ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

রাজশাহী-৬

শাহরিয়ার আলম শক্তিশালী অবস্থানে নতুন মুখ চায় বিএনপি

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী

প্রকাশিত: ০০:০৬, ২৩ আগস্ট ২০২৩

শাহরিয়ার আলম শক্তিশালী অবস্থানে নতুন মুখ চায় বিএনপি

বাঘা ও চারঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন রাজশাহী-৬

আগামীকাল থেকে ফেনী জেলা
রাজশাহী নগরীর দক্ষিণ-পূর্বকোণে অবস্থিত ঐতিহ্যনির্ভর ও চরাঞ্চল বেষ্টিত পদ্মা পাড়ের বাঘা ও চারঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন রাজশাহী-৬। স্বাধীনতার পর এ আসনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এখান থেকে নির্বাচিতরা বিভিন্ন সরকারের আমলে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন একাধিকবার। 
১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুইটি উপনির্বাচনসহ সাতটি সংসদীয় নির্বাচনে চারবার আওয়ামী লীগ, তিনবার বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এবং একবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচিত হন এই আসন থেকে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এ আসন কব্জায় রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের।

এ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. শাহরিয়ার আলম পর পর দুই মেয়াদ সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। এবারও এই আসনে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থীও হচ্ছেন শাহরিয়ার আলম এমপি। টানা তিন মেয়াদ ধরে এমপি ও পাশাপাশি মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালনের কারণে নিজ এলাকায় অভূতপূর্ণ উন্নয়ন সাধন করেছেন। ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা-ে তার নির্বাচনী আসনের দুই উপজেলার চেহারা বদলে দিয়েছেন তিনি। এ কারণে সাধারণ মানুষের আস্থায় রয়েছেন প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি এলাকার অন্যতম হেভিওয়েট প্রার্থী। তবে রাজনৈতিক কারণে এই আসন থেকে এবার মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন তিন নেতা। তারাও মাঠে প্রচার করছেন নিজেদের মতো করে। যদিও এ আসনে শাহরিয়ার আলমের মনোনয়ন এক প্রকার নিশ্চিত। 
এ আসন থেকে বিএনপিরও একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। এখানে বিএনপির একটি শক্তিশালী ঘাঁটিও রয়েছে চারঘাট কেন্দ্রিক। বিএনপির বিতর্কিত নেতা হিসেবে পরিচিত আবু সাঈদ চাঁদ এ আসনের এমপি প্রার্থী  হবেন এমন ভাবনা বিএনপির নেতাদের। তারপরেও নানা মামলা ও বিতর্কিত কর্মকা-ের জন্য বর্তমানে কারাগারে থাকা চাঁদের বিকল্প হিসেবে মাঠে রয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রার্থী। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ’৯১ সালে প্রয়াত আজিজুর রহমান এবং ২০০১ সালে সাবেক মন্ত্রী কবীর হোসেন বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে এমপি হয়েছিলেন। আর ১৯৯৬ সালে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ডাক্তার আলাউদ্দিন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার আনিসুর রহমান। তবে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিএনপির মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগে ফিরে যান ডাক্তার আলাউদ্দিন। তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হলে ১৯৯৭ সালের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি ফের এমপি হন এবং প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

তবে তিনি মারা যাওয়ার পর ১৯৯৯ সালের উপনির্বাচনে এখানে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা রায়হানুল হক রায়হান বিজয়ী হন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ঠান্ডু। ২০০১ সালের নির্বাচনে রায়হানুল হক রায়হান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও সেবার বিদ্রোহী প্রার্থী হন বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাস আলী। বিদ্রোহীর কারণে বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান রায়হান। তবে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন ছিনিয়ে নেন শিল্পপতি শাহরিয়ার আলম। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি তিনবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা হওয়ার পর শাহরিয়ার আলম নিজ দলের নেতাকর্মীদের তুমুল বিদ্রোহের মুখে পড়েন। এমনকি এলাকায় শাহরিয়ার আলমকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীরা। তবে মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বার এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে তৃতীয়বারের মতো এমপি হন শাহরিয়ার আলম। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা রায়হানুল হক রায়হান বিদ্রাহী প্রার্থী হন। এ নির্বাচনে অন্য দলের প্রার্থী না থাকায় বিদ্রোহীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে জয় পান এই শিল্পপতি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন।

শাহরিয়ার আলম ছাড়াও আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলু ও সাবেক এমপি রায়হানুল হক রায়হান। এই তিনজনের মধ্যে দলের কেন্দ্রে শক্ত জায়গা করে নিয়েছেন শাহরিয়ার আলম। তবে তাকে নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ রয়েছে। মুখ না খুললেও তৃণমূলের নেতাদের একটি অংশ তার বিপক্ষে অবস্থান করছে। 
চারঘাট আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, ‘মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার করণে এলাকায়  প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেন না পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি।

