ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

নৌকা নদীর ক্যানভাসে সচল ছবি

শফিকুল ইসলাম শামীম

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ১৪ জুলাই ২০২৩; আপডেট: ০১:৩৯, ১৪ জুলাই ২০২৩

নৌকা নদীর ক্যানভাসে সচল ছবি

নৌকা নদীর ক্যানভাসে সচল ছবি

মাদারীপুর অঞ্চলের দৃশ্যপট আদিকাল থেকে দেখতে যেমন শিল্পীর চিত্রপটে আঁকা ছবির মতো, তেমনই সকল স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রামের শক্ত ঘাঁটি নামেও খ্যাত। এ অঞ্চলের মানুষ কখনো প্রকৃতির মতো শান্ত; আবার কখনো ভয়ংকর সিংহ-শার্দুল। এ কারণে এক সময় এই জনপদটি পরিচিত ছিল ‘চিতোর অব বেঙ্গল’ নামে। চির চঞ্চলা এই জনপদটি ইতিহাস ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। প্রাগৈতিহাসিক যুগে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভূ-ভাগ বঙ্গোপসাগরে ছিল। আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন ও উজানের নদীর স্রোতের সঙ্গে পলি ও বালু এসে একটি বিশাল চর জেগে ওঠে। এরই ক্ষুদ্র অংশ আজকের মাদারীপুর জেলা।

ইতিহাসবিদদের মতে, বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্ট এই চরটি চন্দ্রদ্বীপ। পরে চন্দ্রদ্বীপ থেকে বাকলা, বিক্রমপুর, জালালপুর, ইদিলপুর, ফতেহাবাদ (ফাতাহবাদ), বাকেরগঞ্জ, বরিশাল, ফরিদপুর, মান্দারীপুর এবং সর্বশেষ ১৫ শতকে হযরত বদরুদ্দিন শাহ মাদারের নামানুসারে নামকরণ করা হয় মাদারীপুর। প্রাচীনকাল থেকে দেশের এই ভূখ-টি মধ্যভাটি অঞ্চল বা ভাটিবঙ্গ নামে খ্যাত হতে থাকে। এই নিম্নাঞ্চলটি এক ফসলী ও প্লাবনভূমি হওয়ায় এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। এক সময় এ অঞ্চলে কোনো পাকা রাস্তাঘাট ছিল না। কর্দমাক্ত পথ, হাতেগোনা স্বল্প সংখ্যক কোষা বা ডিঙ্গি নৌকা ও বাঁশের সাঁকো ছিল একমাত্র ভরসা। তাও অনেক পরের ইতিহাস। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে নৌকার প্রচলন বৃদ্ধি পেতে থাকে। 
মাদারীপুর ১৮০৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা জালালপুর জেলাধীন ছিল। ১৮০৬ সালে মাদারীপুর বাকেরগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মাদারীপুর তখন বুড়িরহাট বর্তমান গোসাইরহাট থানার অধীন ছিল। ১৮৫৪ সালে মাদারীপুর মহকুমার সৃষ্টি। ১৮৭৩ সালে মাদারীপুর ফরিদপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮০৭ সালে ফরিদপুর জেলার সৃষ্টি। এ জেলার তখনকার নাম ছিল ঢাকা-জালালপুর। ১৮০৭ সালে জেলা সদর ঢাকা থেকে ফরিদপুর আলাদা করা হয়। মাদারীপুর মহকুমা বর্তমান জেলা প্রথমে ঢাকা জেলা পরে বাকেরগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলাভুক্ত ছিল। ১৯০৯ সালে মাদারীপুর মহকুমা থেকে কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থানা নিয়ে গোপালগঞ্জ মহকুমা সৃষ্টি হয়।

মাদারীপুর ১০টি থানা নিয়ে গঠিত ছিল। ১৯৭৮ সালে মাদারীপুর থেকে ৬টি থানা নিয়ে শরীয়তপুর মহকুমা গঠিত হয়। বাকি ৪টি থানা নিয়ে মাদারীপুর মহকুমা থেকে যায়। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ মাদারীপুরকে একটি পৃথক জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। থানাগুলো উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। এই সময় ব্যাপকহারে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন ঘটে।
তিরিশ থেকে চলিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে আড়িয়ালখাঁর ভাঙনে আদি শহর বিলীন হয়ে যায়। প্রাচীন শহরে অবকাঠামো বলতে কিছুই ছিল না। কৃষিপণ্যের মধ্যে পাট ছিল প্রধান অর্থকরী ফসল। পাট ব্যবসায়ের জন্য চরমুগরিয়া বন্দর ছিল মাড়োয়ারীদের প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র। এই নদী বন্দরটি গড়ে ওঠে লোয়ার কুমার ও আড়িয়ালখাঁ নদের সংগমস্থলে। পাট রপ্তানির জন্য চরমুগরিয়া বন্দর প্রাচ্যের দ্বিতীয় ডান্ডি নামে খ্যাত ছিল। এখান থেকে পাটের বেল্ট বড় বড় জাহাজে কলকাতা হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করতো মাড়োয়ারীরা। পরবর্তীকালে প্রকৃতির বৈরিতায় শুকিয়ে যেতে থাকে নদ-নদী। সেই সঙ্গে এক সময়ের প্রসিদ্ধ চরমুগরিয়া নদী বন্দরের মারোয়ারীরা ধীরে ধীরে এখান থেকে চলে যায়। 
নৌকার সেকাল-একাল দেশের মধ্য-দক্ষিণ বা ভাটিবঙ্গের একটি ছোট্ট জনপদ মাদারীপুর। পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, ময়নাকাটা ও পালরদী নদীসহ অসংখ্য খাল বিল-বাঁওড় ঘেরা এই অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রূপ-লাবণ্যে ছিল উর্বর এবং প্লাবনভূমি। এক কথায় বলা যায় প্রাচীনকাল থেকে এ জনপদটির যাতায়াত ব্যবস্থায় ছিল একেবারেই দুর্গম। এই জেলার কোনো কোনো এলাকা বার মাস থাকতো জলমগ্ন। কৃষিনির্ভর এ অঞ্চলের প্রকৃতির বৈরিতা, শ্রেণি বৈষম্য ও শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে কোনো দিন উন্নয়নের ছোঁয়াটুকু লাগেনি এখানে। যে কারণে নদ-নদী, বিল-বাঁওড় ও ভাঙনপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় একমাত্র নৌপথ ছাড়া এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থার আর কোনো বিকল্প ছিল না। এই দুর্গম জনপদে সহজ যাতায়াতে নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা।

কাঠের তৈরি কয়েকটি লঞ্চ চলাচল করতো অভ্যন্তরীণ নৌপথে। শুধু বর্ষাকালই নয়, শুস্ক মৌসুমেও এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাতায়াতের জন্য ছিল কর্দমাক্ত মেঠোপথ। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যাতায়াতের একমাত্র নৌযান ছিল নৌকা ও ভেলা। এক থানা থেকে অন্য থানায় যেতে খাল-বিল পাড়ি দিতে অন্তত ১০/১৫টি সাঁকো ও নৌকায় পার হতে হয়েছে। তখন নানা ধরনের নৌকার প্রচলন ছিল। এর মধ্যে ডিঙ্গি নৌকা, পণ্য পরিবহনের জন্য ছোট-বড় ঘাসি (গুনটানা) নৌকা, এক মাল্লার পাল তোলা নৌকা, জমিদার, উচ্চবিত্ত ও শৌখিন ব্যক্তিবর্গ নানা রঙের গয়না ও পানসি নৌকা ব্যবহার করতেন। তবে এ অঞ্চলে সওদাগরি নৌকার প্রচলন ছিল না।

আদিকাল থেকে এ অঞ্চলে নৌকা তৈরি ও কাঠের কারুকার্যের জন্য মিস্ত্রি বা সূত্রধররা ছিল পেশাজীবী সম্প্রদায় বা লোক-কারিকর। ব্রিটিশ শাসনামলে মাদারীপুর জেলায় মাত্র ১০টি আদি সূত্রধর পরিবার ছিল। তারা শহরের বাদামতলা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তারা কোথা থেকে এসেছিল সে ইতিহাস অজানা। পর্যায়ক্রমে কলকাতা থেকে আসা মিস্ত্রিদের কাছ থেকে এ অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ধরনের নৌকা তৈরি, নক্সা ও টেরাকোটা কাজ শিখে। পাশাপাশি চেয়ার-টেবিল, খাট-পালঙ্কসহ নানা রকম কাঠের আসবাবপত্র তৈরি করতে শেখে এবং এ সবের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোকজন এ পেশায় চলে আসেন। প্লাবন ভূমি হওয়ায় এবং কৃষিনির্ভরের কারণে এই জেলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডিঙ্গি নৌকার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পায়। নৌকার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মিস্ত্রিদের কাছে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ শিখে এ পেশায় চলে আসেন। 
সঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও ১৫/২০ বছর আগে জেলায় নৌকার কারিকর পরিবার ছিল প্রায় সাড়ে ৭শ’। এর মধ্যে মাদারীপুর সদর উপজেলায় ৪শ’, কালকিনিতে দেড়শ’, রাজৈরে দেড় শ’ এবং শিবচরে ৫০ পরিবার। এরাই মূলত নৌকা তৈরির আদি মিস্ত্রি। তখন এই অঞ্চলের মানুষ নদ-নদী, খাল ও বিল-বাঁওড়ে হাজার হাজার নৌকা ব্যবহার করতেন দৈনন্দিন কর্মকা-ে। সে সময় মিস্ত্রিরা বাড়িতে ও রাস্তার পাশে বসে নৌকা তৈরি করে জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করতেন। তখন জেলার ছোট-বড় ৫ শতাধিক হাট বাজারে বিভিন্ন সাইজের নৌকা বিক্রি হতো।

তবে মাদারীপুর জেলার মধ্যে নৌকা বিক্রির প্রসিদ্ধ হাট ছিল-সদরের পুরান বাজার,  মোস্তফাপুর, কেন্দুয়া, কলাগাছিয়া, মঠেরবাজার, ছিলারচর, এটিএম বাজার, শিবচর উপজেলার শিবচর, পাচ্চর, উৎরাইল, মাদবরেরচর, চাঁন্দেরচর, উমেদপুর, বন্দরখোলা, সন্যাসীরচর, কুতুবপর, কাদিরপুর, ভদ্রাসন, বহেরাতলা, শেখপুর, ভা-ারীকান্দি, রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট, আমগ্রাম, কদমবাড়ি, সাতপাড়, লাউসার, পাখুল্যা, লখন্ডা, কবিরাজপুর, হোসেনপুর, মহেন্দ্রদি কালিবাড়ি, কালকিনি উপজেলার খাশেরহাট, রমজানপুর, সাহেবরামপুর, সিডিখান, গোপালপুর ভূরঘাটা, বাকাই বাজার, ডাসার, নবগ্রাম, শশীকর, বাজিতপুর।

বর্তমানে নৌকার হাট-বাজারের সংখ্যা কমে গেছে। ১৫-২০ বছর আগে একটি ডিঙি নৌকা ৫ থেকে ৭ শ’ টাকায় বা এক থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমান সময়ে তার দাম প্রকার ভেদে ৫-৬,৭-৮. ৯ ও ১০ হাজার টাকা করে বিক্রি হয়। তাও খুব কম হাট-বাজারে নৌকা বিক্রি করা হয়ে থাকে। যাতায়াতে ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ায় নৌকার প্রচলন একেবারে হ্রাস পেয়েছে। তবে বিল অঞ্চলের কৃষক ও নদ-নদীতে মাছ ধরার জন্য জেলেরা কিছু কিছু ডিঙি নৌকা ক্রয় করে থাকে। কিছু কিছু আসবাবপত্র তৈরির ফার্নিচারের দোকানে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা তৈরি করা হয়। 
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জেলার নৌকার সংখ্যা কমে গেছে বলে নৌকা নির্মাতারা মনে করেন। অন্যদিকে ভাটিবঙ্গের ঐতিহ্য নৌকার সংখ্যা ধীরে ধীরে বিলুপ্তি দিকে ধাবিত হচ্ছে। এসব কারণে বেকার হয়ে পড়েছে নৌকা তৈরির কারিকররা। অনেকে পৈত্রিক পেশা পরিবর্তন করে কাঠের আসবাবপত্র তৈরির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। আবার কেউ কেউ এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে আবাহমান বাংলা ও বাঙালির অতি প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। 
মাদারীপুর পুরান বাজার কাঠপট্টি এলাকার ফার্নিচার তৈরির মিস্ত্রি কাওসার আহমেদ বলেন, ‘এখন তো তেমন বন্যা হয় না, নদ-নদীতে ও খালে বিলে পানি নাই। তা ছাড়া প্রচুর রাস্তাঘাট ব্রিজ নির্মাণ হওয়ায় নৌকার চাহিদা কমে গেছে। মাঝে মধ্যে কাজের ফাঁকে ফাঁকে দু-একটি ডিঙি নৌকা তৈরি করি, আবার কেউ অর্ডার দিলে তাদের চাহিদা পূরণ করতে নৌকা বানাই।’ 
শিবচর উপজেলার উৎরাইল হাই স্কুলের শিক্ষক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমন বলেন, জেলার সর্বত্র নতুন নতুন সড়ক মহাসড়ক নির্মাণ, বিভিন্ন নদ-নদী ও খালে বিলে অসংখ্য কালভার্ট, ছোট-বড় ব্রিজ নির্মাণ হওয়ায় আগের মতো নৌকা তৈরিও হয় না এবং বিক্রিও হয় না। এক সময় উৎরাইল বন্দর ছিল জেলার মধ্যে নৌকার প্রসিদ্ধ হাট। এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন প্রতি হাটে ১৫/২০টি ডিঙি নৌকা রাস্তার পাশে সাজিয়ে রাখা হয়।

 

যন্ত্রের যন্ত্রণা

ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে পালতোলা নৌকাসহ নানা প্রকার নৌকা। পদ্মা-যমুনা নদীতে এখন আর চোখে পড়ে না নানা প্রকার রং-বেরঙের নৌকা। চোখে পড়ে না পালতোলা ও গুন (দার) টানা নৌকা। 
রাজবাড়ী জেলার ৫টি উপজেলার মধ্যে পাংশা, কালুখালী, সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলা পদ্মা নদীর পারে অবস্থিত। বালিয়াকান্দি উপজেলা চন্দনা, গড়াই নদীর পারে অবস্থিত। নদী মাতৃক এই জেলার সাধারণ মানুষ নানা প্রকার নৌকার সঙ্গে পরিচিত। যেমন ডিঙ্গি, ডোঙ্গা, কোষা সাম্পান, গয়না, বজরা, বাইচের নৌকা, বাতনাই, ময়ুরপঙ্খী, বালার, পানসী, ছাদি, পাল তোলা, ছিপনাও, পেটকাটা নাও, বোঁচা নাও, ছুঁইওয়ালা বা একমালাই, পাতাম, শ্যালো, রপ্তানি, নায়রী, বাচারি, লম্বা গদি, ঘাসি ও ইলশা নৌকা। 
পদ্মা-যুমনা, চন্দনা ও গড়াই নদীতে ডিঙ্গি নৌকা ও জেলেদের মাছ ধরার নৌকা ছাড়া হারিয়ে গেছে হরেক রকম বাহারি রং-বেরঙের নৌকা। তবে এসব মাছ ধরার নৌকায় ইঞ্জিন রয়েছে। মাঝিমাল্লা ছাড়া চালাতে হয়। 
সময়ের বিবর্তনে আধুনিকায়নের ছোয়া লেগেছে নৌযানে। সে ধারাবাকিতায় ছোট-বড় নানা প্রকার নৌকায় লেগেছে ইঞ্জিন, লেগেছে মোটর। এখন আর পাল তোলা নৌকা দেখা মেলে না। বেশি সংখ্যা নৌকা হারিয়ে গেছে। হয়ত একটি সময় স্মৃতি পাতায় থাকবে। তবে দেখা যাবে না নদীতে। আক্তার উদ্দিন মিয়া (৭৫) নামের এক ব্যক্তি বলেন, পদ্মা পারের মানুষ আমরা। সুতরাং অনেক নৌকার সঙ্গে আমরা পরিচিত। যে নৌকাগুলো এখন আর দেখা যায় না। ছোট ছোট কিছু ডিঙ্গি নৌকা দেখা যায়। তবে কিছু নৌকা দেখা গেলেও মাঝি-মাল্লা প্রয়োজন নেই। কারণ এসব নৌকা ইঞ্জিনচালিত। যা একলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।  
ফজের বেপারী (১০৫) নামের এক বয়স্ক ব্যক্তি বলেন, আমাদের বাড়িতে সার্বক্ষণিক ডিঙ্গি, পানসি নৌকা থাকতো। বর্ষা মৌসুমে চলাচল ও হাট-বাজারে যাওয়া-আসার জন্য পানসি নৌকা ছিল। গ্রামের ছোট বড় সকল পরিবারের জন্য নৌকা ছিল প্রধান বাহন। হাঁট-বাজারে যাওয়ার জন্য নৌকার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হতো। কৃষি কাজে ব্যবহার করা হতো নৌকা। যে কারণে বর্ষার আগে ছোট বড় সকল নৌকা মেরামত করে রাখতো। এখন আর নদীতে নৌকা দেখা যায় না। দেখা যায় ইঞ্জিন চালিত নৌকা, ট্রলার, বাল্কহেড। ছোট ছোট নৌকায় এখন আর পাল তোলে না। ইঞ্জিন চালিয়ে চলাচল করে। 
কবি লিখেছেন ‘আষাঢ় মাসে ভাসা পানি/ পূবালী বাতাসে, বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি/ আমারনি কেউ আসে।’ 
এখন আর কেউ রং-বে-রঙের নৌকা দেখার জন্য তাকিয়ে থাকেন না। কারণ নদীতে চলে না রং-বে-রঙের নৌকা। কবি আর কবিতা লিখতে পারছে না। শিল্পী মন খুলে গান ধরতে পারছে না। গ্রামের বধূ নৌকায় আর বাবার বাড়ি যাচ্ছে না। সময়ের সঙ্গে এই চিত্রগুলো এখন স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশের ফলে বিলুপ্তির পথে আবহমান গ্রামবাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ঐতিহ্যবাহী পাল তোলা নৌকা। হাতে গোনা দু’একটা পালের নাও, বাদামী নাও চোখে পড়লেও তাদের নৌকায় আগের মতো আর মানুষ ওঠে না।

নতুন বধূ শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য পালতোলা নৌকার বায়না ধরে না। রাজবাড়ীর পদ্মা পারের ৮০ শতাংশ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল নদী আর পালের নাওয়ের। ৯০ দশকের পূর্বে পদ্মা-যমুনা নদীতে নৈসর্গ রূপের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে সারি সারি নৌকা। এসব নৌকায় ছিল রঙিন পাল। 
বিভিন্ন আকার ও ধরনের নৌকাই ছিল মানুষের যাতায়াত ও পরিবহনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। নৌকা চালানোর জন্য পালের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। হাজারীপাল, বিড়ালীপাল, বাদুরপাল ইত্যাদি পালের ব্যবহার ছিল নৌকাগুলোতে। পালের নৌকার পাশাপাশি মাঝিদেরও বেশ কদর ছিল একসময়। মাঝিরা নৌকা চালানোর বিভিন্ন কলাকৌশলে পারদর্শী ছিলেন। হিসাব রাখতো জোয়ার-ভাটার, বিভিন্ন তিথির এবং শুভ-অশুভ ক্ষণের। রাতের আঁধারে নৌকা চালানোর সময় দিক নির্ণয়ের জন্য মাঝিদের নির্ভর করতে হতো আকাশের তারার ওপর। 


পদ্মায় শখের নৌকা

প্রমত্তা পদ্মা নদী ঘিরেই একসময় সম্প্রসারিত ছিল রাজশাহীর ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি। তখন পানিতে টইটম্বুর থাকতো নদী। উথাল-পাথাল ঢেউ আঁচড়ে পড়তো। মালবাহী বড় বড় নৌকার পাশাপশি চলতো হাজারো পালতোলা নৌকা। সে বহু আগের কথা। এখন সবকিছু পাল্টে গেছে। নদী হারিয়েছে নাব্য। আর নদীর বুক চিরে বয়ে চলা এক সময়ের সেই সব নৌকাও এখন ইতিহাস।
এখন বছরের দুই/তিন মাস পদ্মায় পানি থাকে। বাকি সময় নদীর বুকে জেগে ওঠে বিশাল বিশাল চর। এখন মালবাহী নৌকার আনাগোনা রাজশাহীর পদ্মা নদীতে সোনালী অতীত। পাল তোল নৌকা তো আর চোখেই পড়ে না। মাঝিরা আর দাড়-বৈঠা ঠেলেন না। তবে এখনো পদ্মার বুকে নৌকা চলে। সেগুলো ইঞ্জিনচালিত। মালামাল বহনের জন্য নয় এসব নৌকা। 
এখন রাজশাহীর বেশ কয়েকটি ঘাট থেকে পদ্মার বুকে নৌকা চলাচল করে ভ্রমণতরী হিসেবে। শুধু পদ্মায় ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য চালু রাখা হয়েছে এসব নৌকা। ছোট ও মাঝারি আকারের এসব নৌকায় বৈচিত্র্য নিয়ে তৈরি করা। নৌকার দুই সারিতে বেঞ্চ বা চেয়ার পাতা থাকে। ওপরে রঙিন কাপড়ের ত্রিপল। এমন নৌকা এখন পদ্মা নদীকে রঙিন করে তোলে। এসব নৌকায় ঢেউ তোলে মাঝিদের মনেও।
বর্ষা ছাড়াও অন্যান্য ঋতুতেও অল্প পানিতে এসব নৌকা চলে এখন রাজশাহীর পদ্মায়। আর এসব নৌকার যাত্রী শুধু শৌখিন ও ভ্রমণ বিলাশী মানুষ। একটু বিনোদনের আশায় এসব নৌকায় চড়ে পদ্মা নদী ভ্রমণ করেন তারা। 
গত বুধবার দুপুরে নগরীর পদ্মা নদীর টি-গ্রোয়েন এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে অন্তত ২০/২২ টি নৌকার সারি। পাড়ে বসে এসব নৌকার মাঝিরা হাকডাক করছেন-যাত্রী টানছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত তারা ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য নৌকা চালান। ভর বর্ষায় যখন পদ্মা উত্তাল থাকে তখন যাত্রী তুলনামূলক কম হয়। ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় চড়তে চান না মানুষ। তবে বছরের এই সময়ে (বর্ষার শুরুতে) যাত্রী বেশি হওয়ায় নৌকার বহরও বৃদ্ধি পায়। 
এখানকার মাঝি সর্দার মাহাবুল বলেন, তিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে পদ্মায় নৌকা ভাসান। এখন রাজশাহীর পদ্মায় যেসব নৌকা চলে সেগুলো শুধু ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য। যাত্রীদের সঙ্গে চুক্তি করে তারা নৌকা চালান। খরার সময় পানি শুকিয়ে চর পড়লে তাদের যাত্রী কমে যায়। 
এসব নৌকার মাঝিরা বলেন, তাদের এসব নৌকায় বাহারী কোনো রঙ-ঢং থাকে না। খুব সাধারণ নৌকা। তবে নৌকার ওপর চেয়ারপাতা থাকে আর ওপরে রঙিন কাপড়ের ত্রিপল। তারা বলেন, এখন পদ্মায় আর পালতোলা নৌকা চলে না। আগে যখন উত্তাল পদ্মা পাড়ি দেওয়া হতো তখন বাতাসের গতিবেগ কাজে লাগাতে পাল তোলা হতো। এখন ইঞ্জিলচালিত নৌকা। তাই পাল তোলার দরকার হয় না। তাছাড়া ভ্রমনকারীদের গন্তব্য খুব বেশি দূর হয় না। তাই এভাবেই সাদাসিধে নৌকা চলে পদ্মায়। তারা এসব নৌকাকে ভ্রমণ তরী হিসেবে মনে করেন। বংশ পরম্পরায় এখন তারা শৌখিন নৌকা ভাসান নদীতে। তাদের যাত্রীরাও শৌখিন-ভ্রমণ বিলাসী। