
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলা রাজশাহী
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলা রাজশাহী। অবস্থানগত কারণে এটি বিশেষ শ্রেণিভুক্ত জেলা। আমের রাজ্য হিসেবে ছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জেলা হিসেবে দেশব্যাপী বিখ্যাত রাজশাহী। এ ছাড়া সব ধরনের শাক-সবজি উদ্বৃত্তের কারণে রাজশাহীকে সবজিভা-ারও বলা হয়। একইসঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ পান উৎপাদন হয় এই জেলায়। রাজশাহীকে শিক্ষানগরী ও রেশমের নগরীও বলা হয়। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনেই বইছে নির্বাচনী হাওয়া।
রাজশাহীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমিতে অবস্থিত গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন ৫২ (রাজশাহী-১)। এখান থেকে হেভিওয়েট প্রার্থীরা অংশ নেওয়ায় জেলার ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত এই আসনটি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে মনোনয়ন পেতে মাঠে রয়েছেন ডজন খানেক নেতা। যাদের অনেকেই ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার সাঁটিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন। ইতোমধ্যে মাঠেও সক্রিয় তারা।
তবে এবারই প্রথম এই আসনে প্রার্থী হতে চেয়ে আলোচনার ঝড় তুলেছেন দুই নারী। এদের একজন হলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
শাহরিয়ার আলম এমপির স্ত্রী আয়শা আখতার ডালিয়া এবং জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা ও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহিয়া মাহি। নির্বাচনী এলাকায় ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার সাঁটানোসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে রাজনীতির মাঠে রয়েছেন তারা। দুজনই আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এই আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি গেল তিন টার্ম ধরে এই আসনের এমপি। মাঝে একবার শিল্প প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন ওমর ফারুক চৌধুরী। তবে এবার এ আসনে এমপি ফারুক চৌধুরীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভোটের মাঠে সক্রিয় বেশ কয়েকজন নেতা। তারা হলেন সাবেক ডিআইজি ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মতিউর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম রাব্বানী, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান আক্তার, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম আসাদুজ্জামান আসাদ ও জেলা কৃষক লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ তাজবুল ইসলাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই আসনে মনোনয়ন ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে বর্তমান এমপি ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে একটি পক্ষ। নির্বাচনের আগে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দীর্ঘদিন দখলে থাকা এ আসন হাতছাড়া হতে পারে এমন আশঙ্কাও স্থানীয় নেতাদের।
এদিকে এই আসনে বিএনপির প্রার্থীরাও সক্রিয়। ২০০৮ সালের আগের তিনটি টার্ম এ আসনটি বিএনপির দখলে ছিল। তখন এখানে এমপি ছিলেন প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হক। তিনি তিন দফায় মন্ত্রীও ছিলেন। এ আসনটি এবার পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি। তবে মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির একাধিক প্রার্থী মাঠে সক্রিয় থাকায় নিজেদের দ্বন্দ্ব বেড়েছে। এই আসনে এবার ধানের শীষের মনোনয়ন পেতে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতা। তাদের মধ্যে রয়েছেন তিনবারের সাবেক এমপি ও মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ছোট ভাই ও বিএনপি সরকারের সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব) শরিফ উদ্দিন শরিফ, ব্যারিস্টার আমিনুল হকের স্ত্রী আভা হক ও ভাগিনা ব্যারিস্টার মাহমুদুর রহমান মিলন। একই পরিবারের তিনজন ছাড়াও এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে মাঠে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক যুব বিষয়ক সম্পাদক সাজেদুর রহমান খান মার্কনি ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ক্যালিফোর্নিয়া বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন শাহীন।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এবার নির্বাচনে অংশ নিতে চান। এ আসনে একবার তিনি এমপি ছিলেন। এবার ভোটের মাঠে তার পোস্টার সেঁটেছেন, গণসংযোগও চালাচ্ছেন তার অনুসারীরা। এ আসনে জাতীয় পার্টির নেতা সালাউদ্দিন বিশ্বাস এবার নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন।
এই আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে জয়ী হয়ে টানা তিন মেয়াদ ধরে এমপি আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী। ২০১২ সালে তিনি শিল্প প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী টানা তিনবারের এমপি ও মন্ত্রী বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আমিনুল হককে পরাজিত করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক সাজাপ্রাপ্ত হয়ে পালাতক থাকায় বিএনপির মনোনয়ন পান তার বড় ভাই পুলিশের সাবেক আইজিপি ড. এম এনামুল হক। এবার এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন তার ছোট ভাই মেজর জেনারেল (অব) শরিফ উদ্দিন শরিফ।
এই আসনে এবার ওমর ফারুক চৌধুরী এমপি ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকায় আলোচনায় রয়েছে গত নির্বাচনে ‘সেভের স্টার’ নামে পরিচিত ওমর ফারুক এমপি বিরোধী গ্রুপের প্রধান রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা ও পুলিশের সাবেক ডিআইজি মতিউর রহমান। এ ব্যাপারে মতিউর রহমান বলেন, আগামী নির্বাচনে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছি। নিজ এলাকায় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও কথা বলছি। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে সেই নির্বাচন করবেন।
