটিভ মিউজিয়াম, স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য ঐতিহাসিক সফর কর্মসূচি, শহীদদের জীবনকেন্দ্রিক তথ্যচিত্র তৈরি এবং ডিজিটাল ‘Martyrs’ Wall’ চালু করলে স্মৃতি ও শিক্ষা একত্রে সংরক্ষিত হবে।

শহীদ রাষ্ট্রের গৌরব। তারা অতীতের গৌরবগাথা নয়, বরং ভবিষ্যতের দিকদর্শক। কসবা ও আখাউড়ার শহীদদের কথা আমরা ভুলে গেলে একদিন আমরাও বিস্মৃত হবো ইতিহাসের পাতায়। আমাদের প্রজন্ম যদি জানতে না পারে মোস্তফা কামালের জীবনগাথা, কিংবা ২০২৩ সালের শহীদ তরুণদের আত্মত্যাগের কথা—তাহলে ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের সংযোগ চিরতরে ছিন্ন হবে।

শহীদ জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, “আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, কোনো দল বা গোষ্ঠীর জন্য নয়।” এই দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল তাঁর রাষ্ট্রনীতি। তাঁর শাসনামলে বীরশ্রেষ্ঠদের স্বীকৃতি, গেজেট প্রকাশ এবং মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সূচনা হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার আমলে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, জাতীয় শহীদ মিনারের উন্নয়ন, এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বৃত্তি, বাসস্থান ও চিকিৎসা সহায়তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল। এই ধারাবাহিকতা থেকে আজকের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাষ্ট্র ও জনগণ শিক্ষা নিতে পারে।

শেষ কথা—শহীদদের স্মৃতি কেবল ফুল দেওয়ার অনুষ্ঠান নয়। এটি একটি জীবন্ত চেতনা, একটি নৈতিক ভিত্তি এবং একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। শহীদদের স্মৃতি যদি আমরা গৌরবে রূপ দিতে না পারি, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

সজিব

×