
.
গত কয়েক বছরে পোল্ট্রি মুরগি উৎপাদনে বেড়েছে অনেক ঝুঁকি। এরমধ্যে ফিড, বাচ্চা, ওষুধের যেমন দাম বেড়েছে তার সঙ্গে বাজারজাতকরণে বেড়েছে ঝামেলা ও ঝুঁকি। নতুন করে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে তাপমাত্রা। কেননা গেল কয়েক বছরে তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে গেল বছর দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রার কারণে উৎপাদন কমছে সেইসঙ্গে হিটস্টোকে মুরগি মারাও যাচ্ছে।
পোল্ট্রি মুরগি উৎপাদনে একটি বিশেষ দিক হলো তাপমাত্রা। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয় এই মুরগিকে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মুরগি হিটস্ট্রোক হয়ে মারা যায়, এ ছাড়াও মুরগি খাবার কম খায় এবং ওজন কমে যায়।
কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার হরিশ্বর কালোয়া গ্রামের পোল্ট্রি খামারি মেহেদী হাসান মিলন। প্রায় ১৫ বছর ধরে পোল্ট্রি মুরগি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। মেহেদী হাসান মিলন বলেন, ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তাপমাত্রার কম থাকতে হয়। তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর উপরে উঠলে ঝুঁকিতে পরতে হয়।এই মুরগি পালনে তাপমাত্রার কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে হয়। বাচ্চার বয়স ১-৭ দিনের মধ্যে তাপমাত্রা ৩২-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে হয়। এরপর তাপমাত্রা কমিয়ে ১৫-২১ দিন বয়সে ২৮-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখতে হয়। ২২-২৮ দিন বয়সে তাপমাত্রা ২৫-২৮ ডিগ্রি রাখতে হয়।
প্রথম দিক তাপমাত্রায় খুব একটা বড় প্রভাব পড়ে না। কেননা এ সময়ে তাপমাত্রায় একটু বেশি প্রয়োজন হয়। তবে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হয় মুরগির যখন ১৮ দিন হয়ে যায়। রাতে তাপমাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও দিনে সেটা অস্বাভাবিক হয়ে যায়। বিশেষ করে দুপুর হলে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হয়ে যায়। তখন হিটস্ট্রোক বেড়ে যায়। বর্তমানে বছরে নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং মার্চ এই তিন মাস শুধুমাত্র মুরগি উৎপাদনে তাপমাত্রা স্বাভাবিক পাওয়া যায়। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই ২ মাস প্রচ- ঠান্ডার কারণেও উৎপাদন কঠিন হয়ে যায়। বাকি ৮ মাস অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে আর উৎপাদন করা যাচ্ছে না। মেহেদী হাসান মিলন আরও বলেন,’ গত বছরে আমাদের অনেক লোকসান হয়েছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা থেকে মুরগিকে রক্ষা করতে বিভিন্ন প্রকার পন্থা অবলম্বন করেছি। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। আমরা লেবুর পানি, স্যালাইনসহ বেশকিছু প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছিলাম। কিন্তু তাপমাত্রা এত বেশি ছিল যে, কোনো কিছুতেই কাজে আসেননি আমাদের চেষ্টা। ১১ জুন আমার খামারে ২৫টি মুরগি মারা গেছে। এসব কারণে দিনে দিনে জেলায় বয়লার মুরগি উৎপাদনকারী কমে গেছে। যে দুই একজন আছে তারা এখন কেউ নিজে উৎপাদন করে না। তারা সবাই কন্ট্রাক্ট ফার্ম করে। আমি নিজেও পুঁজি হারিয়ে কন্ট্রাক্ট ফার্ম করছি। কন্ট্রাক্ট ফার্মে রয়েছে অনেক জটিলতা। নির্দিষ্ট সময়ে ওজন আনতে না পারলে সেখানেও হয় লোকসান। গত কয়েক বছরে আমার লোকসানের পরিমাণ ২০ লাখ টাকা। শুধু মেহেদী হাসান মিলন নয়, জেলার বাকি খামারিদের একি অবস্থা। পাশের এলাকার সাইফুল ইসলাম তিনিও ৭ বছর ধরে এই ফার্ম করছেন। তিনি বলেন, ‘৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা থাকলে মুরগির উৎপাদন মোটামুটি ভালো হয়। কিন্তু বর্তমানে ৩৬-৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আমরা আমাদের মুরগিকে রক্ষা করতে পারছি না। আমরা অতিরিক্ত তাপমাত্রা থেকে মুরগিকে রক্ষা করতে লেবুর পানির, স্যালাইন ও স্প্রে করছি কিন্তু কোনোভাবেই রক্ষা করা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই আমাদের খামারে মুরগি মারা যাচ্ছে।
কুড়িগ্রাম রাজারহাট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, ‘বর্তমানে তাপমাত্রা ৩৫-৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করছে। আগামী ১৪ তারিখের পরে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ কুড়িগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ হলো একটি বেশি তাপমাত্রার দেশ। অনেক সময় তাপমাত্রা ৪০ এর উপরে চলে যায়। আমরা খামারিদের পরামর্শ দিচ্ছি, তারা যেন তাদের মুরগির সেটটি ছায়াযুক্ত জায়গায় তৈরি করে। সবসময় ফ্যানের ব্যবস্থা রাখে, ভালো ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রাখে এবং পানির স্প্রের ব্যবস্থা রাখে।
এ ব্যাপারে যদি তারা সচেতন হয় তাহলে আশা করি তাপপ্রবাহ থেকে তাদের মুরগিকে রক্ষা করতে পারবে। আমরা এ ব্যাপারে তাদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।
প্যানেল