ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৪ জুন ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

খোঁজে যৌথ বাহিনী

এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে কুকি চিন প্রধান নাথান বম

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ১৮ মে ২০২৩

এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে কুকি চিন প্রধান নাথান বম

নাথান বম

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জুড়ে আতঙ্ক, উদ্বেগ, অস্থির ও অশান্ত করে তুলেছে নাথান বমের নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার জঙ্গিদের অর্থের বিনিময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণদানের মাধ্যমে আলোচনায় আসে পাহাড়ি এই সংগঠনটি। গত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সংগঠনটির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তিনজন সেনা অফিসার হত্যা ও চারজন সেনা অফিসারকে আহত, একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারকে অপহরণ করে জিম্মি করাসহ আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, অন্যান্য পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটিয়েছে। কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সভাপতি নাথান বম এখন কোথায় আত্মগোপন করে পাহাড়ের জনপদে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে তার খোঁজ করছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিযান পরিচালনাকারী যৌথ বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে হত্যা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির নতুন আতঙ্কের নাম কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সংগঠনের সভাপতি নাম নাথান বম। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ দুর্গম পাহাড়ে বর্তমানে জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (মূল) ও ইউপিডিএফ (সংস্কার) এই চার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। এই চার সংগঠনের মূল কাজ চাঁদাবাজি এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্ক  তৈরি। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ভূখ-ের অধীনে থাকাটা মানতে পারছে না তারা। তাদের রয়েছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। কোনো কিছু হলেই সীমান্তের ওপারে তারা আশ্রয় নেয়। খুমি, লুসাই, খেয়াং, পাংখোয়া, স্নোং এই পাঁচ সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের নামে জেএসএসের এক শীর্ষ নেতার হাত ধরে এবং তার প্রশ্রয়ে কেএনএফ প্রতিষ্ঠা করে নাথান বম। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের নামে, মোটা অঙ্কের টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে, গহিন অরণ্যে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে  তোলা হয়। জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ প্রদানের চুক্তিও স্বাক্ষর করা হয়।

কিন্তু সেই কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ প্রদান বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারেনি নাথান বম। র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে সেই প্রশিক্ষণ আস্তানা তছনছ হয়ে যায়। জঙ্গি প্রশিক্ষণ ধরা পড়ার পর নাথান বমের একের পর এক অপকর্ম বেরিয়ে আসে। অবৈধ অস্ত্র পাচারের সঙ্গেও তারা জড়িত। দিন এনে দিনে খাওয়ার মতো পরিবারের সদস্য নাথান বমের সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যদের হাতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত ১৭ মে বান্দরবানে কুকি চিন সন্ত্রাসীদের গুলিতে বীর ক্যাম্পের সৈনিক মো. আলতাফ আহম্মদ ও মো. তৌহিদ নামের দুই সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দুই সেনা।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার অন্তর্গত সুংসুংপাড়ায় সেনাবাহিনীর টহল টিমের ওপর কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) সন্ত্রাসীদের গুলিতে সেনাবাহিনীর দুই সদস্য নিহত হয়েছেন। মাত্র এক সপ্তাহ আগে বান্দরবান পার্বত্য জেলার রোয়াংছড়িতে একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে প্রতিপক্ষ কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) মধ্যে গোলাগুলি হয়। পরে ঘটনাস্থল থেকে তিনজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

নিহত সন্ত্রাসীরা হচ্ছে নেমথাং বম এবং গণলাইনে কাজ করা মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও বাজার বা রসদ সরবরাহকারী লাল লিয়ান ও সশস্ত্র চাঁদা কালেক্টর সিম লিয়ান। এর আগে গত মার্চ মাসে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রোয়াংছড়ির দুর্গম পাহাড়ে সেনা টহল দলের ওপর কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় গুলিবিদ্ধ এক সেনা সদস্য নিহত হন। আহত হন আরও দুই সেনা সদস্য। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। তারও আগে আরেক অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারকে অপহরণ করে প্রায় পনেরো দিন আটক ও জিম্মি করে বিরাট অঙ্কের টাকা আদায় করে সংগঠনটি।