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহীর পদ্মানদীর রাজশাহী অংশে ৬টি ঘাট থেকে দেড় শতাধিক ভ্রমণ তরী চলাচল করে। টি-গোয়েন, শ্রীরামপুর, বুলনপুর, জাহাজঘাট, ফুলতলা ও হাইটেক পার্ক এলাকা থেকে এসব নৌকা দিনভর ছুটে বেড়ায় পদ্মা নদীতে। হাইটেক ও বুলনপুর ঘাট থেকে কিছু মালামালবাহী নৌকা চলে। সেগুলো ব্যবহার করে সাধারণত চরের মানুষ। ওপার থেকে ধান, গম, সবজি নিয়ে এপারে আসেন তারা। তাদের মতে এখন আর বৈঠা ঠেলা নৌকা নেই পদ্মায়। সবই ইঞ্জিনচালিত। তাদের ভাষায় এগুলোকে বলে শ্যালো নৌকা। এসব নৌকায় পছন্দ করেন ভ্রমণপিপাসুরা। তারা নৌকায় চড়ে উত্তাল পদ্মার নদীবক্ষে ঘুরে বেড়ান। 
মাঝিরা বলেন, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীর এবং শিশুরাও বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের নৌকায় পদ্মানদী ঘোরেন। নৌকায় চড়ে তাদের কোনো গন্তব্য থাকে না। এপার থেকে ওপারেও যায় না। শুধু ঘণ্টা চুক্তিতে পদ্মা ঘুলে দেখা লক্ষ্য থাকে তাদের।
রাজশাহীর পদ্মায় ছোট ডিঙি আকৃতির নৌকাগুলো ৫-৬ জন যাত্রীর উপযুক্ত আর মাঝারি নৌকায় সর্বোচ্চ ২০ জন যাত্রী চলাচল করতে পারে। এখানে বড় আকৃতির কোনো নৌকা নেই পদ্মা নদীতে।
এক সময়ের পদ্মা নদীর উত্তাল ভাব এখন আর নেই। কালের বিবর্তনে বিবর্ণ হয়ে পড়েছে দেশের অন্যতম প্রধান এ নদী। উজানে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এখন শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার বিশাল অংশ বালুচরে পরিণত হয়। বর্ষায় আবার সে চর হারিয়ে পানি থৈ থৈ করে। তখন জেগে উঠে মাঝিদের প্রাণ। যে নদীতে এক সময় পাল তোলা নৌকা চলতো সে নদীতে এখন নৌকা চলে সীমিত সংখ্যায়। শৌখিনতার কারণে এখন শৌখিন নৌকায় জীবিকার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে পদ্মাপাড়ের মাঝিদের।

×

শীর্ষ সংবাদ:

যেই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে: আমীর খসরু
জামায়াত নেতারা রাজাকার হলে পাকিস্তানে গাড়ি বাড়ি থাকতো : শামীম সাঈদী
এনসিপির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা নেই- উমামা ফাতেমা
‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটকদের অধিকাংশই ভারতীয় মুসলমান
ইয়েমেনে হামলা চালিয়েই সাগরে ডুবে গেল মার্কিন সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান
জামিন পেলেননা তারেক রহমানের খালাতো ভাই তুহিন
লন্ডনে আজ আর্সেনাল পিএসজি মহারণ
১৭ অভিনয়শিল্পীর নামে মামলা, তালিকায় আছেন নুসরাত ফারিয়া-অপু বিশ্বাস-ভাবনাসহ অনেকেই
১০০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ডের ১১৯তম ড্র অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল
স্বর্ণের দাম, রেকর্ড উচ্চতা থেকে পতনের পথে
কুমিল্লায় পুলিশ-সেনাবাহিনীর চাকরির নামে প্রতারণা: দালালসহ ১৩ জন গ্রেফতার
১২ বছর বয়সী ছেলে শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের অভিযোগে ৩ মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেফতার