
মানুষকে আকৃষ্ট করার, পাহাড়, হ্রদ ও ঝর্ণার এ শহর দেখতে প্রতি বছর লাখো পর্যটক আসেন। একদিকে সবুজ পাহাড় অন্যদিকে সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদ মিলেমিশে একাকার করেছে বৈচিত্র্যময় রাঙ্গামাটিকে। এ জেলায় রয়েছে বহু জাতির মানুষের বসবাস। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য দেখতে চাইলে আপনাকে রাঙ্গামাটি ভ্রমণ করতে হবে। রাঙ্গামাটিতে ঘুরতে চাইলে সবচে বড় সুবিধা হচ্ছে সারাদিনের জন্য একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করলে অনায়াসেই সব পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরতে যাওয়া যায়।
নীল জলরাশিতে ভরপুর কাপ্তাই হ্রদ ও সবুজে ঘেরা পাহাড় ঘিরে অপরূপ সাজে গড়ে উঠা একটি জনপদের নাম রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। এ যেন স্রষ্টার এক অপরূপ সৃষ্টি। সুউচ্চ আকাশ ছোঁয়া পাহাড় ও বিশাল জলরাশি এই রূপ বৈচিত্র্য যেন কোনো এক শিল্পীর রং তুলিতে আঁকা ক্যানভাস। এ রূপ বৈচিত্র্য দেখতে দূর দুরন্ত থেকে ছুটে আসেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।
বর্ষায় রাঙ্গামাটি সাজে অন্য এক অপরূপ সাজে। যা পর্যটককে আরও কাছে টানে। মনোমুগ্ধ করে তোলে প্রকৃতিপ্রেমীদের। এসময় হ্রদ পানিতে পরিপূর্ণ থাকে, পাহাড় ঘিরে থাকে সবুজ অরণ্যে। পাহাড়ের ভাজে ভাজে সৃষ্ট ঝরনা পায় পূর্ণ যৌবন। এমন দৃশ্য উপভোগ কতে রাঙ্গামাটি ভ্রমণের উত্তম সময় হচ্ছে বর্ষাকাল।
রাঙ্গামাটি ভ্রমণের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে পাহাড়ি ঝরনা। রাঙ্গামাটি জেলায় বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্যা ঝরনা। যে ঝরনার পানি আপনার ক্লান্তিকে দূর করে প্রশান্তি এনে দেবে নিমিষেই। জেনে নিন বর্ষায় রাঙ্গামাটিতে কোথায় কী দেখবেন-
ধুপপানি ঝরনা
রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের ওড়াছড়ি নামক স্থানে এই ঝরনা অবস্থিত। স্থানীয়রা ধুপপানি ঝর্ণা নামেও ডেকে থাকে। স্থানীয় শব্দে ধুপ অর্থ হচ্ছে সাদা আর পানি যুক্ত করে এটিকে সাদা পানির ঝর্ণাও বলা হয়। ঝর্ণার পানি স্বচ্ছ এবং যখন অনেক উচু থেকে সেই পানি আছড়ে পড়ে তখন তা শুধু সাদাই দেখা যায়। তাই একে ধুপ পানির ঝর্ণা বলা হয়। সমতল থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১৫০ ফুট। ঝরনা থেকে পানি আছড়ে পড়ার শব্দ প্রায় ২ কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়।
ধুপপানি ঝর্ণাটি লোক চক্ষুর অন্তরালে ছিল অনেক বছর। ২০০০ সালের দিকে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গভীর অরণ্যে ধুপপানি ঝর্ণার নিচে ধ্যান শুরু করেন। পরে স্থানীয় লোকজন জেনে ঐ বৌদ্ধ ধ্যান সন্ন্যাসীকে দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় বা উপলক্ষে সেবা করতে গেলে এই ঝর্ণাটি জনসম্মুখে পরিচিতি লাভ করে।
যেভাবে যাবেন-
ধুপপানি যেতে হলে ঢাকা থেকে প্রথমে যেতে হবে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায়। আর এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বাস এই রুটে চলাফেরা করে। কাপ্তাই এর লঞ্চঘাটে পৌঁছে ট্রলারে করে বিলাইছড়ি যাবেন। সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। রিজার্ভ কিংবা লোকাল ট্রলার দুভাবেই যেতে পারেন। রিজার্ভ করলে ভারা পড়বে ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা। আবার মাত্র ৫৫ টাকা দিয়ে লোকাল ট্রলারে করেও যেতে পারবেন সেখানে। তবে লোকাল ট্রলার নির্দিষ্ট সময় মেনেই চলাফেরা করে।
সকাল ৮.৩০, দুপুর ১ টা ও ১.৩০ মিনিটে কাপ্তাই ঘাট থেকে ট্রলার ছেড়ে যায়। বিলাইছড়ি নেমে বিলাইছড়ি বাজারে খাওয়া দাওয়া করে নিতে পারেন বা জরুরি কাজ থাকলে সেরে নিন। বিলাইছড়ি থেকে আবার একটি ইঞ্জিন চালিত বোর্ট ভাড়া করে যেতে হবে উলুছড়ি। উলুছড়ি থেকে বাধ্যতামূলকভাবে আপনাকে একজন গাইড নিয়ে যেতে হবে। ২ ঘণ্টায় উলুছড়ি পৌঁছে এখান থেকে ছোট আরেকটি নৌকা দিয়ে কিছুদূর গিয়ে ট্রেকিং শুরু করতে হবে। এখান থেকে ধুপপানি পাড়া আরও আড়াই ঘণ্টার। সেখান থেকে আরও ৩০ মিনিটের ট্রেকিং করে তবেই ধুপপানি ঝরনার রূপ মাধুর্য অবলোকন করতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন-