এছাড়াও একটি নির্দিষ্ট বলয়ে আটকে আছেন তিনি। ফলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তার কাছে গিয়ে তাদের সুখ-দুঃখের কথা বলার সুযোগ পান না। এতে দলের একটি অংশের নেতাকর্মীদের মাঝে রয়েছে সাংসদকে কাছে না পাওয়ার ‘মনোকষ্ট’। যেখান থেকে বেড়েছে দলীয় বিভেদও। ফলে এবার তিনি মনোনয়ন পেলে নেতাকর্মীদের মান অভিমান ভাঙানোর একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে তাকে।’
আওয়ামী লীগের ওই নেতা আরও বলেন, চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় সরকারি দলের সব ক্ষমতা এখন গুটিকয়েক নেতার হাতে। তাদের বাইরে আর কারও কথা কেউ শুনে না, মানেনও না। এ আসনে এবার মনোনয়ন চান জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলু। তিনি বর্তমানে বাঘা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলু বলেন, ‘আমি রাতদিন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে সকল ইউনিটের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। তারাও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এর বাইরে এলাকার অসহায় মানুষের পাশে যতটুকু সম্ভব দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।’
তিনি আরও বলেন, এখন মানুষ অনেক সচেতন। তারা চান সৎ, যোগ্য এবং যারা সব সময় জনগণের পাশে থাকে এমন প্রার্থীরা এগিয়ে আসুক নির্বাচনে। সেই চাওয়া নিয়েই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এই অবস্থায় দল যদি আমার ওপর আস্থা রাখেন, তাহলে জনগণই আওয়ামী লীগকে আবারও বাঘা-চারঘাটের আসন উপহার দেবেন বলে বিশ্বাস করি।
সাবেক সংসদ সদস্য রায়হানুল আলম বলেন, ‘আমি সবসময় জনগণের সঙ্গে আছি। এবারও নির্বাচনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রেখেছি। দল চাইলে অবশ্যই আগামী নির্বাচনে অংশ নেব।’
১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে তিনবার বিএনপির মনোনীত প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী নির্বাচনে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি। এবার এ আসনে দলটির মনোনয়ন চান স্থানীয় পাঁচজন নেতা। তারা সবাই নতুন মুখ। এর আগে তাদের অনেকেই একাধিকবার দলের মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হয়েছেন। যাদের অনেকে ইতোমধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে থেকে দল সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। নিজের পক্ষে সমর্থন আদায়ে তৃণমূলের নেতাকর্মী ছাড়াও কেন্দ্রে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তারা। ফলে দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রয়েছে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব।
এ আসনে এবার মনোনয়ন চাইবেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাইদ চাঁদ, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দেবাশীষ রায় মধু, ’৮০ দশকের ছাত্রনেতা ও জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন, জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি নুরুজ্জামান খান মানিক ও জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল। 
এদের মধ্যে আবু সাইদ চাঁদ এক সময় জাসদ ও পরে জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। কখনো বিতর্কিত আবার কখনো জনপ্রিয় নেতা হিসেবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি ও চারঘাট বিএনপির সভাপতির পদে স্থান করে নেন আবু সাঈদ। তবে বিতর্কিত কর্মকা-ের জন্য তিনি দুইবার দল থেকে বরখাস্তও হয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কবরে পাঠানোর হুমকি দিয়ে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় একাধিক মামলা হয়। এসব মামলায় তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। 
এ ছাড়াও ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বাতিল হয়ে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন আবু সাঈদ চাঁদ। অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।
অপরদিকে, ’৮০’র দশকের ছাত্র নেতা হিসেবে পরিচিত দেবাশীষ রায় মধু রাজশাহী কলেজ, গোলাম মোস্তফা মামুন সিটি কলেজ ও নুরুজ্জামান খান মানিক রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। 
জেলা বিএনপির সংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, বাঘায় আমার বাড়ি, আমার জন্মস্থান। আমি বিএনপির রাজনীতি করে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। কখনো দলের কাছে কিছু চাইনি। সবসময়ে জনগণের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। এখনো কাজ করে যাচ্ছি। দল চাইলে আগামী নির্বাচনে বাঘা-চারঘাট থেকে এমপি নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। এর জন্য ওই এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও রয়েছে আমার নিবিড় যোগাযোগ।
জেলা বিএনপির সহসভাপতি নুরুজ্জামান খান মানিক বলেন, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক। ছাত্র অবস্থায় থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমি দেশের জন্য, সমাজের জন্য রাজনীতি করি। দলের নেতাকর্মীরাও আমাকে কাছে টেনে নেন খুব সহজেই। এ কারণে তাকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচনে ভাল করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন বিএনপির এই নেতা।
আবু সাইদ চাঁদের ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, তিনি মানুষের হয়ে রাজনীতি করেন। নিজের জন্য রাজনীতি করেন না। তাই মানুষ যদি চায় এবং দল যদি ইচ্ছে করে তাহলে আগামী নির্বাচনে তিনিই এখানকার প্রার্থী হবেন। এই আসনে নির্বাচিত হতে এবং বিএনপির আসন পুনরুদ্ধার করতে চাইলে আবু সাঈদ চাঁদের বিকল্প প্রার্থী নেই বলে মনে করছেন এ অংশের বিএনপির নেতারা।

×