
জীবন কতটা অদ্ভুত মোড় নিতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ যেন জামালপুরের সরিষাবাড়ীর পিংনা ইউনিয়নের এক তরুণের জীবনে দেখা গেল।
জন্মসূত্রে নারী হলেও, হঠাৎ করেই তিন মাসে দেহ ও স্বরস্বরূপ বদলে পুরুষে রূপান্তরিত হয়েছেন শাহানাজ আক্তার (১৯)। এখন তিনি পরিচিত মো. তুহিন মিয়া নামে। ব্যতিক্রমী এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে চরম কৌতূহল ও আলোড়ন।
পরিবারের লোকজন, প্রতিবেশী এমনকি চিকিৎসকদের কাছেও ঘটনাটি এক বিস্ময়। যাকে সবাই চিনতেন একজন মেধাবী ছাত্রী হিসেবে, সে এখন এলাকায় পরিচিত হচ্ছেন এক তরুণ পুরুষ হিসেবে।
ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর থেকে তুহিন মিয়াকে এক নজর দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছেন এলাকার শত শত মানুষ। কেউ অবাক, কেউবা বিস্মিত, কেউ আবার বলছেন—‘আল্লাহ যা চান, তাই হয়।’
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, উপজেলার মেইয়া গ্রামের আব্দুল বাছেদের মেয়ে শাহানাজ ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের ছিলেন। স্থানীয় পিংনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করেন। এরপর পরিবারের স্বচ্ছলতা ও নিজের ভবিষ্যতের জন্য পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার একটি ব্যাগ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘ব্যাঙ্গল কোম্পানি’-তে চাকরি গ্রহণ করেন তিনি।
চাকরিতে যোগদানের তিন মাস পর একদিন হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হন শাহানাজ। সাধারণ এক ওষুধ সেবনে জ্বর কমলেও, শুরু হয় দেহগত পরিবর্তন। ধীরে ধীরে তার কণ্ঠস্বর ভারী হতে থাকে, শরীরের নারীত্বের বৈশিষ্ট্য বিলীন হয়ে যায়, এবং পুরুষসুলভ লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে।
শাহানাজ যখন তার এই পরিবর্তনের খবর পরিবারের সদস্যদের জানান, প্রথমদিকে তা বিশ্বাসই করতে পারেননি কেউ। কিন্তু পরিবর্তনের ধারা দেখে এবং নিজ চোখে দেখে পরিবারের সদস্যরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান। অবশেষে ৯ জুন, সোমবার সকালে তুহিন নতুন পরিচয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। পরিবারের পক্ষ থেকে তখন তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “মো. তুহিন মিয়া”।
তুহিন মিয়া বলেন, “ঢাকায় গিয়ে অসুস্থ হওয়ার পর শরীরে পরিবর্তন অনুভব করি। পরে সাভারে ‘দি গ্রীন’ নামে একটি হাসপাতালে ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করি। তারা জানান, শরীরে অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন (পুরুষ হরমোন) থাকার কারণে এমন পরিবর্তন হতে পারে। এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ, আমার শরীর স্বাভাবিকভাবে পুরুষের মতো আচরণ করছে। এটা মহান আল্লাহর ইচ্ছা, আমি কৃতজ্ঞ।”
শুধু তুহিনই নন, এই অদ্ভুত পরিবর্তনে পুরো পরিবারে দেখা দিয়েছে একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া—অবিশ্বাস থেকে শুরু করে একরকম আনন্দ। তুহিনের বাবা আব্দুল বাছেদ বলেন, “আমার দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে ছিল। এখন মেজো মেয়ে তুহিন ছেলেতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে এখন আমার দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে হলো। আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। আমি সন্তুষ্ট।”
বড় মেয়ের জামাই মিজানুর রহমান বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে শাহানাজের বিয়ের পরিকল্পনা করছিলাম। এমন সময় এই পরিবর্তন হবে, তা কল্পনাও করিনি। এখন আমরা এটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া এক ইশারা মনে করছি।"
তবে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন পরিবর্তন একেবারে স্বাভাবিক নয়। সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেবাশীষ রাজবংশী বলেন, “এই ধরনের পরিবর্তন চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত বিরল এবং ব্যতিক্রম। কারও শরীরে হরমোনজনিত পরিবর্তন দেখা দিতে পারে, তবে সেটি পুরো লিঙ্গ রূপান্তরের কারণ হতে পারে কিনা, তা পরীক্ষার মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।” তিনি আরও বলেন, “জন্মগতভাবে প্রত্যেক মানুষের লিঙ্গ নির্ধারিত হয় জিন, ক্রোমোজোম এবং হরমোনের ওপর ভিত্তি করে। এর কোনো পরিবর্তন হলে তা গভীরভাবে চিকিৎসা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।”
রাজু