
ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।
প্রবাসে শ্রম দিয়ে অর্জিত অভিজ্ঞতা আর দূরদর্শী চিন্তার সুফল কীভাবে বদলে দিতে পারে দেশের কৃষির দৃশ্যপট—তার জীবন্ত প্রমাণ সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নের নরহরকাটি গ্রামের কৃষক শোকর আলী। জীবিকা ও উচ্চ আয়ের আশায় ২০১৮ সালে বাহরাইনে পাড়ি জমালে সেখানে খেজুর বাগানে কাজের সুযোগ-অভিজ্ঞতা এবং চাষের বাস্তব চিত্র দেখে তার মনে জন্ম নেয় নতুন স্বপ্ন—দেশে ফিরে খেজুর চাষ শুরু করবেন নিজে। আজ, সে স্বপ্নই বাস্তব রূপ পেয়েছে।
বাহরাইনে খেজুর বাগান পরিচর্যা ও উৎপাদন খামারে দুই বছর কাজ করেন শোকর আলী। সেখানে কাজ করতে গিয়েই তিনি লক্ষ্য করেন, খেজুর চাষ লাভজনক, কম পরিচর্যায় দীর্ঘমেয়াদি ফলন নিশ্চিত করে এবং জলবায়ু উপযোগী হলে এটি একটি টেকসই কৃষি পণ্য হয়ে উঠতে পারে। ভিসার মেয়াদ শেষে ২০২১ সালে দেশে ফিরে আসার সময় তিনি বাহরাইন থেকে নিয়ে আসেন প্রায় ৫০টি উন্নত জাতের খেজুর বীজ।
সেই বীজ থেকে নিজ বাড়ির আঙিনায় চারা উৎপাদন শুরু করেন। প্রবাসের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সফলভাবে খেজুরের চারা তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি। পরবর্তীতে তার দুই ছেলেকে একজনকে বাহরাইন ও অন্যজনকে সৌদি আরবে প্রেরণ করে তাদের মাধ্যমে সেখান থেকে সংগ্রহ করেন আরও বেশ কয়েকটি উচ্চফলনশীল, মিষ্টি ও বাজারে চাহিদাসম্পন্ন। জাতের খেজুরের বীজ। এবং সেগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে চারা উৎপাদন করতে থাকেন তিনি।
বর্তমানে শোকর আলীর খেজুর নার্সারিতে রয়েছে প্রায় ১০/১২ হাজার চারা। তার মধ্যে বেশ কিছু গাছে ফল আসা শুরু করেছে। কয়েকটি গাছে ঝুলতে দেখা গেছে খেজুরের ‘কাধি’ বা ফলগুচ্ছ। এই ফলন প্রমাণ করছে—দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ু খেজুর চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী।
সাতক্ষীরা হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক কৃষিবিদ আমজাদ হোসেন বলেন, “উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও পানির বৈশিষ্ট্য স্থানভেদে ভিন্ন। তবে খেজুর একটি তুলনামূলকভাবে খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসল। তাই পরীক্ষামূলকভাবে ছোট পরিসরে বিভিন্ন এলাকায় খেজুর চাষ করে উপযোগিতা যাচাই করা যেতে পারে। যদি এসব পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়, তবে পরিকল্পিতভাবে বড় পরিসরে খেজুর চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশে প্রতিবছর কয়েক হাজার মেট্রিক টন খেজুর আমদানি করতে হয়, যার বেশিরভাগ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। বিশেষ করে রমজান মাসে খেজুরের চাহিদা বহুগুণে বেড়ে যায়। এই নির্ভরতা কমাতে দেশেই উন্নত জাতের খেজুর উৎপাদন শুরু হলে, তা একদিকে আমদানি নির্ভরতা কমাবে, অন্যদিকে স্থানীয় কৃষক লাভবান হবেন।
একই উপজেলার শমশের গাজীর পুত্র শফিউল্লাহ কালিকাপুর গ্রামে তার লবণাক্ত জমির চিংড়ি ঘেরের বেড়িবাঁধে সৌদি আরব থেকে বীজ সংগ্রহ করে চারা তৈরির মাধ্যমে ৪ বছর আগে বেশ কয়েকটি খেজুর গাছ লাগায় তার অধিকাংশ গাছ পুরুষ হলেও দুইটি মেয়ে গাছ থেকে ভালো ফলন পাচ্ছেন বলে জানিয়ে আরও খেজুর গাছ লাগাবেন বলে জানান তিনি ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল (বিশেষত সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলা) লবণাক্ততা সহনশীল গাছের জন্য উপযোগী। খেজুর একটি খরাপ্রবণ ও উষ্ণ জলবায়ু সহনশীল ফসল। গবেষণা ও প্রযুক্তি সহায়তা পেলে এ অঞ্চলে খেজুর চাষ একটি সম্ভাবনাময় কৃষি খাতে পরিণত হতে পারে।
নরহরকাটির শোকর আলীর সবুজ স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তার উদ্যোগ যদি যথাযথ পরিকল্পনা ও সরকারি সহায়তায় সম্প্রসারিত হয়, তবে শুধু কালিগঞ্জ নয়, সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চল হতে পারে খেজুর চাষের সম্ভাবনাময় অঞ্চল। বদলে যেতে পারে দেশের কৃষি ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ।
মিরাজ খান