বিলাইছড়িতে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি হোটেল আছে। উপজেলা প্রশাসনের পরিচালিত একটি কটের্সসহ নিরিবিলি বোর্ডিং, নিজাম’র কর্টেস এরকম বেশ কিছু হোটেলের সন্ধান পাবেন বিলাইছড়ি উপজেলা ঘাটে।
খাওয়া দাওয়া-
বিলাইছড়ি বাজারে খাওয়া দাওয়া করতে পারবেন। এখানে বেশ কিছু হোটেল আছে মোটামুটি মানের।
মুপ্পোছড়া ঝরনা
রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার বাঙ্গালকাটা নামক জায়গায় মুপ্পোছড়া ঝরনাটি অবস্থিত। প্রস্থের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝরনার একটি। বর্ষা আসলে এ ঝরনা প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠে। এডভেঞ্চার প্রিয় আর ট্রেকিং করতে যারা ভালোবাসেন তাদের কাছে আদর্শ জায়গা পাহাড় আর পাহাড়ের গহীনে অবস্থিত এইসব বুনো জলপ্রপাত। দূর্গম পাহাড়ি পথে ট্রেকিং, ঝিরি পথ পেরিয়ে জনহীন বুনো অরণ্য আর প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্য সব কিছুর দেখা পেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে মুপ্পোছড়া ঝরনায়।
যেভাবে যাবেন-
ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় আসতে হবে। কাপ্তাই এসে লঞ্চঘাট থেকে ট্রলার দিয়ে বিলাইছড়ি যেতে ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট সময় লাগে। ট্রলার রিজার্ভ নিলে ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা লাগবে। অবশ্যই দামাদামি করে নিতে হবে। লোকাল ট্রলারে করে যেতে চাইলে কাপ্তাইঘাট থেকে সকাল ৮ টা ৩০ মিনিট, দুপুর ১ টা এবং ১ টা ৩০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়া ট্রলারে জনপ্রতি ৫৫ টাকা ভাড়ায় যেতে পারবেন।
হালকা নাস্তা করে যাত্রা শুরু করুন। সঙ্গে কিছু শুকনো খাবার নিতে ভুলবেন না। বিলাইছড়ি পৌঁছে আবার হাসপাতাল ঘাট থেকে ট্রলার রিজার্ভ করে বাঙ্গালকাট পর্যন্ত যেতে হবে। ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের পথ যেতে ভাড়া ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মতো পড়বে। এখানে নেমে গাইড ঠিক করে নিন। ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে গাইড পেয়ে যাবেন। তারপর আড়াই ঘণ্টার ট্র্যাকিং শেষে মুপ্পোছড়া ঝরনার দেখা পাবেন।
যেখানে খাবেন-
বিলাইছড়ি বাজারে বেশকিছু খাবার হোটেল আছে। তবে বকুলের দোকান এবং ভাতঘর নামে দুইটি খাবারের হোটেলে কম দামে ভালো খাবার পাওয়া যায়।
যেখানে থাকবেন-
বিলাইছড়িতে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা আছে। যদি ট্রলার রিজার্ভ করে যান তাহলে হাসপাতাল ঘাটে ট্রলার চলে যান। ট্রলার থেকে নেমে নিরিবিলি বোর্ডিংয়ে উঠতে পারেন। এই বোর্ডিংয়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় সিঙ্গেল এবং ডাবল বেডের রুম পাবেন।
শুভলং ঝরনা
রাঙ্গামাটি জেলার বহুল পরিচিত অন্যতম একটি ঝরনা হচ্ছে শুভলং ঝরনা। যা জেলার বরকল উপজেলায় অবস্থিত। রাঙ্গামাটি সদর থেকে শুভলং ঝরনা দুরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুমে শুভলং ঝরনা জলধারা প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে নিচে আছড়ে পড়ে।
যেভাবে যাবেন-
ঢাকার ফকিরাপুল মোড় ও সায়দাবাদে রাঙ্গামাটিগামী অসংখ্য বাস কাউন্টার আছে। বাসগুলো সাধারণত সকাল ৮ টা থেকে ৯টা এবং রাত ৮ টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ১১ টার মধ্যে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ে। বাসে করে রাঙ্গামাটি সদরে আসার পর এখান থেকে যেতে হবে শুভলং ঝরনায়। শহর থেকে শুভলং ঝরনায় যেতে হলে নৌ পথে যেতে হয়। ইঞ্জিন চালিত ট্রলার রিজার্ভ করাই সবচেয়ে ভালো উপায়। রাঙ্গামাটি রিজার্ভ বাজার এলাকা থেকে অথবা পর্যটন এলাকা থেকে ট্রলার রিজার্ভ করা যায়। এগুলোর ভাড়া আকার অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। মূল শহর থেকে শুভলং যেতে সময় লাগবে দেড় ঘণ্টার মতো।