এ ছাড়া গত নির্বাচনে বর্তমান এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী বিরোধী ‘সেভেন স্টার’ গ্রুগের আরেক নেতা তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও মু-ুমালা পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম রাব্বানীও রয়েছেন ভোটের মাঠে। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রথম মনোনয়নপ্রত্যাশায় এলাকায় গণসংযোগ করে ভোটের মাঠে বেশ পরিচিত লাভ করেন।
অপরদিকে, একই গ্রুপের অপর নেতা জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক ও গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের তিনবারের নির্বাচিত সাবেক চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান আখতার এমপি প্রার্থী হিসেবে নিজেকে জানান দিচ্ছেন। গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন।
এ বিষয়ে আখতারুজ্জামান বলেন, এবার রাজশাহী জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট করেছি। জেলা পরিষদের নির্বাচন করার পর উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে ভোট করা তেমন মানায় না। তিনি এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট করতে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানান।
রাজশাহী-১ আসনে নতুন মুখ হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ছাত্র ও যুব নেতা একেএম আসাদুজ্জামান আসাদ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনিও নির্বাচনী এলাকায় ব্যানার ফেস্টুন সাঁটিয়েছেন।
এ ছাড়া এই আসন থেকে নতুনভাবে রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সহধর্মিণী আয়েশা আখতার ডালিয়া ও চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিও নির্বাচন করতে চান। তারা দুজনই এলাকায় সামাজিক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছেন। দলে ডালিয়ার কোনো পদ-পদবি নেই। তবে ডালিয়ার হঠাৎ এভাবে রাজনীতির মাঠে নামায় রাজশাহীতে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়। তার বাবার বাড়ি গোদাগাড়ীর ঘনশ্যামপুর গ্রামে।
এ বিষয়ে ডালিয়া বলেন, গোদাগাড়ী-তানোর আসনটিতে আমার বাবা-দাদার বাড়ি। প্রায় ১০ বছর ধরে এখানকার জনকল্যাণে কাজ করছি। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি নির্বাচনী লড়াইয়ে প্রস্তুত এবং জয়ী হওয়ার ব্যাপারেও আশাবাদী।
অপরদিকে, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির নানার বাড়ি তানোরের মুন্ডুমালায়। সেখানেই তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। সম্প্রতি স্বপ্ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে মাহির পোস্টার ও ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে গোদাগাড়ী-তানোরের হাট-বাজার ও মোড়গুলো। এলাকায় তরুণদের কাছে তিনি জনপ্রিয়।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে মাহিয়া মাহি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিলে তিনি ভোট করবেন। আমি মানুষের সেবা করতে চাই। আমার কাছে রাজনীতি মানে মানুষের সেবা করা। যদি এলাকার লোকজন আমাকে চায় এবং দল আমাকে মনোনয়ন দেয় অবশ্যই নির্বাচন করব।
বর্তমান এমপি ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, বহু হিসাব নিকাশ আছে। আওয়ামী লীগ যেহেতু বৃহৎ রাজনৈতিক দল, তাই যে কেউ প্রার্থী হতেই পারেন। এ জন্য আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে দল যাকে যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দেবে সেই নির্বাচন করবে।
তবে স্থানীয় নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেকদিন পর ২০০৮ সালে এই আসনটি উদ্ধার করে আওয়ামী লীগ। এবার এ আসনে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে হাতছাড়া হতে পারে আসনটি।
অন্যদিকে, এই আসনের এক সময়ের হেভিওয়েট নেতা ও তিনবারের এমপি ও মন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দীনের নাম বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছিল। যদিও এলাকায় তিনি পরিচিত নন। তবে এই আসনে তাকে বাগড়া দিতে সক্রিয় হয়েছেন একই পরিবারের অপর দুজন। এরা হলেন প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হকের স্ত্রী আভা হক ও ভাগিনা মাহবুবুর রহমান মিলন। এ নিয়ে ওই পরিবারে এখন চরম দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দীন বলেন, এবারের নির্বাচনে বিএনপি যাবে কিনা তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তিনি রাজশাহী-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, আমি দলের কাছে মনোনয়ন চাইব, বাকিটা দলের ব্যাপার। তিনি তার ভাই প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হকের কাজ ও অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, তিনি এই এলাকায় রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তার ভায়ের রেখে যাওয়া কাজ সমাপ্ত ও রাস্তাঘাটসহ সকল উন্নয়নের রক্ষণাবেক্ষণের কাজগুলো করবেন বলে জানান।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজেদুর রহমান খান মার্কনি বলেন, ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ভাই মেজর শরীফ তিনি বিএনপির কে? তিনি কি কোনো পদে বা দায়িত্বে আছেন? একটি পরিবার থেকেই যদি রাজনীতির নেতৃত্ব আসে তা হলে বাকিদের রাজনীতি করার দরকার নেই। তিনি বলেন, বিএনপি মনে করে ফেয়ার নির্বাচন হলে দল ক্ষমতায় যাবে। আমি মনে করি মনোনয়ন বেচা-বিক্রি যদি না হয়, ফেয়ার নমিনেশন হলে আমি পাবো ইনশাআল্লাহ।
এদিকে জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে এই আসন থেকে প্রার্থী হতে চান নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৮৬ সালে এই আসনে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন। এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগও করছেন। জেলা জামায়াতের সহসেক্রেটারি ড. মো. ওবাইদুল্লাহ দলের প্রার্থী হিসেবে মজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ করে বলেন, আমাদের পার্টি থেকে প্রায় তিন মাস আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছে তিনি আমাদের দলের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবেন।