ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

ব্রহ্মপুত্রের খনন কাজ মুখ থুবড়ে পড়েছে

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ০০:২৬, ৫ জুন ২০২৩

ব্রহ্মপুত্রের খনন কাজ মুখ থুবড়ে পড়েছে

.

মুখ থুবড়ে পড়েছে ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ। পাঁচ বছর মেয়াদি খননকাজ প্রকল্পের চার বছরে অগ্রগতি ৪৬ শতাংশ! সময়ে খননকাজে ব্যয় হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। ধীরগতির খননকাজের ৪৬ ভাগ অগ্রগতির পরও ব্রহ্মপুত্র নদে প্রত্যাশিত পানির প্রবাহ ফিরে আসেনি। উল্টো খননকাজের অনেক এলাকায় নতুন করে ছোট বড় অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। নদের অনেক জায়গায় হাঁটুসমান পানি। হেটেই নদ পার হচ্ছেন অনেকে। ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদেও নেই উদ্যোগ। খননের বালু নিয়েও রয়েছে হরিলুটসহ নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ। এসব নিয়ে ক্ষুব্ধ হতাশ ময়মনসিংহের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলনে নেমেছে। দাবি উঠেছে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের বিস্তারিত পরিকল্পনা জনসমক্ষে প্রকাশ, খননের বালু দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড় বরাবর সড়ক নির্মাণ, খনন এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে যুক্ত শাখা নদী খালসমূহ মূল প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করার। নিয়ে ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলন, পরিবেশ রক্ষা উন্নয়ন আন্দোলন এবং জনউদ্যোগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন ইতোমধ্যে মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করেছে। ব্রহ্মপুত্র নদ খনন-ময়মনসিংহবাসীর প্রাণের দাবি ছিল।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ খননের কাজ করছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ব্রহ্মপুত্র নদ খনন এলাকার রক্ষণাবেক্ষণের কাজও করবে বিআইডব্লিউটিএ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান-ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) এই প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। গত ২০১৯ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ আগামী ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা। চার বছরের মাথায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কোভিড পরিস্থিতি, প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে ধীরগতি ব্রহ্মপুত্র খননসহ খননের বালু রাখা নিয়ে স্থানীয়ভাবে বাধা বিঘœ করার নানা সংকট সমন্বয়হীনতা প্রকল্পের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার মূল কারণ বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার টোক থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের যমুনার উৎসমুখ পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্পের কাজ শুরু হয় গত ২০১৯ সালে। সরকারের দুই হাজার ৭৬৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি এই মেগাপ্রকল্পের কাজ আগামী ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া, ময়মনসিংহের গফরগাঁও, ত্রিশাল, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ সদর, মুক্তাগাছা, জামালপুর, শেরপুর গাইবান্ধা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদ খননের কাজ করার কথা। চুক্তিবদ্ধ ১৪টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ব্রহ্মপুত্র নদের ২২৭ কিলোমিটারের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে পাকুন্দিয়ার টোক থেকে ময়মনসিংহ জামালপুর পর্যন্ত ১৬০ কিলোমিটার এলাকা খননকাজ শুরু করে। এর মধ্যে টোক থেকে ময়মনসিংহ সীমানার ১১০ কিলোমিটার জামালপুরের ৫০ কিলোমিটার খনন চলছে। এজন্য জামালপুর ময়মনসিংহে আলাদা ড্রেজার বেজ তৈরি করা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ড্রেজিংয়ের কাজে মোট ৩৫টি ড্রেজার যোগ দেয়। শুরুতে বলা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার টোক পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার পর্যন্ত নদে নাব্য ফিরিয়ে এনে সারাবছর নৌ চলাচলের উপযোগী করা হবে।

বিআইডব্লিউটিএ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহসিন মিয়া জনকণ্ঠকে জানান, প্রকল্পের আওতায় ১০০ মিটার (৩০০ ফুট) প্রশস্ত মিটার (প্রায় ১০ ফুট) গভীর খননের মাধ্যমে নৌ পথটি দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথে উন্নীত করা হবে। এতে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে সারাবছর নৌ চলাচলে সক্ষম হবে। প্রকল্পের ১ম পর্যায়ের ১৬০ কিলোমিটারসহ জামালপুর পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার খনন করা হবে। পরবর্তীতে যমুনা ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে গাইবান্ধার এলেন্দাবাড়ি ইউনিয়নের সন্ন্যাসীর চর পর্যন্ত আরও ৩৭ কিলোমিটার খনন করা হবে। প্রকল্পের মেয়াদে ধাপে ধাপে ব্রহ্মপুত্র নদের ৩টি লেয়ার খনন করা হবে বলে জানায় বিআইডব্লিউটিএ। প্রথম ধাপে ব্রহ্মপুত্র নদের ১টি লেয়ার খননের কাজ চলছে। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার টোক থেকে ময়মনসিংহ অভিমুখে শুরু হওয়া ধীরগতির খননকাজ ব্রহ্মপুত্রে পানির প্রবাহ না বাড়ায় ময়মনসিংহবাসীকে হতাশ করে  তোলে।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র আরও জানায়, সময় ব্রহ্মপুত্র নদের ভাটি থেকে উজানের দিকে খনন চলে ধীরগতিতে। টোক থেকে শুরু হওয়া খনন চলে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা অভিমুখে। সময় টোক, গফরগাঁও, ত্রিশাল, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ সদরের জয়নুল আবেদীন পার্ক, পুলিশ লাইন জেলখানা ঘাট  মুক্তাগাছা পর্যন্ত প্রথম লেয়ারের খনন করা হয়। একই সময়ে জামালপুরের কিছু এলাকায় খনন কাজ করা হয়। খননের বালু ফেলা হয় এসময় ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড়ে। শুরুতে বালু নিয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় বেশিরভাগ বালু ফেলা হয় ব্রহ্মপুত্র পাড়ের ব্যক্তি মালিকানার ফসলি জমিতে। বর্ষায় এই বালু ফের ঢলে পড়ে ব্রহ্মপুত্র নদে। আর শুস্ক মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র পাড়ে ফেলা রাখা বালুর বিরাট অংশ স্থানীয় প্রভাবশালীরা ড্রাম ট্রাকে করে দিনে রাতে নিয়ে যায়। এতে সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, ময়মনসিংহের গফরগাঁও পৌর এলাকা, ত্রিশাল, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর ময়মনসিংহ সদরে ব্রহ্মপুত্র নদের বালু হরিলুট হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ব্রহ্মপুত্র নদ খননের বালু ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল স্থানীয় জেলা প্রশাসনের। কিন্তু প্রশাসনের কার্যকর কোনো নজরদারি না থাকায় বালু হরিলুট হয়েছে খেয়াল খুশিমতো। এভাবেই পার হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদের চার বছর। সময় প্রকল্পের কাজ হয়েছে ৪৬ শতাংশ। এজন্য খরচ হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। প্রথম লেয়ার খননের কাজ নো শেষ হয়নি। ব্রহ্মপুত্র নদ মিটার গভীর ১০০ মিটার প্রশস্ত করার কাজও দৃশ্যমান নয়। দ্বিতীয় তৃতীয় লেয়ার খনন শুরুই হয়নি। তবে খনন এলাকার মধ্যে বেশ কিছু পয়েন্টে বার বালু কাটা হয়েছে বলে দাবি বিআইডব্লিউটিএর। খনন চললেও ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উদেচ্ছদেও নেই কোনো উদ্যোগ। রকম অবস্থায় পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের চার বছর পর এখন মেয়াদ বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়তে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে বাড়তে পারে প্রকল্পের ব্যয়ও।

হেঁটেই পার হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র সরেজমিন দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের বিরাট অংশজুড়ে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। কোথাও হাঁটুসমান পানি। তাতে হেঁটেই পার হচ্ছে অনেকে। অনেক জায়গায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানির প্রবাহ নালার মতো। ময়মনসিংহ নগরীর খাগডহর, জেলখানার ঘাট, পুলিশ লাইন, জয়নুল আবেদীন উদ্যান, কাচারিঘাট, জুবলি ঘাট, থানার ঘাট কালিবাড়িসহ বেশ কিছু এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের এমন মরণদশা। ময়মনসিংহবাসীর প্রধান দাবি ছিল পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ খননের। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার চলতি মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পরই ব্রহ্মপুত্র নদ খননের প্রকল্প হাতে নিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়। বলা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ব্রহ্মপুত্র নদে শুষ্ক মৌশুমেও ১০ ফুট পানির প্রবাহ থাকবে। প্রশস্ত হবে ৩০০ ফুট। এমনটি হলে এতদঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে বদলে যাবে ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড়ের মানুষের জীবনধারা। নৌ পরিবহন ব্যবস্থা চালু হলে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। উন্নয়ন ঘটবে মৎস্য সম্পদের। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া কমে আসবে। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ চার বছর শেষ হওয়ার পর এখনো কোন কিছু দৃশ্যমান না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে ময়মনসিংহবাসী। রকম পরিস্থিতিতে জনউদ্যোগ নামে একটি সংগঠন খাগডহর কাচারিঘাট এলাকায় মিডিয়া ক্যাম্পেইন করেছে। এর আগে খননের নামে ব্রহ্মপুত্র নদকে মেরে ফেলা হচ্ছে এমন অভিযোগ এনে কাচারিঘাট এলাকায় হাঁটুসমান পানিতে নেমেমৃতের চিৎকারব্যানারে মানববন্ধন করেছে ময়মনসিংহ শহর কয়েকটি উপজেলা থেকে আসা তরুণ তরুণীরা। সময় তারা বিষাদের গান গেয়ে প্রতিবাদ জানায়। সর্বশেষ গত মে ময়মনসিংহ নগরীর শহীদ ফিরোজ জাহাঙ্গীর চত্বরে নাগরিক আন্দোলন মানববন্ধন সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে পরিকল্পিতভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের দাবি জানায়, গত ১৪ মে নাগরিক আন্দোলন কার্যালয়ে আন্দোলনের প্রতি সমর্থন আদায়ে পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে এবং গত ২১ মে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে নাগরিক আন্দোলন। ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম জানান, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র যমুনার উৎসমুখ খনন না করা পর্যন্ত এর সুফল মিলবে না। বিআইডব্লিউটিএ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ব্রহ্মপুত্র খননের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী মোহসিন মিয়া জনকণ্ঠকে জানান, যমুনা ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থল খননের বিষয়টি তাদের পরিকল্পনায় রয়েছে। প্রথমেই এই সংযোগস্থল খনন করা হলে পানির প্রবাহের তোড়ে পুরো খনন বাধাগ্রস্ত হবে। আর তাই খনন শুরু হয়েছে ভাটি থেকে উজানের দিকে। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবাহ দৃশ্যমান হবে বলে জানান তিনি।

খননের বালু হরিলুট! দুদকের তদন্ত দাবি ব্রহ্মপুত্র নদ খননের শুরু থেকেই বালু নিয়ে নয়-ছয়সহ নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে। অপরিকল্পিতভাবে খননের বালু যেখানে সেখানে দুই পাড়ে ফেলে রাখার পর স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারির অভাবে খননের বালু হরিলুট হয় নির্বিচারে। একদিকে দিনের পর দিন ফেলে রাখা বালু স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ড্রাম ট্রাকের মাধ্যমে নিয়ে যায়। অন্যদিকে বর্ষায় ফেলে রাখা বালু সহজেই ব্রহ্মপুত্র নদে গড়িয়ে পড়ে। ময়মনসিংহের গফরগাঁও, ত্রিশাল, গৌরীপুর, ঈশ্বরগঞ্জ সদর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদ খননের বালু সবচেয়ে বেশি হরিলুট হয়েছে। এতে সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পারভেজুর রহমান জনকন্ঠের কাছে খননের বালু নিয়ে অব্যবস্থাপনাসহ চুরি হরিলুটের কথা স্বীকার করে জানান, লোকবলের অভাবে স্থানীয় প্রশাসন থেকে সব স্পটে নজরদারি করতে না পারায় এমনটি হয়েছে। তবে কী পরিমাণ বালু হরিলুট হয়েছে এবং সরকারের কত টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে তা জানাতে পারেননি এই কর্মকর্তা।

বিআইডব্লিউটিএর সূত্রের দাবি, টোক থেকে ময়মনসিংহ অভিমুখে উজানের দিকে ৭৮টি স্পটে পর্যন্ত ১১৩ কোটি ১২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৫৮০ সিএফটি (ঘনফুট) বালু খনন করা হয়েছে। স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দেখানো মতে ব্রহ্মপুত্র পাড়ে সরকারের খাস জমিতে বেশিরভাগ বালু ফেলা হয়। ময়মনসিংহ জেলার ৬৯টি স্পটের মধ্যে ৪৯টিতে খননের বালু রাখা হয় ২৯ কোটি ২৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৭২ সিএফটি। বাকি ২০ স্পটের বালু এখনো পরিমাপ করা হয়নি। ময়মনসিংহ সদরে ২৭টি স্পটের মধ্যে ২৪টিতে ১০ কোটি ৭১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৬৫ সিএফটি বালুর হিসাব রেখেছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য মতেজেলার ৪৮টি স্পট থেকে ২৫ কোটি ২৫ লাখ ৩৫ হাজার ৭৬৬ সিএফটি বালুর হিসাব রয়েছে। এই হিসেবেই বাকি চার কোটি সিএফটির বেশি বালুর কোনো হদিস নেই? জেলার ৬৯ স্পটের মধ্যে মাত্র ১১ টি স্পট ইজারা থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ১৭ কোটি ৩৯ লক্ষ ৩৭ হাজার ৭০০ টাকা। বাকি স্পটের ইজারায় কোনো সাড়া মেলেনি বলে দাবি জেলা প্রশাসনের। ময়মনসিংহ সদরে ২৪ স্পটের মধ্যে ইজারা হয়েছে মাত্র চারটি স্পট। ইজারা হওয়া এই চার স্পট থেকে বালু বিক্রি হয়েছে কোটি সিএফটির কিছু বেশি। অথচ বিআইডব্লিউটিএ জেলা প্রশাসনের সূত্র জানিয়েছে, ময়মনসিংহ সদরে বালু ছিল প্রায় ১১ কোটি সিএফটি। বাকি প্রায় কোটি সিএফটি বালুর হদিস নেই! ইজারা হয়নি এমন স্পটের বালুই সবচেয়ে বেশি হরিলুট হয়েছে বলে জানায় স্থানীয়রা। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মপুত্র পারের ইপিজেডে পাঁচ কোটি সিএফটি বালু সরবরাহ নিয়েও রয়েছে নানা গুঞ্জন। প্রচার রয়েছে, ব্রহ্মপুত্র খননের পর থেকে এর বালুর বাণিজ্য একটি মাফিয়া সিন্ডিকেট কব্জায় রেখেছে। বালু হরিলুটের ফলে সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ব্রহ্মপুত্র নদ খননের বালু গায়েব নিয়ে দুদকের অনুসন্ধ্যান দাবি করেছেন স্থানীয়রা।

অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ছাড়াই চলছে ব্রহ্মপুত্র নন খনন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ছাড়াই চলছে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের কাজ। ব্রহ্মপুত্র নদে পানির প্রবাহ কমতে থাকায় এর দুই পাড়ে গড়ে উঠে অসংখ্য স্থাপনা। এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে খননের শুরুতে ময়মনসিংহ নগরীর কালিবাড়ি, জুবিলরোড, কাচারিঘাট পাটগুদাম এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরে অজ্ঞাত কারনে এসব স্থাপনা উচ্ছেদে মাঠে নামেনি স্থানীয় প্রশাসন কিংবা বিআইডব্লিউটিএ। নিয়ে স্থানীয় জনমনে নানা প্রশ্ন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদে পানির প্রবাহ দিন দিন কমে আসায় বহুস্থানে জেগে ওঠে চর। ময়মনসিংহ শহর লাগোয়া অংশে এখন আর ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গন নেই। বিপরীতে এর দুপাড়েই পড়েছে বালির চর। বিশেষ করে শহর লাগোয়া অংশের প্রায় ১৫ কিমিজুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল চর। শহরের বেগুনবাড়ি থেকে শুরু করে কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় শেষ মোড় পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের যে অংশ শহর লাগোয়া প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসীদের লোলুপ দৃষ্টি সেদিকেই। অপেক্ষাকৃত উঁচু শহর লাগোয়া বলে গত আশির দশক থেকে শুরু হয় এই জবর দখলের প্রতিযোগিতা। বিশেষ করে আগে থেকেই ব্রহ্মপুত্র নদ লাগোয়া যাদের আবাসিক বাসা ছিল তারা অতি দ্রুত তাদের বাসা পেছনের দিকে সম্প্রসারণ শুরু করে। নগরীর কাচারি ফেরিঘাট, জুবলিঘাট, থানার ঘাট, পুরনো ফেরিঘাট, পাটগুদাম ্যালিমোড়, ব্রিজ মোড় বলাশপুর এলাকায় এই জবরদখল চলে রাতারাতি। শহরের থানার ঘাট বালুচরে রাতারাতি গড়ে তোলে সহাস্রাধিক বসতবাড়ি। এখানেই কথিত ভূমিহীনদের নামে জবর দখল হয়ে যায় প্রায় ৭০ একর জমি। নিয়ে চলমান মামলায় অবৈধ দখলদাররা হেরে গেলেও স্থানীয় প্রশাসন এদের উচ্ছেদে কোন উদ্যোগ নেয়নি। প্রচার রয়েছে, এখানাকার জবরদখলকারী কথিত ভূমিহীনদের পেছনে অনেক রাঘব বোয়াল কুশলিবরা জড়িত। পুরনো ফেরিঘাট থেকে পাটগুদাম ব্রিজ মোড় পর্যন্ত এলাকায় রাতারাতি গড়ে তোলা হয় শত শত বসতবাড়ি। এসবের মধ্যে স্থায়ী বহুতল স্থাপনাও রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এখানকার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি একাই জবর দখল করেছেন একশকোটি টাকার জমি। পরে এসব জমির ভুয়া জাল কাগজপত্র তৈরি করে তা নানা জনের কাছে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদ জবর দখল করে তাতে ঘরবাড়ি তোলে এখানের অনেকেই ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। যে কোন সময় হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে আশঙ্কায় অনেকে এই মূল্যবান জমি একাধিকবার হাতবদল করেছে। ব্রীজের ওপারেও দেখা গেছে জবরদখলের এই চিত্র। শহরের কালিবাড়ি রোড এলাকায় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্রহ্মপুত্রের ওপর শহর থেকে পড়া একটি বড় ড্রেন জবর দখল করে তাতে স্থায়ী বসতবাড়ি গড়ে তুলেছেন। এসবের অনেক কিছুই হয়েছে জাল ভুয়া দলিলের ওপর। জাল ভুয়া কাগজপত্র তৈরি চক্রের এরকম একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলাও রয়েছে। এদের অন্যতম সদস্য জবেদ আলী মহুরীর বাসা থেকে পুলিশ জাল দলিল তৈরির বহু আলামত উদ্ধার করেছিল। ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজার রহমান জানান, ব্রহ্মপুত্র পাড়ের অবৈধ স্থাপনার বিষয়টি দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। খননের অগ্রগতি জানতে সবাইকে নিয়ে সভা আহবান করা হবে বলেও জানান তিনি।

ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলা হচ্ছে নগরীর ময়লাযুক্ত পানি ময়মনসিংহের মৃতপ্রায় পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ বাচাতে মোটা অঙ্কের টাকায় মেগা প্রকল্প নিয়ে পানির প্রবাহ বাড়াতে একদিকে চলছে খনন কাজ। আরেক দিকে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে ফেলা হচ্ছে ময়লাযুক্ত দূষিত পানি। নগরীর কাচিঝুলি মোড়, টাউনহল মোড়, নতুন বাজার, দুর্গাবাড়ি রোড, মহারাজা রোড, ট্রাঙ্কপট্টি, চন্নু মিয়া বাইলেন, বলাশপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জব্বারের মোড় থেকে পাইপ ড্রেন করে নগরীর একাংশের পানি ফেলা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদে। ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের এই প্রকল্পকে ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্পের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা। ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক উপ সচিব দিলরুবা আহমেদ জানান, শহরের পানি ব্রহ্মপুত্রে ফেলার এই প্রকল্প নদের দূষণ বাড়াবে। তবে ইটিপি কিংবা এসটিপির মাধ্যমে শহরের এই পানি ব্রহ্মপুত্র ফেলা হলে এই আশঙ্কা থাকবে না বলে জানান তিনি। ময়মনসিংহ পরিবেশ রক্ষা উন্নয়ন  আন্দোলন এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, ইটিপি ছাড়া সিটি কর্পোরেশনের এই প্রকল্প ব্রহ্মপুত্র নদকে আরেকটি বুড়িগঙ্গা সৃষ্টি করবে। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মিঞা জনকণ্ঠকে জানান, দাতা সংস্থাগুলো চাইলেই ব্যয়বহুল ইটিপি কিংবা এসটিপি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব।

×