যেখানে থাকবেন-
রাঙ্গামাটি শহরে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। রাঙ্গামাটি শহরের পুরোনো বাস স্ট্যান্ড ও রিজার্ভ বাজার এলাকায় হ্রদের কাছাকাছি হোটেলে উঠলে হোটেল থেকে কাপ্তাই হ্রদের পরিবেশ ও শান্ত বাতাস উপভোগ করা যাবে। রাঙ্গামাটির মান সম্মত হোটেলের মধ্যে রয়েছে হোটেল সোনার বাংলা, হিল এম্বাসেটর, হোটেল গ্রিন ক্যাসেল, পর্যটন মোটেল, হোটেল সুফিয়া, হোটেল আল-মোবা, হোটেল মতিমহল ইত্যাদি।
যেখানে খাবেন-
রাঙ্গামাটিতে বিভিন্ন মানের খাবার রেস্তোরাঁ আছে। রেস্তোরাঁয় স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী বাঙালি, পাহাড়ি সব খাবার পাওয়া যায়। ভিন্ন স্বাদের এইসব খাবারের স্বাদ নিতে পর্যটকরা আগ্রহী থাকেন।
ঘাগড়া ঝর্ণা
রাঙ্গামাটির অপূর্ব ঝর্ণাগুলোর সৌন্দর্য যারা উপভোগ করতে চান তারা চলে আসতে পারেন ঘাগড়া ঝরনা। শহর থেকে খুব কাছেই এই ঝরনাটি। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়কের ঘাগড়া অঞ্চলের কলাবাগানে এই ঝরনা অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে এটি 'কলাবাগান ঝরনা' হিসেবেই পরিচিত।
রাঙ্গামাটি সড়কের ঘাগড়া সেনাবাহিনী ক্যাম্প থেকে ৩-৪ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে কলাবাগান এলাকা। মূল সড়ক থেকে হাতের বামে প্রবাহিত একটি ছোট পাহাড়ি ছড়া পেরিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পেয়ে যাবেন এই ঝরনার এলাকা। এ ঝর্ণার রাজ্যে আছে ছোট বড় মিলিয়ে আট-দশটি ঝরনা। পুরো বর্ষাকাল জুড়েই প্রবাহিত হয় এই ঝরনাগুলো। ছড়া ধরে হাঁটতে থাকলে ১৫ থেকে ২০ মিনিট হাঁটা শেষ হলেই অপরূপ প্রথম বড় ঝরনাটি স্বাগত জানাবে আপনাকে। এরপর হালকা পিচ্ছিল কিন্তু মসৃণ পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠতে হয়। এরপর থেকে একের পর এক ঝর্ণা চোখে পড়বে। এভাবে সর্বশেষে চোখে পড়বে সবচেয়ে বড় ঝরনাটি।
যেভাবে যাবেন-
রাঙ্গামাটি শহরে এসে এখান থেকে সিএনজি ভাড়া করে যেতে পারবেন এই ঝরনায়। ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। চাইলে চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে আসলে নেমে যেতে পারেন রাঙ্গামাটি কাউখালি উপজেলার ঘাগড়া এলাকায়। এখান থেকে সরাসরি ঝরনায় যেতে পারবেন।
গাছকাটা ঝর্ণা
রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার গাছকাটাতে অবস্থিত এই গাছকাটা ঝরনা। যা ধন্দতাং ঝরনা নামেও পরিচিত। সৌন্দর্যের দিকে এটা এক কথায় অসাধারণ। এই ঝরনার ট্রেইলটা সবচেয়ে বেশি সুন্দর।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় আসতে হবে। কাপ্তাই এসে লঞ্চঘাট থেকে ট্রলার দিয়ে বিলাইছড়ি যেতে ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট সময় লাগে। ট্রলার রিজার্ভ নিলে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা লাগবে। অবশ্যই দামাদামি করে নিন।
লোকাল ট্রলারে করে যেতে চাইলে কাপ্তাইঘাট থেকে সকাল ৮ টা ৩০ মিনিট, দুপুর ১ টা এবং ১ টা ৩০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়া ট্রলারে জনপ্রতি ৫৫ টাকা ভাড়ায় যেতে পারবেন। বিলাইছড়ি পৌঁছে আবার হাসপাতাল ঘাট থেকে ট্রলার রিজার্ভ করে গাছকাটা ঝরনা পাড়া পর্যন্ত যেতে হবে। যেতে ভাড়া ৫০০-১০০০ টাকার মতো পড়বে। এখানে নেমে গাইড ঠিক করে নিবেন। ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে গাইড পেয়ে যাবেন। তারপর দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার ট্রেকিং করে যেতে হবে গাছকাটা ঝর্ণায়।
মুমু