যৌথ বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের অপপ্রয়াসে লিপ্ত সশস্ত্র সংগ্রাম করা ‘কেএনএফের’ সঙ্গেও এদের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন জেএসএস, ইউপিডিএফ, এমএলএ, ত্রিপুরা ন্যাশনাল ফ্রন্ট ইত্যাদি উপজাতির পর, এবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামের আরেকটি বাহিনী। এরা চায় বাংলাদেশের একটা অংশ, ভাঙতে চায় স্বাধীন বাংলার ভূখ-। ২০০৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা কেএনডিও নামে এরা যাত্রা শুরু করে। সংগঠনের প্রধান নাথান বম পড়াশোনা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ বইসহ তার ছয়টি বই প্রকাশিত হয়।

এ কারণে নাথান বম লেখক হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিত। বং, পাংখুয়া, লুছাই, খুমি, ¤্রাে এবং খিং উপজাতিদের নিয়ে এ সংগঠন তৈরি হয়। পরে ২০১৬ সালে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কু-চি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। এদের সশস্ত্র বাহিনীর নাম কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি অর্থাৎ কেএনএ। প্রথমে নাম ছিল কুকি চিন ন্যাশনাল ভলেন্টিয়ার্স বা কেএনভি। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাজ্য গঠনের পাঁয়তারা করছে এ সামরিক সংগঠনটি। প্রকাশ করেছে নিজস্ব পতাকা, মনগড়া মানচিত্র ও জাতীয় সংগীত। সদস্যদের দেওয়া হচ্ছে কঠোর কমান্ডো প্রশিক্ষণ। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের বিভিন্ন তৎপরতার ভিডিও তাদের ইউটিউব চ্যানেলে নিয়মিত আপলোড করা হয়।

ভিডিওতে দেখা যায় কখনো তারা ভারী অস্ত্র, ভারী রসদ নিয়ে সুউচ্চ পাহাড়ে উঠছে, কখনো জীবিত সাপ, বিচ্ছু, পোকামাকড় খাচ্ছে, আবার কখনো উচ্চস্বরে গাইছে নিজেদের জাতীয় সংগীত। বান্দরবান সীমান্তের ওপারে চিন নামের মিয়ানমারের যে রাজ্য রয়েছে সেখানেই তাদের মূল ঘাঁটি। যারা মিয়ানমার থেকে আলাদা হয়ে কুকি চিন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য এলাকায় অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরিতে তৎপর রয়েছে কেএনএফ নামের নাথান বমের নেতৃত্বাধীন এই সশস্ত্র সংগঠনটি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্প্রতি সংগঠনটির সশস্ত্র সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে পাহাড়ি এলাকায়। সংগঠনটির অনেককেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে কেএনএফের প্রধান সংগঠক নাথান বম এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে সে কোথায় আছে, এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। তবে কেএনএফের অস্ত্রধারী সদস্য সংখ্যা দুইশ’র মতো হবে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথ্য পেয়েছে।

তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে অর্থের বিনিময়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ, অবস্থান, অস্ত্র সরবরাহ ও আশ্রয় দেওয়ার কারণে আলোচনায় আসে কেএনএফ। যদিও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা- পরিচালনা করে আসছিল কুকি চিনের সদস্যরা। সংগঠনটির ১৭ জন সদস্য এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের কাছ থেকে একে-৪৭, একে-২২, আইইডি এবং বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার ৬টি জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে কেএনএফ গঠিত। নাথান বমসহ সংগঠনের অন্যান্য সিনিয়র নেতা দেশের ভেতরে বা বাইরে আত্মগোপনে রয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
র‌্যাবের মুখপাত্র র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, দেশের ভূখ-ে অবস্থান করে যারা রাষ্ট্রবিরোধী বা আইনবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। সেটা কুকি চিন হোক বা কোনো জঙ্গি সংগঠন হোক না কেন তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। কুকি চিনের কাছে যেসব অস্ত্র এসেছে, তা পাশের দেশগুলো থেকে সরবরাহ করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে র‌্যাব যখন অভিযান চালনা করে তখন বান্দরবানসহ পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করে জঙ্গি সংগঠন শারক্বীয়াকে প্রশিক্ষণসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করে যাচ্ছিল নাথান বম।

শারক্বীয়ার সদস্যদের পাহাড়ে অবস্থানের সময় সরাসরি উপস্থিত থেকে সহায়তা করত সে। তবে এখনো তার সঠিক অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। সে আত্মগোপনে চলে গেছে, না কি গহিন পাহাড়ে অবস্থান করছে, এ বিষয়ে র‌্যাবের কাছে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে সীমান্তের ওপারেও নাথান বম অবস্থান করে এমন তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তার দাবি।

×